সোনাগাজী উপাখ্যান

33

এই উপাখ্যান কোন রূপকথা বা কল্পকথা নয়। ৬ এপ্রিল ঘটে যাওয়া বাস্তব ঘটনার এক অবিশ্বাস্য চিত্র সোনাগাজী উপাখ্যান। বাংলাদেশে প্রায়ই খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি, শ্লীলতাহানি এবং গুম হওয়ার মত অহরহ ঘটনা ঘটছে। এক্ষেত্রে সোনাগাজী উপাখ্যান ব্যতিক্রম এবং বহুল প্রচারিত, প্রকাশিত এক নারকীয় হৃদয় বিদারক ঘটনা। সাধারণতঃ খুন, ধর্ষণের ঘটনা পর্যালোচনা করলে বুঝা যায়, প্রত্যেকটি ঘটনায় হয়ত সর্বোচ্চ ২/৩ জনের সম্পৃক্ততা থাকে। এখানে অধিক সংখ্যক লোকের যোগসাজশের কথা পিবিআই রিপোর্টে প্রমান মিলে। সে কারণে নুসরাত হত্যাকান্ড এই যাবতকালের সবচেয়ে পৈশাচিক এবং লোমহর্ষক পরিকল্পিত ঘটনা হিসেবে জনগণের কাছে স্বীকৃত। এই উপাখ্যানের মূল পরিকল্পনাকারী সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এম.সিরাজদ্দৌল্লা। পৃষ্ঠপোষকতায় সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন (যিনি বর্তমানে রংপুর পুলিশ রেঞ্জে বদলীকৃত)। সার্বিক তত্ত¡াবধানে এবং অর্থের যোগানদাতা সরকারী দলের নেতা জনাব রুহুল আমিন। অবশিষ্ট সোয়া এক ডজনের অধিক যুবক-যবতীর প্রত্যক্ষ বহুমুখী কর্মকান্ডের রুপয়ান সোনাগাজী উপাখ্যান।
পাঠক সমাজ শুনে অবশ্যই আশ্বস্ত হবেন, নুসরাত হত্যাকান্ডে জড়িতদের সবাইকে পিবিআই গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠাতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশে এই প্রথম অতি অল্প সময়ের মধ্যে অর্থাৎ ২৮ মে ১৬ জনকে আসামি করে পিবিআই আদালতে চার্জশিট জমা প্রদান করে। আদালত মামলার পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণের জন্য ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ফাইল পাঠিয়ে দেন। ইতোমধ্যে ওসি মোয়াজ্জেম কর্তৃক সেলফোনে অশোভনভাবে এবং পরিকল্পিতভাবে নুসরাতের ভিডিও ধারণ এবং তা ভাইরাল করার কারণে ব্যারিস্টার সাইয়েদুল হক সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে মামলা রুজু করেন। সেই প্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনাল ২৭ মে ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। গ্রেফতারি পরোয়ানা যথারীতি পাঠানো হলেও রংপুর পুলিশ রেঞ্জ অফিসে যথাসময়ে পৌঁছায়নি। সেই সুযোগে ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন আত্মগোপনে চলে যান। কথায় আছে -মাসতুতো ভাই না হলেও জাতভাই তো বটে, যেহেতু একই সংস্থায় চাকুরি। হাজার হলেও চিরচেনা একটি মুখ কারণে-অকারণে কষ্ট পাবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা মানতে সহকর্মীরা নারাজ। পিবিআই এর মতে এটি পুলিশ প্রশাসনের ব্যর্থতা। নতুবা স্বশরীরে কর্মরত একজন মানুষ সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে কিভাবে হাওয়া হয়ে যায়। বলাবাহুল্য, রংপুর রেঞ্জ থেকে প্রত্যাহার করার জন্য রংপুরবাসী ওসি মোয়াজ্জেম এর বিরুদ্ধে কয়েক দফা মানববন্ধন করেন। যাইহোক, অবশেষে ২০ দিন পর ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে পিবিআই গ্রেফতার করতে সক্ষম হন।
সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজদ্দৌল্লার লোভ-লালসার শিকার মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি। ৬ এপ্রিল সিরাজদ্দৌল্লা গংয়েরা বলপূর্বক নুসরাতকে আগুনে ঝলসিয়ে দেয়। নিকট অতীতে সিরাজদ্দৌল্লার অনৈতিক কর্মকান্ডের সাক্ষী নুসরাত নিজেই। সেই কারণে মৃত্যুর দুয়ারে দাড়িয়ে নুসরাত প্রতিপালকের কাছে ফরিয়াদ করেছিল, “আমাকে জীবন দাও, আমি অধ্যক্ষ সিরাজদ্দৌলার পরিণতি দেখে যেতে চাই”। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, বর্বরোচিত এবং পৈশাচিক হামলার তীব্রতায় ১০ এপ্রিল নুসরাত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে বাধ্য হয়। জীবিত নুসরাতের চেয়ে মৃত নুসরাতের আবেদন অনেক হৃদয়গ্রাহী । কোটি মানুষের হৃদয়ে থাকবে চিরভাস্বর। ধর্ম-বর্ণ এবং দলমত নির্বিশেষে সকল শ্রেণী পেশার মানুষ এক কাতারে সিরাজদ্দৌল্লা গংদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার। কোটি মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছে এবং সাক্ষ্য দিচ্ছে-নুসরাতের মৃত্যু একটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড । সিরাজদ্দৌল্লা গংদের কি হবে, কি হওয়া উচিত, সেই সিদ্ধান্ত একমাত্র বাংলাদেশের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। এই দেশের মানুষ আশাবাদী, সিরাজদ্দৌল্লা গংদের পরিণতি হবে ভয়াবহ, যা আমরা প্রত্যক্ষ করব সহজভাবে।
সিরাজদ্দৌল্লার শিক্ষকতা জীবনে নুসরাতের মত অনেক মেয়ের সর্বনাশ করেছে। লজ্জায় এবং ভয়ে তারা মুখ খুলতে সাহস পায়নি। এই বিষয়ে দুই-একটি অভিভাবকদের পক্ষ থেকে অভিযোগ হলেও মাদ্রাসা গভর্নিং বডি তথা কর্তৃপক্ষ তা আমলে নেননি। সেই সুযোগের অপব্যবহার করে দোর্দন্ড প্রতাপে সোনাগাজী সাম্রাজ্যের অধিকারী হয় সিরাজদ্দৌল্লা। নিজের প্রয়োজনে ঘরে-বাইরে গড়ে তুলে পেটোয়া বাহিনী। শুধু তাই নয়, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে বশে নেয়, সোনাগাজী থানা-ইনচার্জ জনাব মোয়াজ্জেম হোসেনকে। যিনি একাধিকবার সিরাজদ্দৌল্লার পক্ষে এবং নির্যাতিতার বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। নুসরাতের শ্লীলতাহানির ঘটনায় ওসি মোয়াজ্জেম থানায় মামলা নিতে গড়িমসি করতে থাকেন। সেই ওসি নুসরাতকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময়ে আপত্তিকর, বিব্রতকর ও অসংলগ্ন প্রশ্নে জর্জরিত করে। নুসরাত লজ্জায় মুখ ঢাকলে তাকে ধমক দিয়ে ওড়না সরাতে বাধ্য করেন। একপর্যায়ে নুসরাতের জবানবন্দি নেওয়ার দৃশ্য ওসি সেলফোনেই ভিডিও করেন এবং পরবর্তীতে তা ভাইরাল হয়ে যায়। সোনাগাজী পুরো এলাকায় প্রভাব বিস্তারের জন্য সিরাজদ্দৌল্লা অত্র এলাকার গুটিকতেক সরকার দলীয় নেতাদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেন এবং যারা সিরাজদ্দৌল্লার মদদপুষ্ট।সেই থেকেই সিরাজদ্দৌল্লা হয়ে ওঠে বেপরোয়া এবং নিজেকে গডফাদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। মাদ্রাসা শিক্ষকদের মধ্যে কেউ কেউ সিরাজদ্দৌল্লার অনৈতিক এবং দূর্নীতির ব্যপারে মুখ খুললেও এতদিন শান্তিতে ঘুমাতে পারেননি। অনেকে চাকুরিচ্যুতির ভয়ে স্রোতে গা ভাসিয়ে দেন। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে নিজের ইচ্ছায় মাদ্রাসা পরিচালনা করেন অধ্যক্ষ সিরাজদ্দৌল্লা।
নুসরাত মাদ্রাসার ছাত্রী। বড় পরিচয় একজন মানুষ। মা-বাবা, ভাইদের আদরে বেড়ে ওঠা পরিবারের এক সাহসী সন্তান। মাদ্রাসার সহপাঠিদের কাছে এক অতি প্রিয়মুখ। নারী জাগরণী ভূমিকায় এক অকুতোভয় সৈনিক। নুসরাতের জীবনে স্বপ্ন ছিল, ছিল প্রেম-ভালবাসা, তা ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি সংঘটিত বনানী এফআর টাওয়ারের আগুন কারো গায়ে লাগিয়ে দেওয়া হয়নি, তবে নুসরাতের গায়ে বলপূর্বক আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে সন্ত্রাসী কায়দায় এবং পরিকল্পিতভাবে। সেই নৃশংসতার দৃশ্যটুকু অনেকের অগোচরে হলেও নুসরাতের মৃত্যুকালীন সময়ের কথা কারো অজানা নয়।
ইদানীং আমাদের দেশে নারী ও শিশুর প্রতি নির্যাতন এবং সহিংসতা দিন দিন বেড়ে চলেছে। দেশ যেন অনিশ্চিত এবং অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে। লাখো শহীদের রক্তে গড়া আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশ। এই ধরণের সকল সামাজিক অনাচার এবং অপসংস্কৃতি আমাদের রুখতে হবে। এক্ষেত্রে আইনের কঠোর প্রয়োগ একমাত্র আলোর পথ দেখাতে পারে। * নুসরাতের পরিবারের জীবন-মান নিরাপদ করা জরুরি। * পিবিআই কর্তৃক যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের যথাযথ বিচার নিশ্চিত করা জনগণ প্রত্যাশা করে। * একজন নুসরাতকে হত্যা করতে গিয়ে এতগুলো মানুষের যোগসাজশ বস্তুতঃ পরিকল্পিত হত্যাকান্ডের পরিচায়ক। * স্কুল-কলেজ এবং মাদ্রাসায় ছাত্রী সংখ্যার উপর ভিত্তি করে মহিলা শিক্ষক নিয়োগ প্রদান করা যুক্তিযুক্ত। সবশেষে একটি কথা বলে শেষ করতে চাই, নুসরাত হত্যায় প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের প্রতিফলন হবে – বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুরক্ষাকবচ।

লেখক : প্রাবন্ধিক