সৈয়দ আমিরুজ্জমান শাহ্ (র.)

17

মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম

হযরত আমিরুল আউলিয়া শাহ্ আমিরুজ্জমান (র.) একজন বিখ্যাত সাধক। তাঁর মাজার শরীফ পটিয়া পৌর সদরে ৯নং ওয়ার্ডে গোবিন্দারখীল গ্রামে প্রখ্যাত ধর্মপ্রাণ মহাসাধক হযরত মওলা চাঁদ (র.) এর পবিত্র ঔরষজাত সন্তান তিনি। ১ চৈত্র ১২৫২ বাংলা, ১২ জিলক্বদ ১২৬৫ হিজরী ১৮৪৫ সালের কোন এক বৃহস্পতিবার জন্মগ্রহণ করেন বলে সাংবাদিক এস.এম.এ.কে. জাহাঙ্গীরের প্রকাশিত ‘পটিয়ার ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ গ্রন্থ সূত্রে প্রকাশ। যিনি কঠোর ত্যাগ-তিতিক্ষা রেয়াজত ও সাধনার মাধ্যমে ¯্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ এবং হযরত গাউছুল আজম সৈয়দ মাও. আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (ক.) এর অন্যতম প্রধান খলিফার মর্যাদা লাভ করেছিলেন। কথিত আছে যে, তিনি কোন দিন মাইজভান্ডার শরীফ থেকে তাঁর মুর্শেদকে পেছনে রেখে বাড়ি ফিরতেন না। ফিরতেন তাঁকে সামনে রেখে পিছু হেঁটে। তাছাড়া জনশ্রæতি আছে যে, তিনিই সর্ব প্রথম মাইজভাÐার শরীফে দপ বাজিয়ে জিকির মাহফিলের সূত্রপাত করেন। হযরত মওলানা আজিজুল হক শেরে বাংলাও (র.) দীওয়ানে আজিজ গ্রন্থে তাঁর মহিমা কীর্তন করেছেন। তাঁর একটি কালাম আছে, সেটি হচ্ছে ‘হাবিবে রহমান মেরে বাবাজান ছাহেবে সোলতান আমিরুজ্জমান’ তা তাঁর শিষ্য ও ভক্ত অনুরক্তরা আজো অত্যন্ত আদরের সাথে পাঠ করেন যা জীবদ্দশায় তিনি নিজেও জপতেন। মওলানা সৈয়দ ফৌজুল আজিম শাহ্ আমিরী কর্তৃক গ্রন্থকারে এবং অধ্যাপক মুহাম্মদ আবু তালেব বেলাল কর্তৃক সম্পাদিত ‘আদরের কালা সোনা’ গ্রন্থে তাঁর অসংখ্যা কারামতের কাহিনী বর্ণনা রয়েছে তার মধ্যে।
আমিরুল আউলিয়া (ক.)’র বেলায়েতের নজর দানে মরিয়মের জীবন দান নুরুদ্দীন ফকির ও হযরত আমিরুল আউলিয়া (ক.)’র ওজর পানি- পটিয়া থেকে আমিরুল আউলিয়া মাইজভাÐার শরীফে তথা পীরের খেদমতে পায়ে হেঁটে আসা-যাওয়া করতেন, হযরত গাউছুল আজম সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাÐারী (ক.) সেদিন হযরত আমিরুল আউলিয়া (ক.) কে বেলায়ত ওজমা প্রদান করে নিজ এলাকায় ত্বরিকত প্রচারের নির্দেশ দেন। সেদিনও তিনি স্বীয় মুর্শীদকে সামনে রেখে পিছু হেঁটে মাইজভাÐার থেকে পটিয়া আসেন।
অদৃশ্য থেকে বর্শা নিক্ষেপে ভল্লুকের আক্রমন থেকে শিষ্যকে রক্ষা। জবে হওয়া পশু পুনঃরায় জীবিত করা। *পুরুষ নারীতে রূপান্তরিত হওয়ার ঘটনা। *পায়খানা হতে আন্টি উত্তোলনের ঘটনা। বেলায়েত ওজমার প্রভাবে মৌলানা আবদুর রশিদ এর জীবনের গতি পরিবর্তন। *হযরত আমিরুল আউলিয়া (ক.) কে পটিয়া থানায় নিয়ে বুজুর্গীর পরীক্ষা। *হযরত আমিরুল আউলিয়া (ক.)’র ব্যতিক্রম চলা ভক্তগণ (পাগলা দল)* লাঠি দিয়ে মাটিতে আঘাত পূর্বক মৃত শিশুকে জীবন দান। *হযরত আমিউল আউলিয়া (ক.)’র পবিত্র চাদর মোবারক টুকুরো করে বন্টন।* ‘২রা শাওয়ালের রোজা’ আমিরুল আউলিয়ার ভক্ত মুরিদের ইমানী পরীক্ষার সবক। *আমিরুল আউলিয়া (ক.)’র ছোট ভাইকে গাউছুল আযম মাইজভান্ডারী (ক.) কর্তৃক বটের ছায়ায় প্রেরণ।
আমিরুল আউলিয়া (ক.)’র ভবিষ্যত বাণীর মধ্যে আরো একটি বা রয়েছে- ‘অবিরত যাইও পীরের দরবারে সই অন্তরে, প্রেমের তালা খোলা রাখব সপ্তায় একদিন বুধবারে’। আমিউল আউলিয়া (ক.)’ কে কোন পর্যায়ে বা কি হিসেবে হযরত কেবলা (ক.) জানতেন তা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। কারণ আমিরুল আউলিয়া (ক.)’ একটি স্ব-লিখিত কালাম উল্লেখ করার উত্তম হবে কালামটি হচ্ছে- ‘তুমি সেই, আমি সেই, তুমি আমি এক- যে পাইবে জ্ঞান আঁখি সে বুঝিবেক।’
মুর্শিদের প্রতি ভক্তির নমুনা হিসেবে আমিরুল আউলিয়া (ক.) আরো একটি পরিচয় লাভ করে। আর তা হল, তিনি যতবার পীরের দরবারে যেতেন পটিয়া থেকে হেঁটে যেতেন এবং আসার সময় হেঁটে হেঁটে আসতেন। শুধু তাই নয়, তিনি হেঁটে আসতেন উল্টো ভাবে। অর্থাৎ পীরকে সামনে রেখে পিছন হয়েই হেঁটে আসতেন, যাতে পীরের প্রতি পূর্ণশ্রদ্ধা রক্ষা হয় এবং বেয়াদবী না হয়। আমিরুল আউলিয়া (ক.)’র কষ্ট, সাধনা ও ত্যাগ ছিল বর্ণনা অতীত। তাই তো তিনি তাঁর কালামে নিজকে প্রথমে প্রশ্ন করেন- হীন আমিরুজ্জমান তুমি ওলি (আউলিয়া) হইলা কেন? আবার নিজেই জবাব দিচ্ছেন- এত কঠিনতা তোর পরীক্ষার করণে।
হযরত গাউছুল আজম আমিরুল আউলিয়া (ক.)কে বিশেষ ছবক দ্বারা খেলাফত প্রদান করে বিদায় দেওয়ার পর বীনাজুরি খাল দিয়ে মাইজভান্ডারে যাওয়ার জন্য হযরত কেবলা (ক.) সেখানে বাহক সহকারে পালকি প্রেরণ করতেন কেবল (তাঁর) আদরের কালা সোনাকে তাঁর সান্নিধ্যে আনার জন্য। কালা সোনাও এটা ব্যবহার করতেন অতি আদরের সাথে। তিনি কোনদিন ঐ পালকিতে পা তুলে বসেনি। কেবল মুর্শিদের হুকুম পালনার্থে তার দেহের উপরিভাগ পালকিতে রাখতেন এবং নি¤œাঙ্গ পা দু’খানা ঝুলিয়ে রেখে হযরত কেবলার দরবারে যেতেন।
পীরে কামেল শাহসুফি সৈয়দ আবু ইউসুফ শাহ্ (র.) কর্তৃক সৈয়দ আমিরুজ্জমান শাহ্ (র.) জীবনী ও কারামত এর মধ্যে আমিরুল আউলিয়া একদিন রাতে সুচক্রদন্ডী গ্রামে মাহফিল শেষে আওলার বাড়ির ভেতর দিয়ে দরবারে চলে আসার সময়ে কবরস্থানে পাশে দাঁড়ালেন। অমুক অমুক ব্যক্তির কবর কোন জায়গায় তাদের সাথে একটু দেখা করার প্রয়োজন মনে করি। ভক্তগণ উত্তরে বললেন- এ কি বলছেন? এঁরা কত বছর হয়ে গেল ইন্তেকাল করেছেন তার হিসাব নেই। বাবাজান বললেন তাদের সাথে আমি দেখা না করলে কেমন হবে। ঐ মসজিদের পেশ ইমাম আবদুর রশিদ আমিরুল আউলিয়ার কথা শুনে ঘুম থেকে জেগে জানালা দিয়ে কথাগুলো শ্রবণ করলেন। কবরস্থান থেকে অমুক ব্যক্তিকে ডেকে নিয়ে আস? তখন ঐ ব্যক্তি কবর থেকে আস্তে আস্তে উঠে বাবাজানকে কদমবুচি করে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলেন। বাবাজান তাকে বললেন- তোমরা কেমন আছ? তৎ উত্তরে ঐ ব্যক্তি বললেন আমরা খুবই ভালো আছি। এভাবে কয়েকজন কবরবাসী মুরিদানের ভালোমন্দ জিজ্ঞাসা করলেন। বাবাজান বললেন আমি তোমাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছি। আল্লাহর রহমতে তোমরা ভালো আছ জেনে খুবই আনন্দিত হলাম। তখন আমিরুল আউলিয়া কবরবাসী ভক্তকে জিজ্ঞাসা করলেন তুমি দুনিয়ায় থেকে যাবে, নাকি চলে যাবে? তখন ভক্তটি জবাব দিলেন বাবা আমি চলে যাব। ঐখানে বরং শান্তি। এখানে থাকব না। হযরত এভাবে তিনবার জিজ্ঞাসা করলেন। ঐ ভক্ত একই রকম উত্তর দিলেন। যাও বাবা তোমার জায়গায়। তুমি চলে যাও। মসজিদের ইমাম মাওলানা আবদুর রশিদ গভীর রাতে আমিরুল আউলিয়ার এ মহান কারামত দেখে পাগলের মত হয়ে গেলেন। তিনি দ্রæত ফজরের নামাজ শেষে হযরত কেবলার কাছে গিয়ে বায়ার করে নিলেন।
বোয়ালখালীর সারোয়াতলীর গ্রামের বাসিন্দা আমির আলী রেঙ্গুনে থাকতেন। আমির আলীর মা বাবাজানের মুরিদ ছিলেন। তার মা বহুদিন যাবৎ বাবাজানের কাছে আর্জি পেশ করতেন তার চরিত্রহীন ছেলেকে রেঙ্গুন থেকে দেশে তার বুকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। সে কোন ধর্মের ধার ধারত না। বাবাজান কেবলা তার মায়ের কান্না সহ্য করতে না পেরে আধ্যাত্মিক শক্তিবলে রেঙ্গুন শহরে গিয়ে আমির আলীকে জাহাজে টিকেট কাটিয়ে তুলে দিলেন। দুই একদিন পর তার মা বাবাজানের দরবারে হাজির হলেন। আমির আলী বাবাজানের খেদমত করে সৎ মানুষের মত পরিণত হলেন।
এছাড়া আমিরুল আউলিয়ার (ক.) অসংখ্য কারামতের মধ্যে পদাঘাতে পুকুর সৃষ্টি, রিয়া লৌকিকতা এবং অহংকার দমন, সূর্যের উপর প্রভাব বিস্তা, হযরত আকবর শাহ্ (র.) এর মাজার শরীফ চিহ্নিতকরণ, বেলায়তী ক্ষমতায় মামলার আসামীকে মুক্তিদান, মাইজভান্ডার শরীফের প্রথম বাজনা ও ওরশ শরীফের প্রচলন, হযরতের নেক দৃষ্টিতে পুত্র সন্তান লাভ, মুরীদের বিপদে সাহায্য, ক্ষতিকর বস্তু ঔষধে পরিণত, সাপে কাঁটা রোগীর বিষ ধ্বংস ও সাপের শাস্তি, মৃত শিশুকে জীবনর দান, স্মরণকারী ভক্তদের মুহূর্তে নদীবক্ষের ঘূর্ণিপাক হতে উদ্ধার, মরা মাছ জীবিত করা ইত্যাদি।
১৯২৭ সালে এই মহান অলি পরলোক গমন করেন। তার জানাজায় নামাজের নির্ধারিত সময়ে লোকজন আমির ভাÐার হুমাড়িয়া বিলে জমায়েত হল এবং জানাজায় নামাজে ইমামতির প্রস্তুতি সন্ধিক্ষণে বড় মিয়া অর্থাৎ হযরত সৈয়দ সোলাইমান শাহ্ (ক.) স্বীয় আব্বাজানের প্রতি অতি ভক্তির কারণে কাঁপতে কাঁপতে হঠাৎ বেহুশ হয়ে পড়ে গেলেন। অতঃপর নামাজের ইমামতি করেন চন্দনাইশের সাতকানিয়া নিবাসী হযরত আমিরুল আউলিয়ার প্রধান খলিফা হযরত মৌলানা আবদুর রশিদ শাহ্ (র.)। তাঁর মাজার শরীফে এসে প্রতিদিন শত শত ভক্ত অনুরক্ত আশেকান ও বিভিন্ন শ্রেণির পেশার মানুষ আসে নানা সমস্যা রোগব্যাধী, আসার নিয়ত, মানত দোয়া লাভ ও রুহানী ফয়েজ লাভের আশায়। বিশেষ করে প্রতি বুধবার তাঁর মাজারে বেশি ভীড় জমায় ভক্তরা। বার্ষিক ওরশে হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে। এছাড়া পটিয়া পৌরসভার মেয়র অধ্যাপক হারুনুর রশিদ ও ভক্তদের সহায়হায় পটিয়া থানার মোড়ে দৃষ্টিনন্দন একটি তোরণ নির্মাণ করেন। পটিয়ার স্বনামধন্য শিল্পপতি ও অন্যান্য ভক্তদের আর্থিক সহায়তায় বর্তমানে এই মাজার শরীফের কাজ নতুন ভাবে চলমান রয়েছে। আল্লাহ্তায়ালা আমাদেরকে এই আউলিয়া রুহানী ফয়েজ লাভ করার সুযোগ দিন। আমিন।

লেখক : সভাপতি, পটিয়া প্রেস ক্লাব