সেবার মেলা সবার মেলা

32

নিজস্ব প্রতিবেদক

কারও প্রয়োজন ভূমির নামজারি, কারও প্রয়োজন শিক্ষার্থী ভর্তি সহায়তা, আবার কারও প্রয়োজন পাসপোর্ট বা লাইসেন্স। সবই মিলেছে নগরীর জিমনেশিয়ামের উদ্ভাবনী মেলায়। সরকারি সেবা নিতে প্রতিটি স্টলে দর্শনার্থী ছিল চোখে পড়ার মত। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেবা নিশ্চিত করতে পারায় খুশি দর্শনার্থীরা।
তাদের মতে, উদ্ভাবনী মানে নতুন কিছুর আবিষ্কার, নতুন কিছুর উদ্ভাবন। সরকারি দপ্তরের সেবা যদি এক ছাদের নিচে পাওয়া যায় তাহলে সেবা নিতে ক্ষতি কি? তাই আমরা প্রতিটি বুথ থেকে নিজের ও পরিবারের নানান সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা, পরামর্শ ও সহায়তা নিতে এসেছি। ‘উদ্ভাবনী জয়োল্লাসে স্মার্ট বাংলাদেশ’ স্লোগানে গতকাল মঙ্গলবার চট্টগ্রাম ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলার দ্বিতীয় এবং শেষ দিনে দর্শনার্থী ছিল প্রথমদিনের তুলনায় বেশি। চট্টগ্রামের ২০টি সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠান এক ছাদের নিচে গ্রাহকদের নানা বিষয়ে পরামর্শ, সহায়তা ও সেবা প্রদান করে। এতে আগত দর্শনার্থীরাও হয়রানিমুক্ত সেবা পাওয়াতে নানা সুবিধা গ্রহণ করেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, অনলাইনে আবেদন, রেজিস্ট্রেশন থেকে শুরু করে ডেলিভারি পর্যন্ত যত পদক্ষেপ রয়েছে তার খুঁটিনাটি সব সেবা গ্রাহককে মাত্র দুই মিনিটে বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে। একটি পাসপোর্ট কেন, কি কারণে বাতিল হয় ইত্যাদি বিষয় মেলায় আগত দর্শনার্থীদের বুঝিয়ে দিচ্ছেন বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের তত্ত¡াবধায়ক মো. শরিফুল ইসলাম।
তিনি পূর্বদেশকে বলেন, একজন গ্রাহকের ই পাসপোর্টের আবেদন, ব্যাংকে টাকা জমা দেয়ার পদ্ধতি, পাসপোর্টের অবস্থান, ডেলিভারি থেকে সব ধরনের সেবা এ বুথ থেকে দেয়া হচ্ছে। তবে বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশনটা অফিসে করা হচ্ছে। দর্শনার্থীরাও সেবা পেয়ে অনেক খুশি। দর্শনার্থীদের আমরা ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছি এবং কাক্সিক্ষত সেবা প্রদান করেছি।
বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক আবু সাঈদ পূর্বদেশকে বলেন, সাধারণ মানুষ মনে করেন অনলাইনে ই পাসপোর্ট আবেদন করা যায় না। ফলে তারা দালালের শরণাপন্ন হন। আর দালালরা আবেদনে নানা ভুল করে দেন। ফলে ওই আবেদনকারী পড়েন ভোগান্তিতে। আমরা এখানে কীভাবে আবেদন করতে হয়, কীভাবে ভুল ত্রæটি না করে সহজে পাসপোর্ট পাওয়া যায় সে পরামর্শ গ্রাহককে প্রদান করি।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) বুথে দেখা গেল, জমে থাকা পাঁচ হাজার ড্রাইভিং লাইসেন্স থেকে এক হাজার লাইসেন্স গ্রাহককে প্রদান করা হয়েছে। বাকি লাইসেন্সগুলো সংগ্রহ করতে এখনও আসেননি লাইসেন্সপ্রার্থীরা। তবে তাদের লাইসেন্স বিআরটিএ’র বুথ থেকে দেয়া হবে বলে জানানো হয়।
চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা তাদের নিজস্ব উদ্ভাবনকৃত বেশ কয়েকটি প্রজেক্ট মেলায় প্রদর্শন করেছেন। এর মধ্যে ছিল সীমান্ত এলাকায় পাহারা দেয়ার জন্য বর্ডার গার্ড রোবট, দেশি-বিদেশিদের বিভিন্ন সেবা (যেমন- এয়ারপোর্ট, হাসপাতাল এবং ব্যাংক) দেয়ার জন্য ভয়েস রিকগনিশন রোবট, সূর্যের দিক থেকে বিদ্যুৎ সংগ্রহ করার জন্য সোলার ট্র্যাকিং, কার পার্কিং অটোমেশনের জন্য অটোমেটিক কার পার্কিং, স্মার্ট হোস সিস্টেম ইত্যাদি।
বাংলাদেশে যারা শিক্ষিত এবং দক্ষ হয়ে বেকার বসে আছেন, তাদের জন্য অপেক্ষায় আছে জেলা জনশক্তি ও কর্মসংস্থান অফিস। বিদেশের নানা সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান দক্ষ ও শিক্ষিত যুবকের খোঁজ করে এ অফিসে। তাই মেলায় আগতদের মধ্যে যারা বিদেশ যেতে ইচ্ছুক, তাদের নাম-ঠিকানা ও দক্ষতা রেজিস্ট্রেশন করে রাখা হচ্ছে। যে কোনো সুবিধা আসার সাথে সাথে যেন ওই যুবক বিদেশ পাড়ি দিতে পারেন।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা জনশক্তি ও কর্মসংস্থান অফিসের প্রধান মো. আলী পূর্বদেশকে বলেন, যে কেউ অফিস থেকে কার্ড সংগ্রহ করে বিদেশে পাড়ি দিতে পারেন। সেজন্য তাদের আগে থেকে নানা বিষয়ে দক্ষ করতে আমরা মেলায় এসেছি। সাথে বিদেশগামীদের বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করেছি।
ছাদবাগানের গুরুত্ব, সম্প্রসারণ ও সম্ভাবনা নিয়ে মেলায় এসেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। তারা ছাদে কি সার ব্যবহার করা যাবে এবং কি বীজ ব্যবহার করতে হবে তা নিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন।
সঞ্চয়পত্র খোলা নিয়ে ডাক বিভাগ প্রচারণা করছে। সঞ্চয়পত্রের সুবিধা নিয়ে দর্শনার্থীদের বুঝিয়ে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) টেলিফোনের নানা সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি নিয়ে এসেছে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা। সে বিষয়ে সাধারণ মানুষকে অবহিত করতে নানা অফার রয়েছে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) তাদের নিজস্ব সার্ভিসগুলো কীভাবে ডিজিটালাইজেশন হল সে বিষয়ে দর্শনার্থীদের বুঝিয়ে দিচ্ছে। যেমন- আরএসডিএমএস দ্বারা কীভাবে প্রান্তিক পর্যায়ে উন্নয়ন করা হল তা দেখানো হচ্ছে।
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ অনলাইনে সাধারণ ডায়েরি (জিডি), ট্রাফিক আইনের জরিমানা, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স ও ৯৯৯ সেবা সম্পর্কে দর্শনার্থীদের অবহিত করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসন তাদের নিজস্ব সেবা যেমন- ল্যান্ড মিউটিশন, নামজারি, তথ্য ও অভিযোগ, শিক্ষা-বাণিজ্য ইত্যাদি বিষয়ে সেবা ও সহায়তা প্রদান করছে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) হোল্ডিং ট্যাক্স ও নাগরিক সেবা সম্পর্কে জনসাধারণকে সহায়তা করছে। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, ওয়ারিশ সনদসহ ইউনিয়নের যাবতীয় কার্যাবলী প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়া জেলা শিক্ষা অফিস, প্রাথমিক শিক্ষা অফিস, সমবায় তাদের নিজস্ব কার্যাবলী দর্শনার্থীদের প্রদর্শন করেছে।
পুরো মেলার আয়োজনে ছিল চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। তাদের দেয়া তথ্যমতে, মেলায় সরকারের ২০টি প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে। মেলার স্টল থেকে সরাসরি নাগরিকদের বিভিন্ন ধরনের সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ মেলা থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্স, পাসপোর্টের আবেদন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্তির আবেদন, অনলাইনে জিডি করা, ই-মিউটেশন, জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, কোভিডের টিকা কার্ড সংশোধন, সিটি কর্পোরেশনের হোল্ডিং ট্যাক্স প্রদান, ট্রেড লাইসেন্স এর আবেদন ও নবায়ন, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের সকল সেবাসমূহ সরাসরি প্রদানের ব্যবস্থা রাখা হয়।
জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, হয়রানি রোধ ও সরকারি সেবা কীভাবে সহজীকরণ করা হয়েছে তা জনগণকে জানান দেয়ার জন্য সরকারের কর্মচারীরা সারাদেশে ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলার আয়োজন করেছে। তাই জনগণের কাক্সিক্ষত সেবা নিশ্চিত করতে হলে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে তাঁরই সুযোগ্য পুত্র প্রধানমন্ত্রীর তথ্য বিষয়ক উপদেষ্টা সজিব ওয়াজেদ জয়ের নিরলস প্রচেষ্টায় তথ্য প্রযুক্তিতে দেশ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এ প্রজন্মের সন্তানেরা ডিজিটালাইশেনের যুগে মেধা ও দক্ষতাকে কাজে লাগাতে পারলেই ২০৪১ সালের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের উন্নত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে।
মেলার সমাপনী অনুষ্ঠান
এম এ আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন জিমনেসিয়ামে আয়োজিত দুই দিনব্যাপী ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলার গতকাল মঙ্গলবার সমাপনী ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবায়নে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। বিগত ২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে প্রধানমন্ত্রী এদেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত, সুখী-সমৃদ্ধশালী ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ২০০৯ সালে তিনি ক্ষমতায় এসে সেবা জনগণের দৌরগোড়ায় পৌঁছে দিতে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারকে ঢেলে সাজিয়েছেন। তথ্য প্রযুক্তির কারণে মানুষ ঘরে বসেই তাদের যাবতীয় কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছে। এখন আমাদের স্বপ্ন স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার। এজন্য সরকারের সকল দপ্তরকে সেবার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।