সেনাবাহিনীর সাথে অদৃশ্য বিরোধই ইমরানের পতনের মূল কারণ

7

পূর্বদেশ ডেস্ক

অনেক নাটকীয়তার পর মধ্যরাতে পার্লামেন্টে হওয়া আস্থাভোটে হেরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্বের গদি হারাতে হল ইমরান খানকে। আরও একবার মেয়াদ শেষ করতে না পারা এক প্রধানমন্ত্রীকে দেখল দেশটি। ২০১৮ সালে যিনি ‘দুর্নীতিমুক্ত নয়া পাকিস্তানের’ স্বপ্ন দেখিয়ে মসনদে বসেছিলেন; তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দলের শীর্ষনেতা সেই ইমরানকে রোববার রাজনীতির খেলায় হেরে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হল।
পাকিস্তানে কোনো প্রধানমন্ত্রীই কখনো পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। তবে ইমরানকে দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি সম্ভবত তা পারবেন।
ইমরানের সরকার পাকিস্তানে সুশাসনের উন্নতির বিষয়ে জোর দিয়েছিল। সামাজিক কল্যাণ ব্যবস্থার সম্প্রসারণে দারুণ কিছু কাজ করেছেন ইমরান। উদাহরণ হিসেবে পাকিস্তানের একটা বড় অংশে স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্প চালুর কথা বলা যায়।
তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে ইমরান হোঁচট খান। যেমন দেশটির সবচেয়ে জনবহুল প্রদেশ পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীর মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে একজন অনভিজ্ঞ ও অযোগ্য রাজনৈতিক নবাগতকে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। তার এ সিদ্ধান্ত ব্যাপকভাবে সমালোচনা ও উপহাস কুড়ায়।
ইমরানের আরও অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। তার শাসনামলে পাকিস্তানে জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়েছে। খাদ্যপণ্যের দাম লাগামহীন হয়েছে। ডলারের বিপরীতে পতন ঘটেছে পাকিস্তানি রুপি।
ইমরানের সমর্থকেরা এ পরিস্থিতির জন্য বৈশ্বিক অবস্থাকে দায়ী করেন। কিন্তু এ কথা সত্য, পাকিস্তানে ইমরানের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ বাড়ছিল।
একসময় ইমরানের বিরোধীরা সেনাবাহিনীর বিরোধিতায় ক্রমশ সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন। তারা এমনকি সেনাবাহিনীর কর্তাব্যক্তিদের নাম ধরে ধরে বলতেন, কে কে ইমরানকে ক্ষমতায় এনেছেন।
কিন্তু পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে গত বছর। বেশ কয়েকজন পর্যবেক্ষক বলেছেন, সুশাসন দিতে ইমরানের ব্যর্থতা, বিশেষ করে পাঞ্জাবের পরিস্থিতি দেশটির সেনাবাহিনীকে ক্রমশ হতাশ করে। ইমরানকে ক্ষমতায় আনার জন্য তার বিরোধীরা যেভাবে জনসমক্ষে সেনাবাহিনীকে দোষারোপ করে আসছিল, সম্ভবত তা থেকেও বের হতে চাইছিল ‘স্টাবলিশমেন্ট’।
ইমরানের পতনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে কাজ করেছে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া ও আইএসআইয়ের প্রধান লে. জেনারেল ফাইজ হামিদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব। ফাইজ পরবর্তী সেনাপ্রধান হতে আগ্রহী ছিলেন বলে ব্যাপকভাবে কথিত ছিল।
হামিদ স্পষ্টতই তার সেনাপ্রধান হওয়ার সম্ভাবনার ব্যাপারে খুবই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। ফাইজ প্রতিবেশী আফগানিস্তানের কর্মকর্তাদের আগেই বলেছিলেন, তিনি সেনাবাহিনীর দায়িত্ব পেতে যাচ্ছেন।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র বলেছে, হামিদকে এমন একজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা হিসেবে দেখা হচ্ছিল, যিনি নোংরা কাজগুলো কার্যকরভাবে করতে পারতেন। যেমন রাজনীতিবিদদের বশে আনা কিংবা সমালোচকদের মুখ বন্ধ করা। কিন্তু তাকে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি হিসেবে দেখা হয়নি।
বাজওয়া ও ফাইজের মধ্যকার বিরোধ গত অক্টোবরে তীব্র আকার ধারণ করে। এর বিরোধী ইমরানও জড়ান। বাজওয়া আইএসআইয়ের প্রধান হিসেবে নতুন একজনকে চাইছিলেন। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এ দায়িত্ব পরিবর্তনের ঘোষণা দেওয়া হয়।
অন্যদিকে ফাইজের সঙ্গে ইমরান ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। তিনি দৃশ্যত আগামী জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত তাকে দায়িত্বে রাখতে চেয়েছিলেন। ধারণা করা হচ্ছিল, ফাইজ আবার ইমরানের বিজয় নিশ্চিতে সাহায্য করতে পারেন।
পাকিস্তানের নিয়ম অনুযায়ী, সেনাপ্রধানের পরামর্শ মেনে আইএসআইয়ের প্রধান পদে নিয়োগ দেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু আইএসআইয়ের প্রধান পদে সেনাপ্রধানের পছন্দের ব্যক্তিকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়োগ দিতে ইমরান বিলম্ব করছিলেন। সেনাবাহিনী ও ইমরান সরকারের মধ্যকার সম্পর্কের এ দৃশ্যমান ফাটল বিরোধীদের উৎসাহিত করে।
বিরোধীরা যখন অনাস্থা ভোটের পরিকল্পনা শুরু করে, ইমরানের দল ও জোটের মিত্রদের থেকে সাংসদদের সম্ভাব্য পক্ষত্যাগের বিষয়ে বলতে থাকে, তখন বেশ কয়েকটি সূত্র গণমাধ্যমকে বলে, সামরিক বাহিনী বিষয়টি স্পষ্ট করে দিয়েছে, তারা এবার ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থান নিতে যাচ্ছে।
ইমরানের দলের একজন পক্ষত্যাগী সদস্য বলেছেন, ফাইজ আইএসআইয়ের প্রধান থাকাকালে তিনি ও অন্য সাংসদেরা সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাটির কাছ থেকে ফোন পেতেন। তাদের কী করতে হবে, সে বিষয়ে গোয়েন্দা নির্দেশনা দিতেন। তাদের নিয়ে টানাহেঁচড়া করা হতো। আইএসআইয়ের প্রধান পদ থেকে ফাইজকে সরিয়ে দেওয়ার পর এ ধরনের ফোনকল বন্ধ হয়। এখন আর সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করছে না।
ইমরান বারবার অভিযোগ করে আসছেন, পাকিস্তানের শাসনক্ষমতায় পরিবর্তন আনতে একটি বিদেশি রাষ্ট্রের (যুক্তরাষ্ট্র) নেতৃত্বাধীন ষড়যন্ত্রের শিকার তিনি। কারণ হিসেবে তিনি তার সরকারের পশ্চিমাবিরোধী পররাষ্ট্রনীতির কথা বলেন। তবে বেশির ভাগ বিশ্লেষক এ অভিযোগকে ‘অতিরঞ্জন’ বলে নাকচ করেন।
ইমরানের সঙ্গে বাজওয়ার দ্বৈরথ ফের প্রকাশ পায় রাশিয়া-ইউক্রেইন ইস্যুতেও। ফেব্রæয়ারির শেষ সপ্তাহে রাশিয়া যেদিন ইউক্রেইনে হামলা চালায়, ঘটনাচক্রে সেদিনই রাশিয়ায় নেমেছিলেন ইমরান।
পশ্চিমা অনেক দেশ ইউক্রেইনে হামলায় রাশিয়াকে দোষী বললেও, ইমরান সে পথে হাঁটেননি। রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞায়ও শামিল হননি।
কয়েকদিন আগে বাজওয়া বলেছেন, ইউক্রেইনে রাশিয়ার হামলা এখনই বন্ধ হওয়া উচিত। ততদিনে অবশ্য পার্লামেন্টে ইমরানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব তুলেও ফেলেছে বিরোধীরা। ইমরানের জোটে ভাঙনও সৃষ্টি হয়েছে, তার দলের অনেকেও তার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে গেছেন।
আস্থাভোটে নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে দাঁড়িয়ে ইমরান যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার চক্রান্তের অভিযোগ তোলেন। ওই অভিযোগের উপর ভিত্তি করে পার্লামেন্টের ডেপুটি স্পিকার অনাস্থা প্রস্তাবটি বাতিলও করে দিয়েছিল। তারপর ইমরানের আহব্বানে সাড়া দিয়ে প্রেসিডেন্ট পার্লামেন্টও ভেঙে দেন।
এর বিরুদ্ধে বিরোধীরা সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হলে পাশার দান উল্টে যায়। চারদিনের শুনানি শেষে সুপ্রিম কোর্ট পার্লামেন্ট পুনর্বহাল করতে এবং সেখানে আস্থাভোট সম্পন্ন করতে বলে।
নির্ধারিত সময়ে পার্লামেন্ট শুরু হলেও অধিবেশন বারবার মুলতবি, সুপ্রিম কোর্টের আদেশ রিভিউয়ের চেষ্টায় শনিবার একের পর এক নাটকীয় পরিস্থিতির অবতারণা ঘটে। স্পিকারের পদত্যাগের পর মধ্যরাতে আস্থাভোট অনুষ্ঠিত হয়, যাতে হার মানতে হয় পিটিআই প্রধানের। এই হারের পর তিনি ‘কোণঠাসা বাঘের মতো’ লড়তে সক্ষম হবেন কিনা, সময়ই তার উত্তর দেবে।

পরিবর্তিত দৃশ্যপটে শাহবাজ?
এদিকে ইমরান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দেশটির পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যার নাম সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছে, তিনি পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) সভাপতি শাহবাজ শরিফ।
শাহবাজ শরীফ এবং পিটিআইয়ের শাহ মাহমুদ কোরেশি প্রধানমন্ত্রী পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। আজ প্রধানমন্ত্রী পদে নির্বাচন হবে। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে শাহবাজ শরীফ বলেন, জাতীয় সম্প্রীতিই হবে তার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। পিএমএল-এন নেতা বলেন, তিনি বিরোধী নেতাদের সঙ্গে পরামর্শের পরে একটি নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করবেন। তারা একটি নতুন যুগের সূচনা করবেন।
শনিবার মধ্যরাতে দিকে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে অনাস্থা ভোটে হেরে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারিত হন ইমরান খান। জাতীয় পরিষদের ১৭৪ জন সদস্য তার প্রতি অনাস্থা জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতাচ্যুত করতে বিরোধীদের প্রয়োজন ছিল ১৭২ ভোট। ফলাফলে নিশ্চিত হয় ইমরান খানের বিদায়। সূত্র : বিবিসি, বিডিনিউজ।