সেকালের এম বি ডাক্তার ও পটিয়ার প্রিয়দর্শন চৌধুরী

132

ডাক্তারদের নানা রকম উপাধি হয়। যেমন এমবি, এমবিবিএস, এলএমএফ। এমবি ডাক্তার হতেন সেকালে- ব্রিটিশ জমানায়। তখন কলকাতা আর চট্টগ্রাম একদেশ। আর ডাক্তারি পড়ার প্রতিষ্ঠান ছিলো সবে ধন নীলমণি ওই একটাইÑ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ। সেই কলেজ থেকে যারা পাস দিয়ে বেরোতে পারতো-তাদের নামে ধন্য ধন্য পড়ে যেতো। কারণ পাসটি বড় কঠিন ছিলো তখন, তাই তাদের পাসের মূল্য ছিলো। ১৯১৬ সালে জেনারেল হাসপাতালের পাহাড়ে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল স্কুল প্রতিষ্ঠিত হবার পর এদিকের ছেলেরা পানির জাহাজে চড়ে কষ্ট করে কলকাতা না গিয়ে ঘরের কাছের স্কুলে পড়া শুরু করলো। চিটাগাং মেডিক্যাল স্কুল থেকে যারা পাস করতো, তাদের উপাধি হলো-এলএমএফ।


৫৭ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হলো, ঢাকা আরো আগে। পাকিস্তানি জমানায় মেডিক্যাল কলেজ থেকে যারা পাস করতো, তাদের ডিগ্রির নাম হলো এমবিবিএস। ওদিকে ষাটের দশকের মাঝামাঝি কি শেষের দিকে মিটফোর্ডে কনডেন্সড কোর্স করে এলএমএফদেরও এমবিবিএস হওয়ার সুযোগ দেয়া হলো। এই ডাক্তারি বিদ্যা ঘরানায় এমবিরা হতেন কুলীন। খুব নামডাক হতো তাদের। তখন কলকাতা যেতে হতো পানির জাহাজে করে। এখন যেমন রিজেন্ট এয়ারে ওঠে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে কলকাতায় নামা পানি ভাত, তখন এতো সহজ ছিলো না। দু’তিন দিন লেগে যেতো কলকাতায় নামতে।
সেকালে চট্টগ্রামে তিনজন এমবি পাস ডাক্তারের নাম কিংবদন্তীর ন্যায় ছড়িয়ে পড়েছিলো। এমবি-ত্রয়ীর নাম-ডাক্তার এমএ হাশেম, ডাক্তার ওমর, ডাক্তার আবদুল জব্বার। ডাক্তার হাশেম মানবতাবাদী চিকিৎসক ছিলেন। সম্পর্কও ছিলো তাঁর কমিউনিস্ট পার্টির সাথে। কাহার পাড়ায় ইংরেজ সৈন্যদের অত্যাচারে বিপন্ন মানুষের সাহায্যে কমিউনিস্ট পার্টি লঙ্গরখানা খুললে ডাক্তার হাশেম সেখানে বিনা পয়সা চিকিৎসা সেবা দিয়েছিলেন। নামমাত্র ফি-তে তিনি মানুষের চিকিৎসা করতেন। সেই নামমাত্র ফিও কেউ দিতে না পারলে ডাক্তার সাহেব বিনা ফিতেই তার চিকিৎসা করতেন। তাঁর কাছে চিকিৎসার জন্য গিয়ে কাউকে টাকার জন্য ফিরে আসতে হয়নি। ডাক্তার হাশেমের এক ছেলেও ডাক্তার হয়েছিলেন। তাঁর এক পুত্র কাঞ্চন ভাই প্রসিদ্ধ সমাজকর্মী। হাশেম সাহেব রাউজানের অধিবাসী।
ডাক্তার ওমর আবার একটি পত্রিকা প্রকাশ করে খ্যাতিমান হন। পত্রিকার নাম ‘সত্যবার্তা’। প্রচার যা-ই হোক না কেন, পত্রিকাটার সম্পাদক কিন্তু কৃতবিদ্য মানুষ ছিলেন। আমার ভুল হতে পারে, সম্ভবত তাঁর নাম ছিলো গোলাম সোবহান। মাস্টার মানুষ, সাতকানিয়ার অধিবাসী ছিলেন। ডা. ওমরের পুত্র ডা. এএফএম ইউসুফও প্রসিদ্ধ ডাক্তার হয়েছিলেন। তাঁর নাতিও বড়ো ডাক্তার। ডা. ইউসুফ শেষ জীবনে বিএনপির রাজনীতিতে যোগ দিয়ে রাষ্ট্রদূত হয়েছিলেন। ডা. ওমর ছিলেন হাটহাজারীর অধিবাসী।
ডা. জব্বারও সুখ্যাত সমাজকর্মী ছিলেন। একমাত্র তাঁর পুত্রকন্যার মধ্যে কেউ ডাক্তার হননি। তাঁর এক পুত্র গাজী সালাউদ্দিন ব্যাংকার হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তাঁর জামাতা মেজর জেনারেল আবদুল মতিন তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। ডাক্তার জব্বার পটিয়া থানার অধিবাসী।
শহরে যেমন এই তিন, পটিয়ায়ও একজন এমবি ডাক্তার ছিলেন। তাঁর নাম প্রিয়দর্শন চৌধুরী। আদতে তিনি বড়–য়া, চৌধুরী কুলবাচী শব্দ। বয়সে তিনি উপর্যুক্ত ত্রয়ীর পরবর্তীই হবেন, তবে ডাক্তারি শাস্ত্র তিনি অধ্যয়ন করেছিলেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে। তারপর তিনি পিএইচডি করার জন্য দিল্লি যান। দিল্লির ভারত-বিখ্যাত অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেস-এ পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি কোর্সে অধ্যয়নরত অবস্থায় একদিন গ্রাম থেকে মায়ের চিঠি পেলেন প্রিয়দর্শন চৌধুরী। মা লিখেছিলেন, দিল্লিতে যতটুকু পড়ার পড়েছ, এবার তোমার গ্রামে ফিরে এসো। তোমাকে এমবি পড়িয়েছি গ্রামের মানুষের চিকিৎসা করার জন্য। বিদ্যসাগর যেমন মাতৃ আজ্ঞা পালনের জন্য অন্ধকার দুর্যোগপূর্ণ রাত্রিতে উত্তাল দামোদর নদী সাঁতরে পার হয়েছিলেন; মাতৃভক্ত প্রিয়দর্শনও তেমনি মাতৃআজ্ঞা পেয়ে তা’ পালনের জন্য অবিলম্বে দিল্লির পড়াশোনার পাট চুকিয়ে স্বগ্রাম বাকখালী চলে এসেছিলেন।
সেটা ১৯৫৭ সালের কথা। বাকখালী তখন অত্যন্ত পশ্চাদপদ একটি গ্রাম। সেখানে কোন ডাক্তার ছিলো না। রোগে শোকে ভুগে ভুগে মৃত্যুর হাতে অসহায় আত্মসমর্পণই ছিলো গ্রামবাসীর অনিবার্য নিয়তি। মায়ের আদেশে ডা. প্রিয়দর্শন চৌধুরী স্বগ্রামে প্রত্যাবর্তন করে যখন রুগ্ন, পীড়িত মানুষের চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত হলেন, তখন গ্রামবাসীর কাছে মনে হলো স্বর্গ থেকে কোন দেবদূত ধরাধামে নেমে এসেছেন তাদেরকে রোগব্যাধির হাত ধেকে বাঁচাতে। কিছুদিন যেতে না যেতে ডাক্তার চৌধুরীর নাম বাকখালী থেকে সরল, ঠৈগরপুনি প্রভৃতি আশেপাশের গ্রামেও ছড়িয়ে পড়লো। সেসব গ্রাম থেকেও তাঁর ডাক আসতে লাগলো। কেউ বলে ‘বড়–য়া ডাক্তার’, কেউ ‘এমবি ডাক্তার’। শেষদিকে এমবি ডাক্তার নামটাই চাউর হয়ে গেলো। এবং সেই পরিচিতিটাই স্থায়ী হয়ে গেলো। গোটা পটিয়াতে তখন কোন এমবি ডাক্তার ছিলো না। ফলে এমবি প্রিয়দর্শন চৌধুরীর কথাই তখন সর্বত্র আলোচিত হচ্ছে এবং রোগব্যাধি দেখা দিলে তাঁর ডাক পড়ছে। ততদিনে তিনি বাকখালী থেকে পটিয়া সদরে গিয়ে তাঁর চেম্বার খুলেছেন। পরে সপরিবারে নিজেও থাকা শুরু করেন সেখানে। পটিয়ার চেম্বারে বসে প্রায় অর্ধশত বছর পটিয়ার মানুষের চিকিৎসা করেছেন তিনি। ধনী-গরীব, ছোট-বড়, হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, নারী-শিশু বৃদ্ধ নরনারী সকলেই তাঁর রোগী।
তাঁর কাছে রোগীর পরিচয় মানুষ। নির্ধারিত ফি একটা তাঁর ছিলো। কিন্তু তার ওপর স্থির থাকতেন না। কেউ কম দিলেও নিতেন, নাই বললেও ব্যবস্থাপত্র লিখে দিতেন। এমনই জনদরদী চিকিৎসক ছিলেন ডা. প্রিয়দর্শন চৌধুরী। জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে মানুষের সেবা করেছেন বলেই মানবতাবাদী চিকিৎসক হিসেবে তিনি সুখ্যাতি লাভ করেন। মানবসেবার পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক স্বৈরশাসক আইয়ুবের বিডি নির্বাচনে জনগণের উৎসাহে তাঁকে একবার নির্বাচনে অবতীর্ণ হতে হয়েছিলো। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত পরিবেশে তাঁর মতো একজন নিরীহ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর বিডি নির্বাচিত হওয়ার কথা ছিলো না। কারণ তাঁর অর্থ ছিলো না, পোষা মাস্তানও ছিলো না। কিন্তু মানুষই ভালোবেসে তাঁর ভোটের বাক্স ভরিয়ে দিয়েছিলো, তিনি বিপুল ভোটে জয়লাভ করে ১৯৬৪ সালে ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন।
সমাজকর্মেও তিনি দক্ষতার প্রমাণ দেন। এলাকার রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ ও পুনঃনির্মাণে, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে তিনি অনেক অবদান রাখেন। এ সময় সালিশ বিচার করতে গিয়ে ন্যায় বিচারক হিসেবে তিনি বেশ সুনামের অধিকারী হন। সামাজিক নানা কর্মে তাঁর হিতৈষণার বহু প্রমাণ তিনি রেখে গেছেন। যেমন তাঁর উদ্যোগে বাকখালীতে ‘সাধনানন্দ বৌদ্ধ বিহার’ এবং পটিয়া পৌরসভায় বৌদ্ধদের একমাত্র ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ‘পটিয়া কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ বিহার ও কল্যাণ প্রকল্প’ গৃহীত হয়। সকলের ইচ্ছা ও সম্মতিতে তাঁকে প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্ব প্রদান করা হয়। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রতিষ্ঠান দুটি গড়ে ওঠে এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সভাপতি হিসেবে সুচারুরূপে তাঁর দায়িত্ব পালন করে যান তিনি।
শুধু যশস্বী চিকিৎসক নন, ডা. প্রিয়দর্শন চৌধুরী পটিয়া শহরের একটি উজ্বল আলোকস্তম্ভস্বরূপ ছিলেন। পটিয়ার সমাজ সংগঠনের যেমন তিনি ছিলেন মাথা, তেমনি তাঁকে পটিয়ার সাহিত্য, সংস্কৃতি, খেলাধূলা প্রভৃতি সৃজনশীল কর্মযজ্ঞের প্রাণপুরুষ বা পথিকৃৎ বললেও অত্যুক্তি হয় না। চিকিৎসার মতো গদ্যময় নীরস শাস্ত্র যাঁর অধ্যয়ন, গবেষণা ও চর্চার বিষয়বস্তু ছিলো, তাঁর মধ্যে কিভাবে এত প্রাণশক্তি, রস, উদ্যম, স্পৃহা লুকিয়ে থাকতো, যাঁরা তাঁকে দেখেন নি, তাঁদের পক্ষে তা’ বিশ্বাস করা মুস্কিল। নাট্যাভিনয়ে, নৃত্যানুষ্ঠানে, গানের জলসায়, সাহিত্য আড্ডায়, দাশর্নিক আলোচনায় ডা. প্রিয়দর্শন চৌধুরীর উপস্থিতি ছিলো অনিবার্য। খেলাধূলার সংগঠক যেমন ছিলেন, তেমনি ফুটবল খেলায় বাঁশি নিয়ে রেফারিগিরি করতেও যেতেন। পটিয়া ক্লাব ও পটিয়া অফিসার্স ক্লাবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন তিনি। দুটি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কাজে তাঁর প্রাণবন্ত উপস্থিতি ছিলো অপরিহার্য।
ষাটের দশকে আইয়ুবের একনায়কত্বকালীন সময়ে এবং আশির দশকে নব্য স্বৈরাচার এরশাদের দুঃশাসনের সময়ে পটিয়ার অমাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের তীর্থ হয়ে উঠেছিলো এমবি ডাক্তারের চেম্বার। পটিয়ায় প্রগতিশীল বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার অনুঘটক ছিলেন ডা. চৌধুরী। মাতৃভাষা বাংলা ছাড়াও ইংরেজি, হিন্দি ও বর্মী ভাষাতেও তিনি বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তাঁর তী² মেধা, সুগভীর জ্ঞান ও পাÐিত্যের জন্য তাঁকে ‘চলমান বিশ্বকোষ’ মনে করা হতো।
ডা. প্রিয়দর্শন চৌধুরী ১৯২১ সালে পটিয়া থানার বাকখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা বরদা চরণ চৌধুরী বড়–য়া বার্মার একজন প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি রেঙ্গুন চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ছিলেন। তাঁর মাতার নাম বিন্দুবাসিনী বড়–য়া।
ডা. প্রিয়দর্শনের পিতামহের নাম রাজচন্দ্র, প্রপিতামহ লোকমান জমিদার, প্রপিতামহের পিতা উদয়চাঁদ জমিদার। বংশের আদি পুরুষ হিসেবে উদয়চাঁদের কথাই জানা যায়। তবে আদি পুরুষ এবং তাঁর পুত্র লোকমান জমিদার রাঙ্গুনিয়ার রাজানগরের অধিবাসী ছিলেন। রাজা নগর চাকমা রাজ্যের আদি রাজধানী। উদয়চাঁদ এবং লোকমান সম্ভবত চাকমা রাজদরবারে চাকরি করতেন। মনে করা হয় তাঁরা দেওয়ান ছিলেন। তখন চাকমা রাজারাও মুসলিম নাম গ্রহণ করেছিলেন। চাকমা রাণী কালিন্দী দেবীর সঙ্গে প্রিয়দর্শন চৌধুরীর পূর্ব পুরুষের আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিলো। রাজচন্দ্রের আমলে পরিবারটি রাঙ্গুনিয়া থেকে পটিয়া থানার বাকখালী গ্রামে বসতি স্থাপন করে।
ডা. প্রিয়দর্শন চৌধুরী ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের বিশিষ্ট নায়ক, জ্ঞান তাপস পটিয়া থানার সতরপেটুয়া গ্রামের অধিবাসী অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ বড়–য়ার কন্যা শালীনতা চৌধুরীর পাণি গ্রহণ করেন। এই বিয়ে হয়তো ডা. চৌধুরীর প্রগতিশীল মানস গঠনে সহায়ক হয়ে থাকবে। উত্তরকালে আমরা যে ¯িœগ্ধ, রুচিবান, সাহিত্য অনুরাগী, সংস্কৃতিমনা, মুক্তচিন্তক, অসাম্প্রদায়িক, উদার মানবাতাবাদী ডা. চৌধুরীর সাক্ষাৎ পাই, তা’ হয়তো অধ্যাপক বড়–য়ার আলোকপ্রাপ্ত পরিবারের সঙ্গে সম্বন্ধ স্থাপিত হওয়ার ফলেই সম্ভব হয়েছিলো।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জীবনের একট অনন্যসাধারণ ঘটনা, যার সঙ্গে তুলনা করা যায় এমন আর একটি ঘটনা বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস খুঁজলেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আপামর বাঙালির ন্যায় ডা. চৌধুরীও এই ঘটনার দ্বারা আন্দোলিত হয়েছিলেন এবং যুদ্ধে তাঁর পক্ষে সম্ভব সব কিছু দিয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
স্থানীয় যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে যেতে উৎসাহিত করেছেন তিনি, মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে খবর বিনিময় করতেন, পাক-বাহিনী ও দালালদের গতিবিধি সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আগাম সর্তকবার্তা পৌঁছে দিতেন। এদিকে থেকে বিচার করলে তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের একজন বিশিষ্ট সংগঠক রূপে চিহ্নিত করা চলে। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দান, ওষুধ, খাবার ও অন্যান্য রসদপত্র সরবরাহ করা-এসব কাজ যিনি মুক্তিযুদ্ধের আরম্ভ থেকে বিজয় পর্যন্ত ক্লান্তিহীনভাবে করে গেছেন, তিনি অবশ্যই একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে প্রতিরোদ যুদ্ধ চলাকালে কালুরঘাট যুদ্ধে আহত ক্যাপ্টেন হারুন আহমদ চৌধুরীকে পটিয়া আনা হলে প্রাথমিকভাবে তাঁর শরীরে অস্ত্রোপচার ও চিকিৎসা প্রিয়দর্শন বাবুই করেন।
ডা. চৌধুরী আজ আমাদের মধ্যে নেই কিন্তু তিনি একটি আলোকিত প্রজন্ম, উজ্জ্বল উত্তরাধিকার রেখে পেছন, যারা আজ আমাদের সমাজ, রাষ্ট্রকে, এই গ্রহকে তাদের জ্ঞান ও প্রদীপ্ত মনীষা দিয়ে আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে উদ্ভাসিত করে তুলছেন।
ডা. প্রিয়দর্শন চৌধুরী দুই পুত্র ও তিন কন্যার গর্বিত জনক। তাঁর আত্মজ ও আত্মজারা হচ্ছেনÑ
প্রথম কন্যা, শ্যামলী বড়–য়া-তাঁর স্বামী প্রভাস রঞ্জন বড়–য়া-অ্যাডিশনাল ইন্সপেক্টর জেনারেল অব রেজিষ্ট্রেশন হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
দ্বিতীয় পুত্র, ড. শ্যামল বিকাশ চৌধুরী-পানি বিশেষজ্ঞ হিসেবে আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান, বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘে কাজ করেন। ক্যালিফোর্নিয়ায় বসবাসরত।
তৃতীয় কন্যা, অঞ্জলী চৌধুরী-স্বামী সুশীল বড়–য়া। সুশীল বাবু বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিক, স্বাধীনতা সংগ্রামী, সংগঠক।
চতুর্থ কন্যা, রূপালী বড়–য়া- বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান বার্জার পেইন্টস-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনিই প্রথম নারী, যিনি এই বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানের এমডি পদ অলংকৃত করেছেন। এছাড়া তিনি দু’বার ফরেন ইনভেস্টরস ফোরামের সভাপতি ছিলেন। তাঁর স্বামী আবদুল হকও একটি ও এর প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা। তিনিও একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। পঞ্চম পুত্র, কমল চৌধুরী-ব্যবসায়ী।
ডা. চৌধুরীর পিতা রেঙ্গুনে বসবাস করতেন সেকথা আগেই বলা হয়েছে। তাঁর জন্ম হয় রেঙ্গুনে এবং ৫ বছর বয়সে বাবার সাথে রেঙ্গুনের বেঙ্গল একাডেমী স্কুলে তাঁর শিক্ষা জীবনের শুরু। ১৯৩৯ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৪১-এ রেঙ্গুন ইউনিভার্সিটি কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে আই.এসসি পাশ করেন। ১৯৪৫ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি.এসসি পাস করেন। ১৯৫১ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে এম.বি.বি.এস পাস করে রেঙ্গুন মেন্ডালি মেডিকেলে কিছুদিন চাকরি করেন। ষাট থেকে আশির দশক পর্যন্ত তিনি পটিয়া সোনালী ব্যাংক এবং বিএডিসির মেডিক্যাল অফিসার ছিলেন। পটিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় জীববিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন।
২০০৭ সালের ২৯ এপ্রিল এই মানবতাবাদী চিকিৎসক মহান পুরুষের বর্ণময় জীবনের উপর যবনিকা নেমে আসে। ডা. প্রিয়দর্শন চৌধুরীর স্মৃতির প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সিনিয়র সাংবাদিক