সেই ডিসিকে দায়মুক্তি

12

মধ্যরাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় আলোচিত কুড়িগ্রামের সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীনকে শাস্তি থেকে রেহাই দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সুলতানা পারভীনের বেতন বৃদ্ধি দুই বছরের জন্য স্থগিত রাখার যে ‘লঘুদন্ড’ সাড়ে তিন মাস আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় দিয়েছিল, তা বাতিল করে অভিযোগের দায় থেকেও তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
ওএসডি হয়ে থাকা উপসচিব পদমর্যাদার এই কর্মকর্তার শাস্তির আদেশ এসেছিল গত ১০ আগস্ট এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে। সেই প্রজ্ঞাপন বাতিল করে গত ২৩ নভেম্বর আরেকটি প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, সেখানেই সুলতানা পারভীনের শাস্তি বাতিলের বিষয়টি জানানো হয়।
জ্যেষ্ঠ সচিব কে এম আলী আজম স্বাক্ষরিত ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘যেহেতু মোছা. সুলতানা পারভীন তার উপর অরোপিত উল্লিখিত লঘুদন্ডাদেশ মুওকুফের জন্য গত ৬ সেপ্টেম্বর মহামান্য রাষ্ট্রপতির সমীপে আপিল আবেদন পেশ করলে মহামান্য রাষ্ট্রপতি সদয় হয়ে মোছা. সুলতানা পারভীনের আপিল আবেদন বিবেচনা করে পূর্বে প্রদত্ত দুই বছরের জন্য ‘বেতন বৃদ্ধি স্থগিত রাখা’ নামীয় দন্ডাদেশ বাতিল করে তাকে অভিযোগের দায় হতে অব্যাহতি প্রদান করেছেন। সেহেতু মোছা. সুলতানা পারভীন, প্রাক্তন জেলা প্রশাসক, কুড়িগ্রাম, বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (উপসচিব), জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়- এর বিরুদ্ধে রুজুকৃত বিভাগীয় মামলায় দুই বছরের জন্য বেতন বৃদ্ধি ‘স্থাগিত রাখা’ নমনীয় লঘুদন্ড প্রদান করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গত ১০ আগস্টের প্রজ্ঞাপনটি বাতিলপূর্বক তাকে অভিযোগের দায় থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হলো’। খবর বিডিনিউজের
বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম রিগানকে গত বছর ১৩ মার্চ গভীর রাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে মাদক রাখার অভিযোগে এক বছরের কারাদন্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত।
কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমা ওই অভিযান পরিচালনা করেন। কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী কমিশনার নাজিম উদ্দিন এবং সহকারী কমিশনার এস এম রাহাতুল ইসলামও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
কুড়িগ্রামের ওই সময়কার ডিসি সুলতানা পারভীনের নির্দেশেই আরিফুল ইসলামকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা দেওয়া হয় বলে আরিফুলের পরিবারের অভিযোগ করেন।
বিসিএস ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তা সুলতানা কুড়িগ্রাম শহরের একটি সরকারি পুকুর সংস্কারের পর নিজের নামানুসারে ওই পুকুরের নাম ‘সুলতানা সরোবর’ রাখতে চেয়েছিলেন জানিয়ে বাংলা ট্রিবিউনে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন রিগান। ওই প্রতিবেদন প্রকাশের ১০ মাস পর জেলা প্রশাসন আরিফুলের বাড়িতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে তাকে সাজা দেয়।
ওই ঘটনা তুমুল সমালোচনার জন্ম দেয়, বিষয়টি হাই কোর্টেও গড়ায়। পরে রিগানকে জামিন দেয় কুড়িগ্রামের আদালত।
মুক্তি পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন রিগান। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘হাত ও চোখ বাঁধা’ অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার পর তাকে ‘বিবস্ত্র করে অমানুষিক নির্যাতন’ করা হয়। চোখ বেঁধে তার কাছ থেকে স্বাক্ষরও নেওয়া হয়।
তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার পর ডিসি সুলতানা পারভীন, আরডিসি নাজিম উদ্দিন, সহকারী কমিশনার রিন্টু বিকাশ চাকমা ও এস এম রাহাতুল ইসলামকে কুড়িগ্রাম থেকে সরিয়ে দেয় সরকার।
পরে, ২০২০ সালের ১৯ মার্চ ডিসি সুলতানা পারভীন, সাবেক তিনজন সহকারী কমিশনারসহ ৩৫-৪০ জনের বিরুদ্ধে কুড়িগ্রাম সদর থানায় অভিযোগ দায়ের করেন সাংবাদিক আরিফুল। হাই কোর্ট ওই অভিযোগ মামলা হিসেবে রেকর্ডের নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালতে তাকে দেওয়া সাজা স্থগিত করে। এর পর ২৬ মার্চ সুলতানা পারভীনসহ তার কার্যালয়ের সাবেক তিনজন সহকারী কমিশনারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়।
সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালায় ‘অসদাচরণ’ এর অভিযোগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ‘কারণ দর্শাও’ নোটিস দিলে সুলতানা পারভীন লিখিত জবাব দাখিল করে ব্যক্তিগত শুনানি চান। ওই বছরের ৯ আগস্ট শুনানিতে হাজির হয়ে তিনি যে মৌখিক বক্তব্য ও লিখিত জবাব দেন, তা ‘সন্তোষজনক বিবেচিত না হওয়ায়’ বিভাগীয় মামলাটি তদন্তের জন্য তদন্ত বোর্ড গঠন করা হয়।
ওই তদন্ত বোর্ডের আহ্বায়ক ছিলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আলী কদর। বোর্ডের প্রতিবেদনে বলা হয়, সুলতানা পারভীনের বিরুদ্ধে ‘অসদাচরণের’ অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ২৩ নভেম্বরের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, তদন্ত বোর্ডের প্রতিবেদন এবং অন্যান্য কাগজপত্র পর্যালোচনা করে সুলতানা পারভীনকে গুরুদন্ড দেওয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়। এরপর চলতি বছরের ৮ জুন তাকে দ্বিতীয় কারণ দর্শাও নোটিস দেয় মন্ত্রণালয়।
সুলতানা পারভীন ২২ জুন লিখিতভাবে তার জবাব দেন। সব বিচার-বিশ্লেষণ শেষে ১০ আগস্ট তাকে বেতন বৃদ্ধি দুই বছরের জন্য স্থগিত রাখার ‘লঘুদন্ড’ দেওয়া হয়। সেই লঘুদন্ডের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেছিলেন সুলতানা পারভীন। রাষ্ট্রপতি তা গ্রহণ করে অভিযোগের দায় থেকে তাকে অব্যাহতি দিলেন।
তাহলে কী প্রতিকার পেলাম : রিগান
এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগ্যান বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি যে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। কিন্তু আমি হতাশ। অপরাধটা আমার সঙ্গে হয়েছে, সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আমি। দন্ড বাতিল করার অর্থ হচ্ছে, অপরাধটা আমার সাথে হয়নি। এটা আমি মেনে নিতে পারছি না। তাহলে কী প্রতিকার পেলাম আমি?’ তিনি বলেন, ‘লঘু শাস্তি দেওয়ায় এমনিতেই আমি সংক্ষুব্ধ ছিলাম। সেই লঘু শাস্তিটাও যখন বাতিল হয়ে যায়, তখন আসলে আর কোনো আশার আলো দেখছি না। এটা সাংবাদিক সমাজের জন্য একটি বড় হতাশার বিষয়’।
সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) আইন ও এর বিধিমালা নিয়ে প্রশ্ন তুলে রিগান বলেন, ‘সরকারি কর্মচারীরা লাগামহীনভাবে অপরাধ করবেন, আর শাস্তির বেলায় সে অপরাধ উপেক্ষা করা হবে- আমি মনে করি এ আইন ও বিধি সংবিধান পরিপন্থি। জনগণের টাকায় যাদের বেতন-ভাতা হয়, তারা আইনগত বিশেষ সুবিধা পেলে সেটা সংবিধান পরিপন্থি বলে আমি মনে করি’।