সৃষ্টিশীল কাজে বাধা নয় সাহস ও সহযোগী হতে হবে

35

 

সৃষ্টি শব্দটি সৃষ্টিকর্তাকে ঘিরেই জন্ম। পৃথিবীর, এই বিশ্ব পরিমÐল বিষ্ময়কর সৃজনশীল সৃষ্টি আদিম যুগ থেকেই আসা।মানুষ পৃথিবীতে পা রাখার পর থেকে প্রকৃত অর্থে সভ্যতার অগ্রসর। প্রতিটি আশ্চর্য উৎকর্ষ মেধা মনন আর শারীরিক শক্তির প্রয়োগিক কার্যক্রমই বর্তমান আধুনিক সভ্যতার উত্তরণ। এখন কথা হচ্ছে মানুষ, প্রকৃতি নিদারুণভাবে সভ্যতার সুযোগ সুবিধা ভোগ করে কিন্তু তার কর্মকারকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন দিতে জানে না অনেক সময়। সৃষ্টিশীল, মননশীল কার্যকলাপ তাদের কাছে খেলনার বস্তু, পাগলের উঠোন আর বস্তাপচা আবর্জনার মতো।
পৃথিবীতে তিন স্তরের ভাবনা নিয়ে মানুষ বাস করে-প্রথম স্তরের ভাবনার মানুষজন শুধু নিজের কথা ভাবে, আত্মকেন্দ্রিকতায় চলে। তাদের চেষ্টা থাকে সর্বোচ্চ ভালোটা তারা গ্রহণ করতে পারবে বাকীদের কী হবে তার ভাবার দরকার নাই। এসব মানুষগুলো এই স্বার্থের ভাবনায় জীবন পার করে দেয়। বিনিময়ে সভ্যতা গড়ায় তাদের কোন অবদান লক্ষ্য করা যায় না।বরং অন্যের সৃষ্টি দিয়ে নিজেই সমৃদ্ধ হয়ে লাভ্যাংশটুকু নিয়ে সুযোগ বুঝে কেটে পড়ে। এসব মানুষ মৃত্যুর পর সেখানেই জীবন শেষ। লাল পতাকা উড়ে।
দ্বিতীয় স্তরের ভাবনার মানুষ সারাক্ষণ হা-হুতাশ করে,জীবনের কোন লক্ষ্য তারা স্থির করতে পারে না।অন্যের উপর সর্বদা নির্ভরশীল হয়ে চলার চেষ্টা করে। অনেকটা গা বাচিয়ে বৃষ্টির ঝাপটা থেকে রেহাই পাওয়ার মতো।এসব মানুষের অজুহাত বেশি।কাজের চাপকে দায়িত্ব নয় বরং শাস্তি মনে করে। মন থাকে সবসময় চিন্তাগ্রস্ত আর সংসার বিশ্ব চলা নিয়ে চরম উদাসীন।তবে অন্যের দোষ ত্রুটির চুলচেরা গবেষক তারা। এতে কোন ছাড় নাই।এসব লোক জীবনেও নিজের মন মতো জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখে না। কোন রকম রয়ে সয়ে, অপরের ঘাড়ে মাথা নুয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে পারলেই তাদের বাসনা পূর্ণ। আর কিছুই লাগে না শুধু অন্যের দয়াটুকু দরকার।
তৃতীয় স্তরের ভাবনার মানুষ সবসময় অন্যের চিন্তা করে,কীভাবে নিজের মেধা মননকে কাজে লাগাবে মানুষের কল্যাণ করবে তা ভাবে।তারা ভাবে পৃথিবীতে অনেক মানুষ তার দলে থাকতে হবে। একজন বিজ্ঞ, মেধাবী দিয়ে দুনিয়া চলবে না।সবার মাঝে জ্ঞান, দক্ষতা, উন্নত উদার ভাবনা তৈরি করতে হবে। আর সেই লক্ষ্যে তারা সৃষ্টির যোজনায় সর্বদা মনোনিবেশ করেন। কে কী বল­তার দিকে কর্ণপাত নেই। অনেকেই মনে করে ভাবনার উচ্চ স্তরের মানুষ খুবই অহংকারী।কথাটা ভুল কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া। মানুষ যতই জ্ঞানের উচ্চ স্তরে বিচরণ করে ততই তারা নিজেকে গুটিয়ে নেয়,নিজেকে নিজের থেকেও তুচ্ছ মনে করে। একসময় এসব মানুষ নীরব হয়ে যান। কাজ ছাড়া কিছুই বুঝেন না। মানুষ যতই জ্ঞানী হয় ততই তার মন মস্তিষ্কের সকল দরজা খুলে যায়। আর এতো বাতাস সেখানে আসে ঝড়ের তাÐব লেগে যায় মস্তিষ্ক মনে। এজন্যই তারা সর্বদা নিজস্ব ভুবন আলাদাভাবে তৈরি করে নেয়।তাদের চলা বলা সব হয় নিজের জগতের নিয়ামানুসারে। বাস্তবিক জীবন থেকে একটু ভিন্ন ধাঁচের। এজন্যই জ্ঞানীকে তাঁর সমকক্ষ ব্যক্তি ব্যতীত কেউ বুঝে না। কেউ কেউ বদ্ধ পাগলও বলে। তাদের কাজে একটু অস্বাভাবিকতা, ব্যতিক্রম থাকবেই।ইতিবাচক ধারণায় পুষ্ট থাকে বলে তারা কালোর ভিতরও সুন্দরতম কালো খুঁজে পান। পাথরের উপর শীলার ভাঁজের শৈল্পিক রূপ দেখতে পান। আকাশে পাখি উড়তে দেখলে তাঁদের মনের বলাকাও উড়ে সাথে।
তৃতীয় স্তরের ভাবনার মানুষদের সবচেয়ে বেশি অবদান সভ্যতার উন্নতি সাধনে। বাকী দুই স্তর তার সুফল ভোগ করে কেবল। যারা কাজে কর্মে অদম্য উচ্ছাস, অধ্যাবসায় করে জীবন চালাতে চায় না তারা সারাক্ষণই লেগে থাকে সৃষ্টিধর্মী সৃজনশীল মানুষদের পেছনে। যার কারণে গবেষণা, লেখালেখির, উদ্ভাবন কর্ম অনেকটা বাধার সম্মুখীন হয়।পরতে পরতে পরাস্ত করতে মরিয়া হয়ে উঠে পরিবার,সমাজ আর রাষ্ট্র। আর এভাবেই তারা পরিবার, সমাজ আর রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতায় বিচ্ছিন্ন হয়ে একাকী জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। অথচ তাঁদেরই অবদান যুগযুগ ধরে সকলে পেয়ে আসছে সভ্যতার যৌবন বয়সে।এখন চলছে পৃথিবীর সভ্যতার যৌবন কাল। এটা আরো কয়েক শতক দীর্ঘ হবে। অথচ যাঁদের কর্মনিষ্ঠায় ভালো কাজ হচ্ছে তাঁদের।কেউ মনে রাখে না দু’একজন ছাড়া।বড়ই স্বার্থপর এই পৃথিবী। উচ্চমার্গীয় চিন্তার মানুষের দুঃখ যন্ত্রণা চরম মাত্রায়, ভালোবাসা প্রেম,মায়া, বিপদে সহযোগিতা করার মানুষও অনেক সময় পাশে পাওয়া মুশকিল হয়। আর উদার ভাবনায় নিজেকে গড়ে তুলতে বেশি লেখাপড়ারও দরকার হয় না। প্রকৃতিই আমাদের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়। এখান থেকেই প্রতিনিয়ত কোন টিউশন ফি ছাড়া আমরা শিখছি, ডিগ্রি পিএইচডি করছি। সৃষ্টি করছি সংকর থেকে উড়োজাহাজ শ্রমিক পর্যন্ত। সবাই একেক কাজে দক্ষ, প্রকৃতির পিএইচডি ডিগ্রিধারী। এসবকে ছোট করে দেখার কোন অবকাশ নেই।তাই সার্টিফিকেটের বড়াই করার দিন শেষ। কিচ্ছু নাই এতে। কী জ্ঞান, দক্ষতা, মেধা, সততা না সৃজনী কর্ম। তাইতো পৃথিবীতে ডিগ্রিধারীদের ছলাকলায় আজ পৃথিবী ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।যত অন্যায় অবিচার হচ্ছে সব উচ্চ শিক্ষিত মানুষদের দ্বারা হচ্ছে। কোন রিকশাওয়ালা, তরকারি বিক্রেতা দিয়ে বোমাবাজি, অস্ত্রবাজি, সন্ত্রাসী, কোটি টাকা লুটপাটের মেধার জঘন্য প্রয়োগ হয় না।তারাতো এতো বিদ্যেধরী নয়।ফাঁকফোকর জানার কথা না। আর এসব কিছু অসৎ মানুষের জন্য উচ্চমার্গীয় ভাবনার মানুষরা। আজ চরম ক্ষতিগ্রস্ত। সবাইকে এক পাল্লায় মাপা হচ্ছে।কবিকে পাগল বলছে, ছন্নছাড়া বলছে, গবেষককে উন্মাদ বলছে। আর এসব করছে ভাবনার প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরের মানুষগুলোই।
জগত সংসারের কঠিন মারপ্যাঁচ থেকে সর্বদা নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখতেই একাকী জীবন বেছে নেয় স্বেচ্ছায় সরল বোকা নির্ভেজাল মানুষ। কী করবে, প্রেমের কবিতা লিখলে স্ত্রী বা স্বামী বলে, কাকে নিয়ে লিখেছো? নিশ্চয়ই খারাপ মেয়ে বা ছেলের পাল্লায় পড়েছো। অথচ এসব কবির কল্পনার দারুণ সৃষ্টি যা ওদের হৃদয় ছুঁয়েছে বিধায় সন্দেহ করছে।আর এখানেই কবির কবিতা লেখার পাÐিত্য সফলতা। কারো মনে প্রশ্ন জাগিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। এসব গোবেচারা মানুষদের সংসার সুখের হয় না। হতো যদি তার মতো চিন্তার মানুষ যদি সাথী হতো। সৃষ্টি সাধনা যাঁদের নেশা তাঁরা সব ছেড়ে দিতে পারে, একাকী জীবন কাটাতে পারে কিন্তু দৈব পাওয়া দান সৃষ্টি কর্ম ছাড়তে পারে না কখনোই।
পরিশেষে বলি, জগতে যে ক’টা দিন কাটানো যায় সময়কে কাজে লাগাতে হবে। সৃষ্টির যোজনার কর্ম পৃথিবীতে দলিল রেখে যেতে হবে তবেই ভবিষ্যৎ আমাদের নিয়ে ভাববে, চিনবে। আমাদের ভাবনাগুলো একসময় তাদের কাছে অমূল্য আবিষ্কার হিসেবে পরিগণিত হবে। তাই সৃষ্টিধর্মী, মননশীল কাজে বাধা নয় বরং সাহস ও সহযোগী হউন। তাঁদের যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে একটু ভালোবাসার চাদরে ঠাঁই দিলে সৃষ্টি হতে পারে অনেক বিস্ময়কর আবিষ্কার যা সামনের এগিয়ে চলা সভ্যতাকে আরো গতিশীল, নিরাপদ আর সুখের বসবাসের যোগ্যতর করো গড়ে তুলবে।

‘আসুন হাতে হাত মিলাই,
সৃষ্টির মাঝে সুখ বিলাই।’

লেখক : শিক্ষক,কবি ও প্রাবন্ধিক