সৃজনশীল তারুণ্যের পথিকৃৎ শেখ মণি

34

 

সৃষ্টির নেশা যার প্রতিটি রক্তকণায়, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতে থাকাই ব্রত তাঁর। তিনি শেখ ফজলুল হক মণি। সৃজনশীল, মেধাবী, দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ বাঙালি তরুণ সমাজ গঠনের স্বাপ্নিক এ মহাপুরুষের জন্ম গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। শেখ নুরুল হকের ঔরসে শেখ আছিয়া রহমানের গর্ভ হতে ১৯৩৯ সালের ৪ ডিসেম্বরের শুভক্ষণে ভূমিষ্ট হন অমিত প্রতিভাধর শেখ মণি। শেখ মণি-র মাতা আছিয়া খাতুন হলেন বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এর মেঝ বোন। স্বামীর চাকুরির সূত্রে আছিয়া খাতুন কোলকাতাতেই থাকতেন। বঙ্গবন্ধু কোলকাতায় প্রায়শঃই মেঝ বোন আছিয়া খাতুনের বাসায় থাকতেন। ফলে বোনের ছেলে শেখ ফজলুল হক মণি সহজেই মামা শেখ মুজিবের ব্যক্তিত্ব, সাহস ও চিন্তা চেতনা দ্বারা প্রভাবিত হন। ভাগ্নের বুদ্ধিদীপ্ত চেতনা, মেধা ও মননশীলতার উম্মেষ দুরদর্শী মামা মুজিবের দৃষ্টি এড়ায়নি। তিনি মেঝ বোনের কাছে ভাইয়ের আবদার হিসেবে শেখ মণিকে রাজনীতির জন্য চেয়ে নিয়েছিলেন।
বোন আছিয়া খাতুন আর দশজন মা-বোনের মতই উৎকন্ঠা প্রকাশ করে ভাইকে বললেন, এক তুমি রাজনীতি করছ তাতেই আমাদের অনেক চিন্তা হয়। তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘বুজি! রাজনীতিতে আমার তো কেউ ছিলো না, মণি’র তো আমি আছি।’ এরপর বোন তাঁর ভাইয়ের আবদার আর ফেলতে পারেননি। তারপর, ছাত্রজীবন থেকেই শেখ মনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন।
১৯৬০ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত তিনি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তিনি গ্রেপ্তার হন এবং ছয় মাস কারাভোগ করেন। ছাত্র রাজনীতি করার সময়ে শেখ মণি ছিলেন সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রাণের স্পন্দন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে তিনি বারংবার অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন। সামরিক শাসক আইয়্বু খান রাজনীতি নিষিদ্ধ করে দিলে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে গোপন রাজনীতি শুরু করেন শেখ মনি।
রাজনীতির সংকটময় মুহূর্তে শেখ মণি ছাত্রলীগকে ভিন্ন নামে পুনরুজ্জীবিত করার কাজ করেন। শিল্প ও সাহিত্য সঙ্ঘের আড়ালে ছাত্রলীগকে পুনরুজ্জীবিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এভাবে তিনি একটি বাহিনী গঠন করলেন। যাকে পরে ‘নিউক্লিয়াস’ নাম দেয়া হয়। ষাটের দশকের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি আন্দোলনে শেখ মণি-র ভূমিকা ছিল অনবদ্য। ১৯৬৪ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ও পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর আবদুল মোনায়েম খানের নিকট থেকে সনদপত্র গ্রহণে তিনি অস্বীকৃতি জানান এবং সরকারের গণবিরোধী শিক্ষানীতির প্রতিবাদে সমাবর্তন বর্জন আন্দোলন শুরু করেন।
যারা মোনায়েমের হাত থেকে উপাধিপত্র নেওয়ার জন্য সভাস্থলে হাজির হয়েছিলেন, তারা উল্টো শেখ মণির নেতৃত্বে সভাস্থল বয়কট করেন এবং মোনায়েম খানকে প্রকাশ্যে বর্জন করেন; উপাধিপত্র না নিয়েই তারা ফিরে যান। এই আন্দোলন ব্যাপক রূপ ধারণ করে। প্রবল ছাত্র বিক্ষোভে সমাবর্তন ভন্ডুল হয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত ছাত্রকে গ্রেফতার করে সামরিক স্বৈর সরকার। প্রতিবাদে প্রায় দেড়শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়। পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হন শেখ মণি, দেড় বছর কারাভোগ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার ডিগ্রি প্রত্যাহার করে নেয়। পরবর্তী সময়ে তিনি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ে জয়লাভ করে ডিগ্রি ফিরে পান।
শেখ মণির রাজনৈতিক জীবনের আরেকটি অন্যতম বড় কৃতিত্ব ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ৬ দফার পক্ষে হরতাল সফল করে তুলেছিলেন তিনি। এ সময় বিভিন্ন অভিযোগে তার বিরুদ্ধে আটটি মামলা দায়ের করা হয়। ১৯৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান সফল হওয়ার পর তিনি মুক্তি পান। দেশ স্বাধীন করার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের জন্য গোটা বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী নেতৃত্বে ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রামে অনন্য ভূমিকা রাখেন শেখ মনি। তিনি ছিলেন ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনমুখী কর্মসূচির অন্যতম প্রণেতা।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শেখ ফজলুল হক মনির উদ্যোগে মুজিব বাহিনী গঠিত হয়। মুজিব বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত একটি মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী। আওয়ামী লীগ ও এর ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের কর্মীদের নিয়ে এ বাহিনী গঠন করা হয়। প্রায় পাঁচ হাজার সদস্যের এ বাহিনীকে চারটি সেক্টরে ভাগ করা হয় এবং এর নেতৃত্বে ছিল ১৯ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমান্ড। প্রথমদিকে সেক্টর কমান্ডাররা ভারতের ব্যারাকপুর, শিলিগুড়ি, আগরতলা ও মেঘালয় থেকে নিজ নিজ বাহিনী পরিচালনা করতেন। এ বাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ডার ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি, তোফায়েল আহমেদ, সিরাজুল আলম খান ও আব্দুর রাজ্জাক। শেখ ফজলুল হক মনি মুজিব বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুজিব বাহিনী গঠনের পাশাপাশি শেখ মণি প্রকাশ করেন ‘বাংলার বাণী’ পত্রিকা। এ পত্রিকায় তিনি নিজে লিখতেন। থাকত রণাঙ্গণের খবর। এভাবে তিনি একটি নতুন স্বদেশ সৃজনে নিজের মেধা, সাহস ও প্রজ্ঞার স্ফুরণ ঘটিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলার বাণী দৈনিক পত্রিকা হিসেবে তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হতে থাকে। বাংলার বাণী যেমন মুক্তিযুদ্ধের মুখপাত্র হয়ে উঠেছিল। আবার তার প্রতিষ্ঠিত সুস্থ বিনোদন ধর্মী সাপ্তাহিক ‘সিনেমা’ পত্রিকা ছিল বাঙালি সংস্কৃতির পরিশীলিত বুনিয়াদ গড়ার কাজ করেছিল। শেখ মনি মনেপ্রাণে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একটি সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা গঠন করতে চেয়েছিলেন। শিশু কিশোরদের সৃজনশীল ও সাংস্কৃতিক বিকাশের লক্ষ্যে গড়ে তুলেন শাপলা কুঁড়ির আসর।
শেখ মণি রচিত বেশ কিছু রাজনৈতিক উপন্যাস লিখেছিলেন, যা পাঠকদের কাছে অত্যন্ত সমাদৃত হয়েছিল। একটি উপন্যাস অবলম্বনে ‘অবাঞ্ছিতা’ নামে একটি জনপ্রিয় টেলিফিল্মও তৈরি করেছিলেন তিনি। রচনা করেছিলেন গল্পগ্রন্থ। শেখ মণি ছিলেন, একজন আগাগোড়া সৃষ্টিশীল ও দুরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যাতিক্রমী মানুষ। স্বাধীনতা পরবর্তী ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ ভাবনায় তিনি কাতর হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পরামর্শে শেখ ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর গঠন করেন যুব সংগঠন ‘বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ’। এ সংগঠনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন তিনি নিজেই।
বঙ্গবন্ধুর সর্বজনের প্রতি বিশ্বাসের ভিত টলাতে না পেরে ‘বাংলার বাণী’তে (১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭২) লিখেছিলেন- বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ারই একটি রাষ্ট্র। মানুষ এখানে দরিদ্র। মধ্যবিত্তের উচ্চাভিলাষ এখানে অপরিমিত, স্বাধীনতার শত্রুরা এখানে তৎপর, পুরাতন আমলারা রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যন্ত্রে পুনর্বাসিত। সুতরাং সময় থাকতে রোগ ধরা না গেলে দাওয়াইটিও কেউ খুঁজবে না এবং একজন সংবাদপত্রসেবী হিসেবে সে দায়িত্ব আমাদেরই।’
’৭৫ এ বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের অন্যান্যদের সাথে ঘাতকের নির্মমতায় তাঁর মৃত্যুর পর এ উদ্ধৃতির সত্যতা বাঙালি হাড়ে হাড়ে টের পায়। ৭৫ পরবর্তী দুঃসময়ের কঠিন পথ মাড়িয়ে পথ হারানো বাংলাদেশকে তাঁর সঠিক দিশায় ফেরানোর কঠোর আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার ভ্যানগার্ড হিসাবে কাজ করে শেখ মণি’র রেখে যাওয়া যুবলীগ। আজ সুমহান রাজনীতিবিদ, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, সাংবাদিক, কলাম লেখক, ছোট গল্পকার, তাত্তি¡ক দার্শনিক ও ভবিষ্যৎ স্বপ্ন দ্রষ্টা শেখ ফজলুল হক মণি-র ৮৩তম জন্মদিনে আমাদের হৃদয়ের শ্রদ্ধার্ঘ্য। সৃজনশীন তারুণ্যের পথিকৃৎ শেখ মণি চির ভাষ্মর থাকুক।
জয় বাংলা, জয় বন্ধু।
জয়তু শেখ হাসিনা।
লেখক: সংগঠক ও সাবেক ছাত্রনেতা