সৃজনশীলতায় অনন্য চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

159

ত্রিয়মা রায়

‘মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব
তুমি আছ, আমি আছি।’
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা এই চরণ দুইটির সাথে নিজেকে মিলিয়ে নেওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে, এই অল্প কয়দিন হলো। ২১ ব্যাচ-২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি থেকে ক্লাশ শুরু। সংক্ষিপ্ত সময় পার করেই আমার সংবেদী ও আবেগী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়- চুয়েট। আমাদের পূর্বসূরিদের পরম যতেœ শুরু হয়েছিল ঠিক কুড়ি বছর আগে। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দের ১লা সেপ্টেম্বর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে প্রথম প্রকাশ্যরূপে আবির্ভূত হয়েছিল। বইয়ে-পুস্তকে আর ভিডিও-সিনেমায় দেখা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পুরোটাই এখানে আছড়ে পড়েছে।
সবুজ প্রকৃতি, সারি-সারি গাছ-লতার সমারোহ, বাহারি সব ফুলের সমাহার, পাখিদের কিচির-মিচির, কলতান, পাহাড়-সমতল মিশ্রিত প্রাকৃতিক জলাধার, পাহাড়ি উঁচু-নিচু মেঠোপথ, বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য, সঙ্গে সর্পাতঙ্ক মিলেমিশে অবস্থানের কারণে প্রথম দিনেই নিজের মানসপটে প্রকৌশলের সংজ্ঞা তৈরি করে ফেলি। চট্টগ্রাম শহরের আমার বাসা থেকে ঠিক সাড়ে বিশ কিলোমিটার দূরত্বে কাপ্তাই-চট্টগ্রাম সড়ক ঘেঁষে রাউজান উপজেলার ঐতিহাসিক পাহাড়তলি এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে দেশের অন্যতম প্রধান প্রকৌশল শিক্ষার এই প্রতিষ্ঠানটি। প্রাকৃতিক মনোরম পাহাড়-সমতল, সবুজ সমারোহ-লেক মিলিয়ে অপূর্ব স্থাপনার মেয়েদের ২টি হলের নতুনটি শামসেন নাহার হলে প্রথম দিনই যখন সিট পাই তখনই জীবনের আর সব আকর্ষণ নেহায়েতই ফিকে হয়ে যায়।
১৭১ একর জায়গা জুড়ে প্রকৌশলবিদ্যার অনুকরণে দৃষ্টিনন্দন সব অবকাঠামোয় স্থাপনার ক্যাম্পাস হয়ে ওঠে সুপ্রিয়। সার্বভৌম ও একক টানের স্থান। মূল শহর থেকে গ্রামীণ জনপদে অবস্থান থাকা সত্তে¡ও প্রধান ফটকে ঢুকলেই স্ব-মহিমায় দাঁড়িয়ে থাকা গৌরবময় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, স্বাধীনতা ভাস্কর্য, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল, সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য মুক্তমঞ্চ, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের গভীরতাবাহী-টিএসসি, পাহাড়-টিলা-টংকর-মেঠোপথ জোড়া দিয়ে তৈরি ঝুলন্ত সেতু অনন্য মুগ্ধতার জন্ম দেয়। সারা দেশের অর্থনীতির প্রাণ খড়¯্রােতা কর্ণফুলী নদী স্বল্প দূরত্বে আর স্বাদু পানির উৎস মনুষ্যসৃষ্ট দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম কাপ্তাই হ্রদের ছায়ার সৌন্দর্য-চুয়েট ক্যাম্পাসকে উজাড় করে দিয়েছে। যদিও প্রাকৃতিক শিল্পের শাঁস হিসাবে সমান্তরালভাবে এই ক্যাম্পাস নিজেই স্বাধীন-অর্থবাহী।
প্রকৌশল শিক্ষার ধরণ-গড়ন অন্য সব শিক্ষা থেকে আলাদা-ব্যতিক্রম। প্রথম দিন থেকেই আঁটসাঁট একাডেমিক শিডিউলের মধ্যে জীবনের আপন জগৎকে নির্মম রুক্ষ যাত্রাপথ বলে ভেবে নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম জীবনের সাথে প্রকৌশলবিদ্যাশিক্ষার তফাৎ এখানেই। মাত্র কয়েকদিন যেতেই আমার ভাবনা-বিশ্বাস ভুল প্রমাণিত হলো। এক কথায় এই ভাবনা খারিজ করে দিতে বাধ্য হলাম। দেশসেরা ১২-১৪ টি ব্যান্ডদল নিয়ে ২ দিনব্যাপী ব্যান্ডসংগীতের সুরের মুর্ছনা কেবল ক্যাম্পাসের সাড়ে ৫ হাজার শিক্ষার্থী নয়; পুরো এলাকাকে কাঁপিয়ে দেয়। শব্দে-ছন্দে-বিন্যাসে-বিশ্বাসে মাতিয়ে দেয় নিজস্ব নিরালা। ছেলেদের ৬টি হলে-তো বটেই মেয়েদের হল আর ক্যাম্পাসের ৩টি ক্যান্টিনসহ সবকিছু ২ দিনের জন্য দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা একাকার হয়।
অল্প দিনের মধ্যেই প্রায় সাড়ে তিনশত বন্ধুবৎসল চৌকষ শ্রদ্ধেয় শিক্ষকমণ্ডলীর সান্নিধ্যে আসার ব্যাপারে আবেগতাড়িত ভূমিকা রাখে। শতাধিক পিএইডি ডিগ্রিধারীসহ মানবিক বোধে শ্রেষ্ঠত্বের সব শিক্ষকবৃন্দের সামনে যখন কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়াই, তখন শিক্ষকগণ আমাদের আগলে নেন। এক পরিবারভূক্ত আমরা সবাই বলে দ্বিধাহীন চিত্তে সব অভিব্যক্তি প্রকাশের আন্তরিক আদেশ দেন। এই আদেশ-নির্দেশে কোনো মালিন্য নেই, কৃত্রিমতা নেই। প্রাণের ছোঁয়া অনুভব করি। ব্যতিক্রমী-মনোগ্রাহী এইসব আলোচনায়, আলাপ- আড্ডায় নিজেকে প্রকৃত অর্থে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ভাবতে শুরু করি। নিজের গহিনে নিজস্ব একটি পথ তৈরি হয়ে যায়। এরপরই আসে ফেব্রæয়ারি মাসে সনাতনী শিক্ষার্থীদের আয়োজনে বিদ্যাদেবী সরস্বতী পূজা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পূজা পর্বটি ছাড়া বাকীসব কর্মে ও আয়োজনে সংস্কৃতিমনা সকল শিক্ষার্থী, শিক্ষকমÐলী, বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত দেড় শতাধিক কর্মকর্তা, চার শতাধিক বিভিন্ন শ্রেণির চাকুরীজীবী নানাভাবে নিযুক্ত থেকেছেন। অনেকের অনিবার্য উপস্থিতি প্রয়োজন না হলেও এই উদ্যোগ ও পরিশ্রমে নৈতিক সমর্থন দিয়ে সদ্বংশজাত হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুজ্জ্বল ঐতিহ্যকে অধিক সমৃদ্ধ করেছেন।
বর্তমান ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রফিকুল আলম স্যারের ভারিক্কি চালের ঐকান্তিক কর্মচঞ্চলতা আমরা প্রথম দিন থেকেই ভিন্নমাত্রিক কর্মগুণে অনন্য বলে দেখে আসছি। চুয়েটের ৫টি অনুষদের অধীনে ১২টি ডিগ্রিপ্রদানকারী বিভাগসহ ১৮টি বিভাগ, ৩টি গবেষণা সেন্টার, ৩টি গবেষণা ইনস্টিটিউট, একটি কেন্দ্রীয় রিসার্চ ব্যুরো, একটি টেস্টিং ও কনসালটেন্সি সেন্টার, দেশের প্রথম এবং একমাত্র শেখ কামাল আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর, দেশের একমাত্র ভূমিকম্প প্রকৌশল গবেষণা ইনস্টিটিউট, রিভার-হারবার ও ল্যান্ড স্লাইড রিসার্চ সেন্টারসহ প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো বিভাগ কর্তৃক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সেমিনার, কনফারেন্স আয়োজনে অনন্য দক্ষ এই বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রজ্ঞা-শ্রমনিষ্ঠা, আন্তরিকতা, মানবিক মূল্যবোধ ও স্বদেশপ্রীতির সতেজ ঢঙে দক্ষতার সাথে পরিচালনা করছেন। প্রকৌশল শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠান অনেক বিষয়ই বাংলাদেশে প্রথম হলেও পানিসম্পদ কৌশল বিভাগের আয়োজিত কনফারেন্স এ দেশের জন্য প্রকৃত অর্থেই অনবদ্য ভূমিকা রাখছে। এরপরও শিক্ষার্থীদের যেকোনো উৎসবে-আয়োজনে-প্রয়োজনে যাবতীয় সযতেœ সহযোগিতা করছেন, এগিয়ে আসছেন। প্রতিটি শিক্ষার্থীর মননচর্চার ভিত রচনায় সর্বদা সচেষ্ট থাকছেন। সংকট, সমস্যা, প্রতিবন্ধকতা নিরসনে ক্লাশ রিপ্রেজেনটেটিভদের সাথে খোলামেলা আলোচনা করছেন। ক্লাশ সি আর হিসাবে আমারও সুযোগ হয়েছে কালোত্তীর্ণ এইসব আলোচনা ও পরামর্শ সভায় উপস্থিত থেকে নিজেকে সমন্বিতভাবে সমৃদ্ধ করার।
রসকষহীন প্রকৌশল শিক্ষার শিক্ষার্থীরা যেন ‘ইঞ্জিনিয়ার’ হওয়া ছাড়াও ‘মানুষ’ হিসাবে বেড়ে ওঠতে পারে, এর জন্য অনুক‚ল ¯্রােত এখানে প্রবহমাণ। চুয়েটিয়ানদের অকুন্ঠ ভালোবাসা নিয়ে উক্ত ক্যাম্পাসে অন্তত ২০টি সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন নিবন্ধিত। এর বাইরে আরো অনেক সংগঠন বিশেষ করে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা মানবিকতা প্রকাশের জেলাভিত্তিক সংগঠন বেশ নজর কারে।
নিবন্ধনের বাইরে থেকে কাজ করা সংগঠনের সংখ্যা অনুমান করার ভরসা পাই না। প্রতিটা সংগঠনের আলাদা-আলাদা আবেদন আছে। চিন্তা-ভাবনার ভিন্নতা আছে। সাংস্কৃতিক সংগঠন কয়েকটির ইতিহাস-তো মুগ্ধ হওয়ার মতো গরিমা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সংস্কৃতিমনা এইসব সংগঠনের কর্মকাÐে ইঙ্গিত করে-চুয়েট ক্যাম্পাস কতোটা ইনোভেটিভি, কতোটা ক্রিয়েটিভ। ‘জয়ধ্বনি’ সারাদেশব্যাপী আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক উৎসবে বেশ কয়েকবার চ্যাম্পিয়ন, রানারআপ হয়েছে, চুয়েট ডিবেটিং সোসাইটিও কম যায় না, নাটকীয় ঢঙের যুক্তিনির্ভর বিতর্ক করে জাতীয় বিতর্ক উৎসব, বাংলাদেশ টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অসংখ্যবার চ্যাম্পিয়ন, রানারআপ হয়েছে। রোবো মেকাট্রনিক্স অ্যাসোসিয়েশন, মহাকাশ ও রোবটিক গবেষণা সংস্থার সদস্য চুয়েটিয়ানরা প্রতিবছরই দেশ-বিদেশ থেকে বড় বড় সাফল্য নিয়ে আসছেন। গ্রিন ফর পিস’র সদস্যরা বছরজুড়েই পরিবেশ সচেতনতামূলক কাজের ফলবতী হই আমরা সকলে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ পেশাজীবী সংগঠন ‘ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রনিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার্স’ এর চুয়েট ছাত্র শাখার কর্মকাণ্ড ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে।
প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য ‘চুয়েট ক্যারিয়ার ক্লাব’, ‘চুয়েট কম্পিউটার ক্লাব’, ‘চুয়েট স্পোর্টস ক্লাব’, ‘ফটোগ্রাফিক সোসাইটি’, ‘চলচ্চিত্র সংসদ’, ‘ভাষা ও সাহিত্য সংসদ’ বেশ আলো ছড়াচ্ছে। প্রাক্তন কলেজ সতীর্থদের সংগঠন ‘ঢাকা কলেজ অ্যাসোসিয়েশন’, ‘নটরডেমিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ বর্তমানে দাঁড়িয়ে অতীতের ইতিহাসকে বেশ ভালোভাবেই আঁকড়ে ধরে আছে। জেলাভিত্তিক কিছু ছাত্র সংগঠন চট্টগ্রামীয়ান, নরসিংদীয়ান, ব্রাহ্মণবাড়ীয়ান মানের দিক থেকে অনন্য বলে মনে হয়েছে। এছাড়া ছাত্ররাজনীতি চর্চার সংগঠনগুলো নিজস্ব মনোস্তাত্তে¡র রহস্যে আচ্ছাদিত হয়ে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখছে।
আপন- সমুজ্জ্বল বৈশিষ্ট্যের প্রকৌশলবিদ্যার ব্যতিক্রমধর্মী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাহী ক্যাম্পাসকে ঘিরে আমার ভাবনামালা কথা আকারে প্রকাশ করলাম। অল্প কয়দিন সময়ে ক্যাম্পাসের সঙ্গে জীবন-যাপনের একটি বিক্ষিপ্ত প্রতিবেদন মাত্র। নিছক ব্যক্তিগত বিবেচনার গÐিতে লেখার ভাষা-ভাবভঙ্গি, অন্দরমহলের বিশ্লেষণ একান্তই নিজস্ব। আরো অনেক কিছু প্রকাশ হয়নি বলে অনেকের কাছে অভিনব মনে হতে পারে। সচেতন-অনুরাগী পাঠকেরা চুয়েট সমন্ধে আগ্রহী হবেন, জানবেন এই ভাবনার বাইরে আর কিছু নয়। চুয়েটের গৌরবময় পথচলার অগ্রযাত্রায় যাঁরা বিভিন্নভাবে ভূমিকা রেখেছেন, সহযোগিতা করে যাচ্ছেন, চুয়েট পরিবারের নবীনতম সদস্য হিসাবে সকলের অবদানকে বিন¤্রভাবে কৃতজ্ঞতা জানাই। মর্যাদপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানের বিশাল- ব্যাপৃত-বিস্তৃত যজ্ঞের গহিনে কতকিছুই না লুকিয়ে আছে। যেটি কবিগুরুর ভাষায়Ñ
‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে’।
লেখক : শিক্ষার্থী, পানিসম্পদ কৌশল বিভাগ, চুয়েট