সূর্যমুখী ফুলের হাসিতে বেকার আজিজের ঘুরে দাঁড়ানো

9

মাসুদ নাসির, রাঙ্গুনিয়া

বেকার জীবনের দুঃসহ হতাশায় ১৩ বছর আগে ভাগ্য বদলের জন্য বিদেশে পাড়ি দেন। সেখানেও অর্থনৈতিক ভাগ্য তার সঙ্গ না দেয়ায় ফিরে আসেন স্বদেশে। আবারও সংসার জীবনে শুরু হয় অভাবের টানাটানি। কিভাবে কি করবেন- এমন সব হতাশা নিয়ে চলছি দূর্বিষহ জীবন। নিজের গ্রামের বাড়ি রাঙ্গুনিয়ার বেতাগী ইউনিয়নে নিজেদের জমিতে সবজি ও ধান চাষ করেও সফলতার মুখ দেখেননি। কিন্তু থেমে থাকেননি ৩৭ বছর বয়সী যুবক মো. আব্দুল আজিজ। এরপর জমি লিজ নিয়ে শুরু করেন সূর্যমুখী ফুলের চাষ। তার সেই শ্রমের ঘামে সুঘ্রাণ দিচ্ছে চাষ করা সূর্যমুখী ফুলের সুভাষিত হাসি। আর এই হাসি আজিজের বেকার জীবনকে যেন ছন্দে এনেছে।
রাঙ্গুনিয়া উপজেলার বেতাগী ইউনিয়নের তিন সৌদিয়া গ্রামের বাড়ির সড়কের পাশে ১ একর জমি লিজ নিয়ে সূর্যমুখী ফুলের চাষ করেন আজিজ। এই উদ্যোগেই বাজিমাত করেন তিনি। উপজেলা কৃষি অধিদপ্তর থেকে বিনামূল্যে ৫ কেজি বীজ নিয়ে জমিতে ছিটিয়ে দেন আবদুল আজিজ। সপ্তাহখানেক পর সূর্যমুখী পরিপক্ক হয়। চাষে খরচ হয় ১২ হাজার টাকা। ফলন হওয়ার পর সূর্যমূখী ফুলের বীজ ও তেল বিক্রি করে লক্ষাধিক টাকা আয় করেন তিনি। অবশিষ্ট ফুল থেকে আরো ২ থেকে ৩ লাখ টাকা পাওয়া যাবে বলে আশা করেন তিনি।
আব্দুল আজিজ বলেন, আমি এখন অনেকটা স্বস্তিতে জীবনযাপন করছি। অভাব অনেকটা দূর হয়েছে। আমার বেকার জীবনটা ছিল দুঃসহ। সূর্যমুখী ফুলের চাষ করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছি। আশা করি আগামিতে নানাবিধ ফসল চাষ করতে পারবো।
আজিজ জানান, প্রতি কেজি সূর্যমুখী ফুল বিক্রি হয় ৮০ থেকে ৯০ টাকায়। সরকারি প্রণোদনা পেয়ে প্রথমবারের মতো জমিতে সূর্যমুখীর চাষ করেছি। সূর্যমুখী একদিকে মনোমুগ্ধকর অন্যদিকে লাভজনক ফসলও। প্রথমবারই ভাল ফলন হওয়ায় আগামিতে আরো বেশি পরিমাণে আবাদ করার পরিকল্পনার কথা জানান তিনি।
আজিজের সূর্যমুখী ফুলের চাসের জমি ঘুরে দেখা যায়, প্রখর রোদে ঝলমল করছে সারি সারি দাঁড়িয়ে সূর্যমুখী ফুল। আশেপাশে নানা বয়সের নারী-পুরুষ, ছাত্র-ছাত্রীরা সূর্যমুখী ফুলের সাথে ছবি তুলতে ভীর করছেন। ফুলের ক্ষেতে পরিচর্যা করার সময় কথা হয় আবদুল আজিজের সাথে। তিনি বলেন, ফুল দেখতে এলাকার মানুষ প্রতিদিন আসে, ছবি তোলে। তখন নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয়। আমার ফুলের ভাগানে নানা জায়গা থেকে মানুষ দেখতে আসে। ফুল চাষে অনেকের আগ্রহ দেখে ভালো লাগে। আর নানা জনের কাছে ফুলের বীজ বিক্রি করে আনন্দ পাই। সত্যিকার অর্থে সূর্যমুখী ফুলের চাষ করতে নিজের মাঝে একধরনের আনন্দ পাই। যা অন্য কোনো কৃষিকাজে পাওয়া যায় না।
তিনি বলেন, উপজেলায় বীজ ভাঙ্গানোর কোনো মেশিন নেই, এটা বড় সমস্যা। অনেকে সূর্যমুখী ফুল চাষ করে বেকাদায় আছেন। এছাড়া ফুল থেকে মধু সংগ্রহের জন্য মৌ বাক্স কিংবা সরঞ্জামাদি সহজে পাওয়া যায় না। এসব সরঞ্জাম থাকলে এই চাষে লাভবান হওয়া যায়। এ সমস্যা উপজেলা কৃষি অফিস থেকে সমাধান করতে পারলে উপজেলায় ব্যাপকভাবে সূর্যমুখী ফুলের চাষে অনেকে আগ্রহী হবেন।
বেতাগী ইউনিয়নের কৃষক আবদুল করিম জানান, সরকারি প্রণোদনা পেয়ে প্রথমবারের মতো জমিতে সূর্যমুখীর চাষ হয়েছে। সূর্যমুখী একদিকে মনোমুগ্ধকর অন্যদিকে লাভজনক ফসল। প্রথমবারই ভাল ফলন হওয়ায় আগামিতে আরো বেশি পরিমাণে আবাদ করার পরিকল্পনার কথা জানান তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখানকার মাটি ও আবহাওয়া সূর্যমুখী চাষের জন্য বেশ উপযোগী হওয়ায় উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ২০ বিঘা জমিতে ৫০ জন কৃষক প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় প্রথমবারের মতো সূর্যমুখী ফুলের আবাদ করে বাজিমাত করেছেন। সাড়ে তিন মাসের মধ্যে ফলন ঘরে তোলা যায় জানিয়ে বেতাগী ইউনিয়নের কৃষি উদ্যোক্তা মোহাম্মদ মুছা জানান, ধান-পাট চাষে প্রচুর পরিশ্রম এবং খরচ হয়। কিন্তু সূর্যমুখী চাষে খরচ কম লাভ বেশি। বিঘাপ্রতি সূর্যমুখী চাষে ৭-৮ হাজার টাকার মতো খরচ হবে। খরচ শেষে বিঘাপ্রতি ৩০ হাজার টাকা লাভ হবে। খরচের তুলনায় লাভ ও সময় কম লাগার কারণে আগামিতে অনেক কৃষকই সূর্যমুখী চাষে ঝুঁকবে বলে মনে করেন এ কৃষক।
চন্দ্রঘোনা খ্রিস্টিয়ান হাসপাতালের পরিচালক ডা. প্রবীর থিয়াং জানান, সূর্যমুখীর তেলে মানব দেহের জন্য ক্ষতিকারক ইরোসিক এসিড নেই। এ তেল অন্যান্য সাধারণ তেলের চেয়ে একটু আলাদা। কোলেস্টেরলমুক্ত সূর্যমুখীর তেলে প্রচুর পরিমাণে প্রাণশক্তি থাকায় এটি আমাদের শরীরের দুর্বলতা কমায় ও কার্যক্ষমতা বাড়ায়। রান্নার জন্য সয়াবিন তেলের চেয়ে সূর্যমুখী তেল দশ গুণ বেশি পুষ্টিসমৃদ্ধ। শরীরের হাড় সুস্থ ও মজবুত করে।
উপজেলা কৃষি অফিসার ইমরুল কায়েস জানান, উপজেলায় ৫০ জন কৃষককে জমিতে বীজ বপনেরর জন্য সূর্যমুখী বীজ ও সার প্রণোদনা দেওয়া হয়। তাদেরকে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। কৃষক আব্দুল আজিজের মতো সূর্যমুখী ফুলের চাষ করে অথনৈতিকভাবে সফলতা পেয়েছেন অনেকেই। এ চাষ এখানে আরো যাতে বেশী হয় আমরা সেদিকে অগ্রসর হচ্ছি। অন্য ফসলের চেয়ে সূর্যমুখী ফুল চাষে খরচ কম। এতে সার-কীটনাশক কম লাগে। ধান চাষের মতো পরিচর্যাও করতে হয় না। এছাড়াও সূর্যমুখী ফুলের কান্ড জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার ও বিক্রি করা যায়। যা থেকে বাড়তি টাকা আয় করা যায়।
বেতাগী ইউপির চেয়ারম্যান মো. শফি জানান, আমার এলাকায় আবদুল আজিজ সূর্যমুখী ফুলের চাষ করে ব্যাপকভাবে সফলতা পেয়েছেন। তার দেখাদেখিতে এ চাষাবাদে অনেকে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। সাধারণ কৃষকদের সূর্যমুখী চাষে উদ্বুদ্ধ করতে পরীক্ষামূলকভাবে প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় কৃষকরা জমিতে এই ফুলের আবাদ করছে। তবে সূর্যমুখী ফুল থেকে স্থানীয় পর্যায়ে তেল শোধনের ব্যবস্থা করা গেলে সূর্যমুখী চাষাবাদে কৃষকরা আরো উৎসাহী হবেন বলে জানিয়েছেন কৃষকরা।