সুহৃদ বন্ধু সাইফুদ্দিন : স্মৃতির আয়নায়

58

১৯৬৯-৭১ সনে চট্টগ্রাম কলেজে পড়ার সময় বন্ধুদের মুখে মুখে সাইফুদ্দিনের নাম শুনতাম। কিন্তু পরিচয় কিংবা পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব বলতে যা বুঝায় তা তখনো হয়ে উঠেনি। সত্যিকারের পরিচয়টা হলো অনেকদিন পর আকস্মিকভাবে। আমার আরেক বন্ধু ইঞ্জিনিয়ার স্বপন। সে কিউসিতে চাকরী করতো। সম্ভবত: ১৯৯১ সন হবে। আমার বিকাল বেলার চেম্বার জামাল খান রোডে, সাইফুদ্দিনের গুড্স হিলের খুবই সন্নিকটে। স্বপন আমাকে অনেকটা টেনেহিঁচড়ে ওর গাড়িতে উঠাল। বলল, ওর বস্ সাইফুদ্দিন সাহেবের প্রচন্ড মাথাব্যথা, কপালের এক পাশ কাঁপছে। তোমাকে এখনই যেতে হবে। আমি রোগী দেখছিলাম। প্রথমে আমতা আমতা করলেও বিষয়টার গুরুত্ব অনুধাবন করে বিলম্ব না করে গাড়িতে চড়ে গুড্স হিলে পৌঁছলাম।
দেখলাম সাইফুদ্দিনের কপাল ঘামছে, প্রচন্ড মাথাব্যথা ও রেস্টলেস । না পারছে শুতে, না পারছে বসে থাকতে। রক্ত চাপ মেপে দেখলাম অনেক বেশি। পাশ থেকে জিজ্ঞাসা করা হলো স্ট্রোক কি হয়ে গেছে? সবাই ভীষণ দুশ্চিন্তায়। ওদের অভয় দিয়ে বললাম, একটু সময় দেন, ঠিক হয়ে যাবে। ওষুধ দিলাম। স্বপনসহ ঘণ্টাখানেক বাড়ির বৈঠক খানায় অপেক্ষা করলাম। ও ঘুমিয়ে পড়লে আমি চেম্বারে চলে এলাম। ফেরার পথে আনুমানিক রাত ১০ টার দিকে চেকআপ করলাম। দেখলাম সবকিছু ঠিকঠাক ও স্বাভাবিক। মাথাব্যথা নেই। রক্ত চাপ স্বাভাবিক হয়ে গেছে। বসে চা খাচ্ছে।
জানালো, এক আধটু ব্যথা ওর কমবেশি হয়। এর জন্য একটি বিদেশি ঔষধ খায়। কিন্তু এত তীব্র মাথা ব্যথা কখনো হয়নি। বললাম এখন থেকে স্বদেশী ঔষধ খেতে। উত্তরে সে বলেছিল তোমার সাথে দু’একবার বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল। ওগুলো ছিল ফর্মাল। আজকে দেখা হলো রোগী-ডাক্তার হিসেবে। তবে তুমি যে একজন ধনন্তরী ডাক্তার তা আজ বুঝতে পারলাম। আসলে ওটা ছিল মাইগ্রেন হেডেক। ওর উচ্চ রক্তচাপও ইতিমধ্যে হয়ে গিয়েছিল। আনডায়াগনোসড ছিল বিধায় মাথা ব্যথাটা এত তীব্র ছিল। ড্রাগটা দিয়ে দিলাম। মৃত্যাবধি তার আর এই মাইগ্রেন হেডেক হয়নি। এভাবেই তার সাথে প্রকৃত পক্ষে আমার প্রকৃত পরিচয়টা গড়ে ওঠে।
ওকে দেখে যাবার সময় আমার ফি দেয়া হয়েছে কিনা স্বপনকে জিজ্ঞেস করতে সে ভুলেনি।
সে ছিল প্রচÐ বন্ধুবৎসল। বন্ধুদের যেকোন বিপদে তাকে ঝাপিয়ে পড়তে দেখেছি। সে বিপদ পারিবারিক, আর্থিক, যেকোন রকমই হোক না কেন। আর্থিকভাবে দূর্ভল হয়েছে এমন অনেক বন্ধুদের সে বিভিন্নভাবে সাহায্যে সহযোগিতা করেছে। বিশেষভাবে চিকিৎসা ক্ষেত্রে। তার না ছিল দম্ভ, না ছিল গর্ব। পরিবারের অন্যদের চেয়ে সে ছিল আলাদা।
সকালে চাকুরী ও বিকেলে চেম্বারে রোগী দেখা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যে আমাদের দিন কাটে। তারপরও প্রায়শ: যোগাযোগ হতো। কারো অসুখ-বিসুখ হলে আমাকে কল করতে দ্বিধা করতো না। বিশেষ করে পরিবারের কোন সদস্যের চিকিৎসার জন্য অন্য ডাক্তার দেখালেও আমার সাথে একবার পরামর্শ করতো। বন্ধুবান্ধব কেউ হৃদরোগে হয়েছে আক্রান্ত হয়েছে বা শুনেছে হৃদরোগে ভুগছে, তাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে পরামর্শের জন্য ।
তার একটা ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ছিল। খুবই উৎকৃষ্ট মাপের। বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত সে লেখাপড়া করতে পছন্দ করতো। ইতিহাস ও দর্শন ছিল তার পছন্দের বিষয়। খেলাধুলায় পারদর্শী না হলেও সে একজন ক্রিড়ানুরাগী ছিলেন। বিশেষ করে ক্রিকেটে ছিল তার প্রবোল আগ্রহ।
গ্রামাঞ্চলে অবহেলিত জনগোষ্ঠীর শিক্ষা-বিস্তারে তার অবদান সুবিদিত। এক ডজনেরও অধিক স্কুল, কলেজ, পাঠাগার, মাতৃসদন তার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তার কাছে কেউ সাহায্যের জন্য আসলে যথাসাধ্য তাকে সাহায্যে করতে কার্পন্য করেনি। বিশেষ করে কন্যাদায়গ্রস্ত কোন পিতা মেয়ের বিয়ের সাহায্যের জন্য আসলে, তাকে সে ফিরিয়ে দেয়নি। সে যেই স¤প্রদায়েরই হোক না কেন।
মাঝখানে আমি বেশ কিছুদিন অসুস্থ ছিলাম। নিয়মিত সে আমার খরব রাখত- নিজেও বন্ধুবান্ধবের মাধ্যমে। এর মাঝে কোথাও দেখা হলেই প্রথমে জিজ্ঞাসা করতে আমার স্বাস্থ্য কেমন আছে, আমার পরিবারের অন্যরা কেমন আছে। বেশ আন্তরিকভাবে সে প্রশ্নগুলো করতো।
ওর মৃত্যুর বছর দুই আগে হঠাৎ শুনলাম তার পিঠের মাঝখানে প্রচন্ড ব্যথা। ব্যথার ভর পর পর কয়েক রাত ঘুমাতে পারেনি। পরের দিন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে পেইন কিলার দেয়া হলো। ব্যথা কিছুটা উপশম হলো। কিন্তু ২-৩ দিন পর আবার তীব্র ব্যথা। তারপর হাসপাতালে ভর্তি।
ঐদিনই বিশেষ পরীক্ষা শেষে (আলট্রাসনোগ্রাফি, সিটি স্ক্যান-এবডোমেন)। আমরা মোটামুটিভাবে একটা প্রভিশনাল ডায়াগনোসিস (লিমফোমা) এ পৌঁছে গেলাম। লিমফোমা এক ধরনের ক্যান্সার। ঐ সময় আমরা বেশ কজন সিনিয়র ডাক্তার ইনভালভ ছিলাম। সময় নষ্ট না করে ঐ দিনে রাত্রে সিঙ্গাপুর পাঠানোর ব্যবস্থা হলো। উদ্দেশ্য যত শীঘ্র সম্ভব বায়োপ্সি করে চিকিৎসা শুরু করে।
যাবার সময় আমার হাত চেপে ধরে আমাকে বলল- তোমরা তাহলে রোগ নির্ণয়ের জন্য আমাকে সিঙ্গাপুর পাঠাচ্ছ। দেশে কি এটা হবে না? দেশে আমাদের চিকিৎসা হবে না? তার একথাটা ভুলতে পারি না। বার বার কানে বাজে। মনে বড় কষ্ট পাই। একদিন সময়ও নষ্ট না করার জন্য পাঠানো হলো সিঙ্গাপুর। অথচ দুর্ভাগ্য সেই সিঙ্গাপুরের ডাক্তারা আমাদের করা প্রভিশনাল ডায়াগনোসিসটা কনফার্ম করল তিন মাস কাল ক্ষেপণ করার পর।
ইতিমধ্যে তারা একবার অপারেশন করল পেটের ভেতর থেকে টিস্যু নিয়ে (লিমফ নড) বায়োপ্সি করল। বায়োপ্সি রিপোর্ট মোতাবেক কোন সুনির্দিষ্ট ডায়াগনোসিসে পৌঁছাতে পারল না। দেশে পাঠিয়ে দিল।
রোগটা যখন বেড়ে গেলে বায়োপ্সি রিপোর্ট করানো হলো লন্ডনে গিয়ে। ওরাই কনফার্ম করলো রোগটা আসলে ক্যান্সার ছিল। কি দুর্ভাগ্য!
এর পরে চিকিৎসায় অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেছে। এ পর্যায়ে ক্যান্সার চিকিৎসায় আল্টিমেটলি কোন ফল দিতে পারল না। সবাইকে ছেড়ে দিয়ে সে ২০১৫ এর ২৯ এপ্রিল চলে গেল অন্য জগতে।
রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম হলেও অন্যদের চেয়ে সে ছিল ব্যতিক্রম। এমন একজন ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরীকে হারিয়ে আমিও শোকাহত ও মর্মাহত।
একটি বিশেষ দিনের উল্লেখ না করে পারছিনা। আমার মেয়ের বৌভাতের অনুষ্ঠান। চট্টগ্রাম ক্লাব সুইমিংপুল সাইটে। তারিখটা ছিল ২৮ ফেব্রæয়ারি ২০১৩। ঐদিন সারাদেশে টানটান উত্তেজনা, হরতাল, মিছিল, অবরোধ। চারিদিকে ভীষণ গÐগোল। বেলা ২ টার পর থেকে সাধারণ জনগণ রাস্তা নেই। সন্ধ্যার পর থেকে রাস্তা একেবারে ফাঁকা। মুহুর্মূহু হাত বোমা ফুটছে। রাস্তায় একটা রিক্সাও নেই। খুব স্বল্প সংখ্যক অতিথি এসেছে। তাও পায়ে হেঁটে। এর মধ্যেই সাইফুদ্দিন তার পরিবার নিয়ে হাজির। কি উৎকণ্ঠায় ঐদিন কাটিয়েছি। অনেকক্ষণই সে আমাদের মাঝে ছিল। আমার মেয়ে-মেয়ে জামাইকে সে আশীর্বাদ করে গেল। এমন বন্ধু সাইফুদ্দিনকে আমি কিভাবে ভুলি!
আজকের এই দিনে, এই মৃত্যুবাষির্কীতে তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি মহান স্রষ্টার কাছে। তার পরিবারের সকল সদস্যদের জন্য মঙ্গল কামনা করছি।

লেখক: হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ