সুশাসন ও পরিশুদ্ধ গণতন্ত্র

79

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

এটি সর্বজনবিদিত যে, সততা-স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার সমীকরণে সুশাসনের রসায়ন আবর্তিত হয়। প্রাগ্রসর সমাজের ইতিহাস-দর্শন এই সত্যই প্রকীর্ণ করেছে যে; সুশাসন সুদৃঢ় ব্যতিরেকে টেকসই উন্নয়ন বাস্তবায়ন শুধু দূরূহ নয়, বহুলাংশে অবিশ্বাস্যই বটে। বস্তুতপক্ষে রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থাপনায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে অবজ্ঞা করার মধ্যেই সুশাসনের অরাজক পরিবেশ বিরাজিত। ইতিহাসের শিক্ষাই হচ্ছে এই; স্বৈরাচার বা সামরিক শাসকদের অবৈধ ও অনৈতিক ক্ষমতার যথেচ্ছাচার সুশাসনের ভিত্তিকে বরাবরই অশাষ্য করে রাখে। এর পিছনে প্রণিধানযোগ্য কারণ হচ্ছে, ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রযন্ত্রের নিকৃষ্টতম অপব্যবহার এবং সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের মোড়কে দুর্নীতি-সন্ত্রাস-অপকর্ম-অনিয়ম ও সমাজগর্হিত অগ্রহণযোগ্য নির্লজ্জ কর্মযজ্ঞের অনুশীলন।
বিগত বেশ কিছুকাল ধরে মুক্তির মহানায়ক জাতির জনকের সুযোগ্য তনয়া বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে প্রচন্ড প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সুশাসন প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়ে অপ্রতিরোধ্য শুদ্ধি অভিযানের সূচনা করেছেন। অব্যাহত এই অভিযাত্রায় গুটিকয়েক অধীনস্ত আজ্ঞাবহ কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং জঘন্য চরিত্রের মানবরূপী ভয়ংকর দানবদের চিহ্নিত করে কঠোর আইনের আওতায় আনা হয়েছে। কিন্তু জনশ্রæতি রয়েছে; কথিত রাজনৈতিক-সামাজিক-বাণিজ্যিক কর্তা ব্যক্তিদের বিপুল অংশ এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। সুখের খবর হচ্ছে এই; অতিসম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতি ও অপকর্ম নিধনে সকল পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পন্থা উদ্ভাবনে নির্দেশনা দিয়েছেন। অধিকন্তু দৃঢ়কন্ঠে সেনা শাসকদের আমলে ঘৃণ্য সুবিধাভোগীরা যাতে দল বা সরকারে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সে সম্পর্কে সকলকে সতর্ক করেছেন। যদিও ত্যাগী দেশবাসী নিদারুণ কষ্টের সাথে পরিলক্ষিত করছে যে; বিগত দশ-এগার বছর সামরিক শাসকদের কদর্য তোষামোদকারী-দেশ ধ্বংসের জন্য দায়ী হিং¯্র বর্ণচোরা-অনুপ্রবেশকারী-পরাজিত অন্ধকারের শক্তির পৃষ্ঠপোষক, জঙ্গী-মাদক-তদবির-লবিং-টেন্ডার ও নিয়োগ বাণিজ্যসহ প্রায় সকল ক্ষেত্রেই সুক্ষ অপকৌশলে শক্ত অবস্থান নিয়েছে।
মিথ্যাচার, প্রতারণা, শঠতা, ছলচাতুরী ও নিপুণ অভিনয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন ছদ্মবেশে এরা সরকারি-বেসরকারি প্রায় সংস্থা-প্রতিষ্ঠানে পদ-পদায়ন দখলে নিয়েছে। অত্যন্ত সুপরিকল্পিত এবং সুকৌশলে স্বাধীনতার অর্থবহ অগ্রগতি এবং দেশকে পশ্চাৎপদ রাখার অদৃশ্য নষ্ট পন্থায় পরাজিত শক্তির এজেন্ডা বাস্তবায়নে প্রতিনিয়ত সক্রিয় রয়েছে। অনৈতিক রাজনৈতিক শক্তিকে ব্যবহার করে দ্রæততার সাথে অবৈধ ব্যবসা ও সম্পদ অর্জনের জন্য পেশী-তদবির-নানামুখী লোপাপত্তির মাধ্যমে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বেশকিছু ব্যক্তি দেশকে সন্ত্রাস ও দুর্নীতির অভয়ারণ্যে পরিণত করেছে। দারুণভাবে কলুষিত হয়েছে রাজনৈতিক সংস্কৃতি। দেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন ভাষণে গুরুত্বের সাথে এসব বিষয় অবতারণা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘রাজনীতিতে এ সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে, অন্যথায় রাজনীতি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ও আগ্রহ কমে যাবে। সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে ওঠার পথ রুদ্ধ হবে। রাজনীতি তখন আর রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে না, যা কোন ভাবেই কাম্য নয়।’ মূলতঃ মেধা-যোগ্যতা বিচ্যুত রাজনৈতিক বদান্যতায় সাময়িক বিভিন্ন পদ-পদবী দখল করা যায়, তবে তা সততা-সত্যবাদীতা-আদর্শের বিপরীত স্রোতে প্রবাহমান – এটিই ইতিহাস স্বীকৃত। সভ্যতার বাস্তবতা এই যে; সচেতন আপামর জনগণের আস্থা-বিশ্বাস -সমর্থন ব্যতীত অশুভ নেতৃত্বের বিকাশ দেশকে অনগ্রসরতার পথেই এগিয়ে নেবে, কখনো আধুনিক-মানবিক-প্রাগ্রসরতার পথে নয়। এই ধরণের রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিস্তার ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয় এবং জনগণের সম্পদ লুন্ঠনে অসম লুম্পেন প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করে।
রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রবক্তা গ্যাব্রিয়েল এ আলমন্ড এর ধারণায়, এটি একটি পরিপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যবস্থা যা সুনির্দিষ্ট কর্মযজ্ঞের অনুশীলণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জনগণকে আচরণগত শিক্ষায় পরিশীলিত করে। সংস্কৃতির অনন্য উপাদান -মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি, শিক্ষা, নৈতিকতা, আদর্শ ইত্যাদিকে ধারণ করেই প্রতিশ্রæতিবদ্ধ আত্মশুদ্ধি ও আত্মমর্যাদায় বলিয়ান ব্যক্তিত্বের সমন্বয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশমানতাকে ঋদ্ধ করে। লুসিয়ান পাই এর মতে, ÒThe notion of political culture assumes that the attitudes, sentiments and cognitions that inform and govern political behavior in any society are not just random congeries but represent coherent pattern which fit together and are mutually reinforcing. In spite of the great potentialities for diversity in political orientations, in any particular community there is a limited and distinct political culture which gives meaning, predictability and form to the political process.”
উল্লেখিত সংজ্ঞায় রাজনৈতিক সংস্কৃতির পূর্ণাঙ্গ পরিচয় পাওয়া যায়। সমাজ-রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এরিক রৌউই, রেইম্যাক রিডিস্সহ প্রায় মনীষী একই ধরনের ধারণা পোষণ করেছেন। এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একজন রাজনৈতিক ব্যক্তির জীবনোপায় বা জীবন নির্বাহের পর্যাপ্ত সক্ষমতা। অন্যের উপর নির্ভরশীল জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত কোন ব্যক্তির পক্ষে আদর্শিক-সৎ-যোগ্য-ত্যাগী নেতৃত্বের গুণাবলী অর্জন দু:সাধ্য। মনীষী কার্ল মার্কসসহ অনেকেই এই বক্তব্যে বিশ্বাসী অর্থাৎ জীবন নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ বা আর্থিক প্রণোদনা (subsistence economy) ব্যতিরেকে ত্যাগী নেতৃত্বের বিকাশ সম্ভব নয়। মোদ্দা কথায় a subsistence economy is a non-monetary economy wherein basic needs are fulfilled by the acquisition and use of natural resources on the personal, family, or local level. কঠিন এই বাস্তবতার অভাব যোগ্য নেতৃত্বের অনুকূলে অবশ্যই পরিবেশিত নয়।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর মহান বাবা শেখ লুৎফর রহমান সাহেব তাঁকে বলেছিলেন, “বাবা রাজনীতি কর আপত্তি করব না, পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছ এ তো সুখের কথা, তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবে না । আর একটা কথা মনে রেখ, sincerity of purpose and honesty of purpose’ থাকলে জীবনে পরাজিত হবা না।” বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে অত্যন্ত আবেগ জড়িত বাক্যে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, তাঁর পিতার এই অমর উপদেশ বাণীকে রাজনৈতিক জীবনের পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। পাকিস্তান আন্দোলনের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে শহরের কতিপয় গণ্যমান্য ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর বাবাকে তাঁর জীবন নষ্ট হওয়ার সংশয়ে কিছু বক্তব্যের প্রেক্ষিতে তিনি বলেছিলেন, “দেশের কাজ করছে, অন্যায় তো করছেনা; যদি জেল খাটতে হয়, খাটবে; তাতে আমি দুঃখ পাব না। জীবনটা নষ্ট নাও তো হতে পারে, আমি ওর কাজে বাধা দিব না। আমার মনে হয়, পাকিস্তান না আনতে পারলে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না।” পরিশুদ্ধ রাজনীতিকের জন্যsubsistence economy’র গুরুত্বের বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর পিতার বক্তব্য অতীব প্রদ্যুতিত। তিনি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, “আমাদের জন্য কিছু করতে হবে না। তুমি বিবাহ করেছ, তোমার মেয়ে হয়েছে, তাদের জন্য তো কিছু একটা করা দরকার।” আমি আব্বাকে বললাম, ‘আপনি তো আমাদের জন্য জমি জমা যথেষ্ট করেছেন, যদি কিছু না করতে পারি, বাড়ি চলে আসব। তবে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া চলতে পারে না।’ কোন এক সময় গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘দেশ সেবায় নেমেছি, দয়া মায়া করে লাভ কি? দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালোবাসলে ত্যাগ তো করতেই হবে এবং সে ত্যাগ চরম ত্যাগও হতে পারে।’
আমাদের সকলেরই কমবেশি জানা যে, গণতন্ত্র যে কোন সমাজ ব্যবস্থায় একটি রাষ্ট্র বা সরকার পদ্ধতিকে নির্দেশিত করে। একনায়কতন্ত্র বা রাজতন্ত্রের বিপরীতে জনগণের শাসন বা শাসন নীতিকে ধারণ করে সম্মিলিত ইচ্ছানুসারে পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে গণতন্ত্র বলে আখ্যায়িত করা যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীর খ্যাতিমান দার্শনিক জ্যাঁ জ্যাঁক রুশো বলেছিলেন, “Man is born free but everywhere he is in chain” অর্থাৎ জন্মগতভাবে মানুষ স্বাধীন হলেও জীবনযাত্রার সর্বত্রই সে শৃংখলআবদ্ধ। ক্ষুদ্র শাসকশ্রেণী কর্তৃক বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে শাসন-শোষণের যে প্রবাহমান প্রক্রিয়া তারই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন জাতি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ এবং বিধি বিধানের কঠিন আবরণে জনগণের শাশ্বত সাবলীল জীবনধারাকে করা হয় শৃংখলিত। এভাবে মানুষের সহজাত এবং বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় মানবিক বিকাশধারা থেকে বিচ্যুত হয় মানবকূল এবং রুদ্ধ করা হয় তাদের স্বাভাবিক বুদ্ধিবৃত্তি ও মানবিক মূল্যবোধ তথা সত্য, সুন্দর, কল্যাণ ও আনন্দের আদর্শজাত মননশীল চিন্তা চেতনা। রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়টি সমাজে ক্রম বিকাশের ধারায় প্রাচীনকাল থেকেই বিদ্যমান। খ্রীষ্টপূর্ব ২৪০০ বৎসর পূর্বে হেরোডেটাস (484-424 BC) কর্তৃক প্রণীত গণতন্ত্রের ধারণাকে এখনও স্বাভাবিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মৌলিক কাঠামোর অতি নিকটতর মনে করা হয়। আদিম মানবগোষ্ঠীর সহজ-সরল শাসন ব্যবস্থাকে স্বাভাবিক ধরে রাজতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্র নামক অস্বাভাবিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিপরীতে জনগণ জীবন ব্যবস্থা রূপে গণতন্ত্রকে বেছে নেবে- এই ইঙ্গিত প্রায় সকল সমাজ ও রাষ্ট্র দিয়ে গেছে। আমরা জানি, প্রাচীন গ্রীস ও রোম এর সরকার পরিচালনায় নাগরিকের অংশগ্রহণের অধিকার প্রচলিত ছিল। প্রাচীন গ্রীসে সীমিত সংখ্যক জনসংখ্যা অধ্যুষিত ছোট ছোট নগরকেন্দ্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকেরা সরাসরি ভোট দিত। কিন্তু এসব গণতন্ত্রে নিম্নবিত্ত কিংবা ক্রীতদাসদের কোন স্থান ছিল না। জনপ্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার বহু পূর্বে ইংল্যান্ডে পার্লামেন্ট সরকার চালু ছিল। ইংল্যান্ডে প্রায় হাজার বছর পূর্বে হাউজ অব ল’স প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে ইংল্যান্ডে আইন প্রনয়ণে হাউজ অব কমন্স এর অংশগ্রহণ কারো অজানা নয়। সামগ্রিক অর্থে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বহু পূর্ব থেকেই অভিজাত শ্রেণীর প্রতিনিধিরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও সংখ্যালঘিষ্ঠতার ভিত্তিতে সংসদীয় শাসন পরিচালনা করত। এই সংসদীয় কাঠামো বজায় রেখে ইংল্যান্ডে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় অনেক পরে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরেও বহুকাল ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় নারীদের ভোটাধিকার ছিল না। আধুনিককালে প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে নির্বাচিত ব্যক্তিবর্গের আইন পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করার মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার যে ব্যবস্থা, তাকেই বর্তমানে গণতন্ত্রের মূল প্রত্যয় হিসেবে অভিহিত করা হয়।
মূলত: এর উৎপত্তির পিছনে রয়েছে শিল্প বিপ্লবের ধারাবাহিকতায় ফরাসী বিপ্লবের যে দার্শনিক ভিত্তির গোড়াপত্তন তথা সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার চেতনার বাস্তব অভিব্যক্তি। এর সর্বোত্তম স্বরূপ উম্মোচিত হয়েছে আব্রাহাম লিংকনের ইতিহাসসমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক সরকারের সংজ্ঞায় – Government of the people, by the people and for the people। যদিও ইংল্যান্ডে বেশ কিছুকাল আগেই রাজা কর্তৃক নাগরিকদের সনাতন অধিকার খর্ব করার প্রতিবাদে সপ্তাদশ শতাব্দীতে সংঘটিত সংঘাতের ফলশ্রুতিতে প্রণীত The Petition of Right , 1628 এবং The Bill of Rights, 1689 রাজার একচ্ছত্র ক্ষমতাকে খর্ব করে আইনসভা ও বিচারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার উদাহরণ রয়েছে, গণতন্ত্রের আদর্শকে উজ্জীবিত করার মৌলিক ধারাবাহিকতা ১৭৭৬ সালে আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলন ও ১৭৮৯ সালে ফরাসী বিপ্লবের গৌরবগাঁথায় পরিপূর্ণ।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর লাস্কির ভাষায় ‘কোন রাষ্ট্র পরিচালিত হয় সে রাষ্ট্রের নাগরিকদের প্রদত্ত অধিকার দ্বারা’ এবং গণতন্ত্রকে যথার্থ মর্যাদায় আসীন রাখতে পারে জনগণের সঠিক চেতনা ও সতর্ক পাহারা যেটি লাস্কির ভাষায়- eternal vigilance is the price of liberty। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অনেক অন্তর্নিহিত দুর্বলতা বা গুটিকয়েক ব্যক্তি বা ক্ষুদ্রতর গোষ্ঠীর ক্ষমতা করায়ত্তের মাধ্যমে গণতন্ত্র অনুশীলন করা হলেও এটি গণতন্ত্রকে “least arbitratory and most responsible, least drastic and most considerate” অর্থাৎ “সবচেয়ে কম স্বৈরাচারী সবচেয়ে বেশি দায়িত্বশীল, সবচেয়ে কম কঠোর এবং সবচেয়ে বেশি সহানুভ‚তিশীল” বৈশিষ্ট্যের কারণে প্যারেটো, র‌্যাকো এবং সমবার্ট এর মত কতিপয় সমাজ-রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ব্যতীত প্রথিতযশা প্রায় সকলেই গণতন্ত্রের দুর্বলতা, অপূর্ণতা ও অপপ্রয়োগ স্বীকার করেও এর অপরিহার্যতা দারুণ সমর্থন করেছেন।
গণতন্ত্র চর্চা ও অনুসরণ পটভূমিতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর স্বাধীনতা ও মুক্তি তথা মানবজাতির মুক্তির সনদ হিসেবে জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ২১তম অনুচ্ছেদের ৩নং ধারা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘সরকারের কর্তৃত্বের ভিত্তি হবে জনগণের ইচ্ছা যা নির্দিষ্ট সময় অন্তর সার্বজনীন ও সমান ভোটাধিকারের ভিত্তিতে গোপন ভোটের মাধ্যমে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান অর্থাৎ জনগণের ইচ্ছার প্রকৃত প্রতিফলন’ জাতিসংঘ ঘোষিত এ নীতিমালা গণতান্ত্রিক ধারাকে সমগ্র বিশ্বে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। অনুচ্ছেদের ১নং ধারা বিশ্বের প্রত্যেক ব্যক্তিরই স্বাধীনভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে দেশের শাসনকার্য পরিচালনায় অংশগ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করেছে, অর্থাৎ যথার্থভাবে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা সমুজ্জল হয়েছে। গণতন্ত্র শুধু যে সরকার সম্পর্কিত তথ্য তা কিন্তু নয়। আধুনিক গণতন্ত্রের বিজ্ঞতাত্বিক লিন্ডসের ভাষায়, গণতন্ত্র একটি সামাজিক প্রক্রিয়া বটে। এটি মূলত: কতগুলো রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও সামাজিক মূল্যবোধের সমন্বয়, পরিচর্যা ও প্রতিফলন।
গণতন্ত্রের প্রাথমিক মূল্যবোধ হচ্ছে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ অর্থাৎ ব্যক্তির মৌলিক স্বাধীনতা তথা চিন্তা-বাক-সংগঠন-ভোট দান-দলগঠন- নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া ও অংশগ্রহণ-ভোট প্রদান-অভিযোগ স্থাপনের যথার্থ স্বাধীনতা। সার্বিকভাবে জীবনধারণ-পরিবার গঠন-নিরাপত্তা-আইনের আশ্রয়প্রাপ্তি-স্বাধীন মতামত প্রকাশ-নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করা ও বিরোধিতার অধিকার ইত্যাদি সকল কিছুকেই অন্তর্ভুক্ত করে। গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ব্যক্তিত্ব বিকাশের সাথে অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ হচ্ছে পরমতসহিষ্ণুতা, সহনশীলতা, অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতকে সাদরে গ্রহণ করার মানসিকতা। দার্শনিক ভল্টেয়ার (১৬৯৪-১৭৭৮) বলেছেন, “তোমার মতের সাথে আমি একমত নাও হতে পারি, কিন্তু তোমার মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে রক্ষার জন্য প্রয়োজন হলে প্রাণ দেব”। উপরোক্ত বিষয়সমূহের পর্যালোচনায় সমধিক বিবেচিত বিষয় হচ্ছে, পরিশুদ্ধ গণতন্ত্রের মোড়কে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ থেকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে সুশাসনের কার্যকর উদ্যোগ দৃশ্যমান করা না হলে যে কোন জাতি-রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারের চলমান কর্মকান্ড স্বাভাবিকতায় প্রশ্নবিদ্ধ এবং জনগণের আস্থা অর্জনে সঙ্কট তৈরি করতে পারে।

লেখক: শিক্ষাবিদ, সমাজ বিজ্ঞানী, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়