সুলতানে হিন্দ খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (র.)

69

আবু তালেব বেলাল

মুইন আল দীন হাসান সনজরি, মুইন আল দীন চিশতী, শেখ মুইন আল দীন, গরীব ই নেওয়াজ, খাজা আজমিরসহ আরও অসংখ্য নামে তিনি পরিচিত। ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, ১১৪১ খ্রিস্টাব্দে (৫৩৬ হিজরি) পূর্ব পারস্যের সিসটান রাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ)। তার বাবার নাম সৈয়দ গিয়াস আল দীন। পারস্যের (বর্তমান ইরান) বুকেই তাঁর বেড়ে ওঠা। মাত্র পনেরো বছর বয়সে বাবা-মাকে হারান তিনি। উত্তরাধিকার সূত্রে বাবার কাছ থেকে একটি উইন্ডমিল এবং ফলের বাগান লাভ করেন তিনি। কথিত আছে, একদিন তিনি তাঁর ফলবাগানে পানি দেয়ার সময় বিখ্যাত সুফি শেখ ইব্রাহীম কুন্দুজী সেখানে উপস্থিত হন। কিশোর মঈনুদ্দিন তাকে দেখে চমকে যান, কীভাবে তাকে আপ্যায়ন করা যায় তা নিয়ে তটস্থ হয়ে পড়েন। এরপর তিনি নিজের ফলবাগান থেকে কিছু ফল নিয়ে কুন্দুজীর সামনে পরিবেশন করেন। কুন্দুজী খুশি হয়ে এর প্রতিদান হিসেবে তাকে এক টুকরো রুটি খেতে দেন। সব মিলিয়ে তাঁর মনে ইসলামের প্রতি গভীর আকর্ষণ জন্ম নেয়। তিনি তাঁর যাবতীয় সম্পত্তি দরিদ্রদের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে সংসারের মায়া ত্যাগ করে জ্ঞানার্জন এবং উচ্চশিক্ষার উদ্দেশে বুখারায় পাড়ি জমান। গরিবদের প্রতি তাঁর অসীম মমতা ছিল, সবসময় তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতেন তিনি। এ কারণেই তাকে ‘গরিবে নেওয়াজ’ বলে ডাকা হয়।
বুখারা আর সমরকন্দে বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে অংশগ্রহণ করে সেসময়কার বিশিষ্ট আলেম ও মাশায়েখদের কাছ থেকে ইসলমি শরিয়ত ও ত্বরিকতের শিক্ষা লাভ করেন খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি। ভ্রমণকালে তিনি মুহাম্মাদ ইসমাঈল আল বুখারী (রা.) এবং বিশ্ববিখ্যাত ইমাম আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সাংগঠনিক রূপকার হজরত আবু মানসুর আল মাতুরিদি (রা.) মাজার জিয়ারত করেন বলেও জানা যায়। ইরাক যাওয়ার পথে খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী বোখারা থেকে আগে নিশাপুরে আসেন। সেখানে চিশতীয়া তরিকার অপর প্রসিদ্ধ সুফি সাধক খাজা উসমান হারুনীর সংস্পর্শে আসেন খাজা মঈনুদ্দিন। তাঁর নিকট শিষ্যত্ব গ্রহণ করে মুরীদের দলে যোগ দেন তিনি। প্রায় বিশ বছর ধরে খাজা উসমানের সেবায় একাগ্রভাবে নিয়োজিত থাকা মঈনুদ্দিনকে খেলাফত পীর সাহেবের সন্তুষ্টিত অর্জন করেন এবং খিলাফত লাভ করেন। এই দীর্ঘ সময়ে দেশ থেকে দেশে ঘুরে বেড়ান তিনি। এ সময় তাঁর সাথে দেখা হয় বিশিষ্ট সব সুন্নী ওলামায়েকেরাম, বিশেষজ্ঞ, পÐিত ও দার্শনিকদের। তাদের মধ্যে ছিলেন গাউসুল আজম দস্তগীর পীরানে পীর শেখ সৈয়্যদ হজরত আবদুল কাদির জিলানী (রা.), হজরত নাজমুদ্দিন কুবরা, শেখ আব্দাল কাহির সোহরাওয়ার্দী, আবু সাঈদ তাবরিযী প্রমুখ।
হজরত গাউসুল আজম আবদুল কাদির জিলানী (রা.) এর সাথে তাঁর সম্পর্ক এতোই গভীর ছিল যে, কিছু কিছু জায়গায় খাজা মঈনুদ্দিনকে তাঁর ভাগ্নে বলেও উল্লেখ করা হয়। তাঁর জীবনীতে বর্ণিত আছে, ইরাকের বাগদাদে আবদুল কাদির জিলানীর সাহচর্যে ৫৭ দিন অবস্থান করেন তিনি। এ সময় জিলানী তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “ইরাকের দায়িত্ব শেখ শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দীকে আর হিন্দুস্তানের দায়িত্ব আপনাকে দেয়া হলো।”
সে সময় বাগদাদ, তাবরিয, ইস্পাহান, বালখ, গজনীসহ মুসলিম শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রায় সব বিশাল কেন্দ্রই তিনি সফর করেন, যার ফলে তাঁর জ্ঞানভাÐারে মধ্যযুগীয় মুসলিম জীবনের প্রায় সব তথ্যই সন্নিবেশিত হয়। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে তিনি ভারতের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। পথিমধ্যে লাহোরে সুন্নী আইনশাস্ত্রের পÐিত এবং বিশেষ শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি আলী হুজুরির মাজার জিয়ারত করেন। লাহোর থেকে সোজা আজমিরের পথে পা বাড়ান তিনি। আজমিরে এসে তিনি বিয়ে করেন। সপ্তদশ শতাব্দীর ঐতিহাসিক আব্দাল দিহলাঈয়ের মতে খাজা মঈনুদ্দিনের দুজন স্ত্রী ছিলেন। বলা হয়, স্থানীয় হিন্দু এক রাজার কন্যাকে তিনি স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন। আবু সাঈদ, ফাখর আল দীন এবং হুসাম আল দীন নামক তিন পুত্র আর বিবি জামাল নামক এক কন্যার পিতা ছিলেন তিনি।
আজমিরে স্থায়ী হওয়ার পর চিশতী তরিকা আরও সুদৃঢ় করতে এবং তার ব্যাপ্তি বাড়াতে তৎপর হন খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ)। তাঁর হাত ধরে ভারতে প্রায় নব্বই লাখ মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। তাঁর একটি বিখ্যাত গ্রন্থ রয়েছে, যার নাম ‘আনিসুল আরওয়াহ’। বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের বর্ণনা থেকে পাওয়া যায়, খাজা মঈনুদ্দিনের সদয় আর ন¤্র ব্যবহার স্থানীয়দের মন ছুঁয়ে যায়। তাঁর অসংখ্য কারামাত বিশ্ব ইতিহাসে সমাদৃত। একদিন খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (র.)-এর এক মুরিদ তাঁর কাছে অভিযোগ করেন, রাজ্যপাল তাকে নিদারুণ হয়রানির শিকার করেছে এবং রাজ্য থেকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়েছে। দরিদ্র লোকটির যাওয়ার মতো আর কোনো জায়গা ছিল না। খাজা মঈনুদ্দিন তাকে বাড়ি ফিরে যেতে বলেন। লোকটি নির্বাসনের কথা বলতেই তিনি বলেন, আল্লাহ্ রাজ্যপালকে যথাযথ শাস্তি দিয়েছেন, এসব নিয়ে তাকে আর চিন্তা করতে হবে না। লোকটি বাড়ি ফিরে গিয়ে জানতে পারে, শিকার করতে গিয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে অবিচারক সেই শাসক। এমন আরও অসংখ্য আধ্যাত্মিক ঘটনার সাথে জড়িয়ে আছে গরিবে নেওয়াজ, সুলতানে হিন্দ হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (র.) এর নাম। ভারতীয় উপমহাদেশে চিশতীয় ধারার সবচেয়ে বিখ্যাত সুফি সাধক তিনি, তাঁর হাত ধরেই তের শতাব্দীর শুরুর দিকে এখানে প্রথম চিশতী ধারা প্রতিষ্ঠিত হয় ও পরিচিতি লাভ করে। ভারতে চিশতী ধারার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক ধারা বা সিলসিলা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে পরবর্তীতে হজরত বখতিয়ার কাকী, বাবা, ফরিদগঞ্জে বকশ, হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়াসহ তাঁর অনুসারীরা ভারতের ইতিহাসে সুফিসাধনাকে নিয়ে যান অন্য উচ্চতায়। দিল্লীতে চিশতীয়া তরিকার প্রসার ঘটাতে বাখতিয়ার কাকী (র.) নিযুক্ত করেন তিনি।
১২৩৬ সালে বৃদ্ধ খাজা সাহেব একবার নামাজ পড়তে তাঁর ঘরে ঢোকেন। অনুসারীদের তিনি বলে যান, কেউ যেন তাঁর ঘরে প্রবেশ না করে বা ঘরের দরজা না খোলে। কিন্তু ছয়দিন পরও যখন তিনি ঘর থেকে বের হলেন না কিংবা মুরিদদের শত ডাকের কোনো উত্তর দিলেন না, তখন তারা দরজা ভেঙে ঘরে প্রবেশ করে খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (র.) এ প্রাণহীন দেহ দেখতে পান। তখন তাঁর কপালে আরবিতে লেখা দেখতে পেয়েছিলেন সবাই ‘মাতা লিল্লাহি তুহিব্বু লিল্লাহি’ মৃতদেহ উদ্ধার করেন। এ কারণেই প্রতি বছর আজমির শরীফে ১ রজব থেকে ৬ রজব টানা ছয়দিন ব্যাপী গরীবে নেওয়াজের ওরস পালিত হয়। এসময় হজরতের বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর। ছেলে খাজা ফখর আল দীন চিশতী (র.) তাঁর জানাজার নামাজের ইমামতি করেন। আজমির শরীফের পবিত্র হুজরায় তাঁকে দাফন করা হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, সুলতান মুহাম্মদ গজনী, সুলতান মুহাম্মদ ঘুরী, মুহাম্মদ বিন তুঘলক, স¤্রাট আকবর, স¤্রাট জাহাঙ্গীরসহ আরও অনেক নামজাদা ব্যক্তি তাঁর মাজার শরীফ জিয়ারত করতে আসেন। এখনো পর্যন্ত ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের মধ্যে আজমির শরীফে গিয়ে খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (র.) এর মাজার জিয়ারত করে তাঁর ফয়ুজাত গ্রহণ করেন।

লেখক : কলেজ শিক্ষক, সাংবাদিক