সুরক্ষার পণ্য নিয়েও ভেজালের রমরমা

47

করোনাকালে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি ব্যক্তিগত পর্যায়ে স্বাস্থ্য-সুরক্ষায় মাস্ক ও জীবাণুনাশকসহ নানা পণ্য-সামগ্রীর চাহিদা বেড়ে যাওয়াকে পূঁজি করে বাজারে ভেজালের রমরমা কারবারে নেমেছে অসাধু ব্যবসায়ী চক্র। সুরক্ষার বিভিন্ন পণ্যও তারা নকল আর ভেজাল মিশিয়ে উৎপাদন ও বাজারজাত করছে। এতে ভোক্তা কিংবা সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য-সুরক্ষার বদলে আরও বেশি ঝুঁকিতেই পড়ছে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য-বিশেষজ্ঞরা। অনুমোদনহীন এসব সুরক্ষা-সামগ্রী ওষুধের দোকান বা ফার্মেসী ছাড়াও ফুটপাতে পসরা সাজিয়ে বিক্রি করছেন অনেকে।
আকার আর বেশ-ভূষায় দেখতে স্যাভলনের মত মনে হলেও কিন্তু তা আসল স্যাভলন নয়। জীবাণুনাশকের বাজারে দীর্ঘসময় ধরে জনপ্রিয় এই ব্র্যান্ডের নামে বিক্রি হচ্ছে নকল পণ্য। বোতলের গায়ে পণ্যের নামে দুয়েকটি অক্ষর এদিক- সেদিক করে ভোক্তার চোখে ধূলো দেয়ার চেষ্টা করছে অসাধু ব্যবসায়ী চক্র। এই তালিকায় রয়েছে, ‘স্যালভন’, ‘স্যাভলিন’, ‘স্যাভলক্স’, ‘স্যাভল’, ‘স্যাভরন’, ‘স্যাভোলন’, ‘স্যাভেনল’সহ আরও বিচিত্র ও বাহারি অনেক নাম। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবজনিত বাড়তি চাহিদাকে পুঁজি করে নকল ও অনুমোদনহীন জীবাণুনাশকসহ বিভিন্ন সুরক্ষা-সামগ্রীতে বাজার ছেয়ে ফেলা হয়েছে। এতে ভোক্তারা যেমন প্রতারিত হচ্ছে, তেমনি নকল ও মানহীন পণ্য ব্যবহারে বাড়ছে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি। বাজারে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান চললেও স্বাস্থ্য-সুরক্ষা সামগ্রী নিয়ে ভেজালের রমরমা কারবার যেন কিছুতেই থামছে না। নগরীর পাইকারি ওষুধের বাজারসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, জীবাণুনাশক হ্যাক্সিসল, হ্যান্ড রাব, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্র্যান্ডের নামে নকল ও মানহীন পণ্য প্রায় সবখানেই কমবেশি বিক্রি করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠিত বা অনুমোদিত দোকানদার বা ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ আড়ালে থেকে এসব নকল সুরক্ষা-সামগ্রী বাজারজাতে সহযোগিতা করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। নগরীর পাইকারি ওষুধের বাজার ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে সড়কের পাশে ফুটপাতে টেবিল বসিয়ে অস্থায়ী দোকান ও ভ্যানে করে বিক্রি হচ্ছে মানহীন নকল মাস্ক, হাত জীবাণুমুক্ত করার সামগ্রীসহ বিভিন্ন সুরক্ষা পণ্য। নকল ও মানহীন পণ্যের পাশাপাশি আসল হ্যাক্সিসল বা হ্যান্ড রাবের খালি বোতল সংগ্রহ করে তাতে রং ও মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি ভরে তা পুনরায় বাজারজাত করছে মুনাফালোভীরা। আবার অনেক বোতলের গয়ে কিছুই লেখা নেই; কিন্তু হ্যান্ড রাব ও হ্যাক্সিসল স্যানিটাইজার বা জীবাণুনাশক বলে বিক্রি করা হচ্ছে। বোতলের গায়ে হ্যান্ড-রাব লেখা জীবাণুমুক্ত করার তরল তিনশ’ ৫০ মিলিলিটার একশ’ ৬০ টাকা এবং একশ’ মিলিলিটারে ৭০ টাকা দামও ছাপা রয়েছে। মি. মাসেল নামে হ্যান্ড স্যানিটাইজার একশ’ মিলির বোতলের গায়ে দাম লেখা আছে দুইশ’ টাকা। তবে বিক্রেতারা বিক্রি করছেন একশ’ ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। বøু-লাইফ নামে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বোতলের গায়ে দাম লেখা নেই। তবে ৫০ মিলিলিটারের দাম চাওয়া হয়েছে ১০০ টাকা। এসব পণ্যের মোড়কে উৎপাদন ও মেয়াদের কোনও তারিখ ছাপা হয়নি। এমনকি পণ্যগুলো কোন প্রতিষ্ঠান আমদানি আর বাজারজাত করছে, তা-ও মোড়কের কোথাও উল্লেখ করা হয়নি।
জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত গোপন তথ্যের ভিত্তিতে গত ২৮ জুন নগরীর দেওয়ানহাট এলাকার মধ্যম সুপারিপাড়ার ‘এ আর চট্টলা কেমিক্যাল’ নামের একটি কারখানায় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ ভেজাল ও অনুমোদনহীন সুরক্ষা-সামগ্রী জব্দ করে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সেখানে গিয়ে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কেমিক্যাল আর রং মিশিয়ে নকল ও মানহীন
জীবাণুনাশকসহ বিভিন্ন সুরক্ষা সামগ্রী তৈরি ও বোতলজাতের পর বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নাম ও লেভেল সাঁটিয়ে সেসব বাজারজাত করার প্রমাণ পায়। অভিযানে কারখানা থেকে ২০ লাখ টাকা মূল্যের ক্ষতিকর নকল ও ভেজাল পণ্য-সামগ্রী জব্দ করা হয়। ওই কারখানার মালিক মো. রাশেদকে ছয় মাসের কারাদÐ ও নগদ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। কারখানাটি সিলগালা করে দেয়া হয়েছে।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. উমর ফারুক বলেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবজনিত চাহিদাকে পুঁজি করে জীবাণুনাশকসহ বিভিন্ন সুরক্ষা সামগ্রী তৈরি করতে কারখানাটির ভেতরে ক্ষতিকারক রং ও কেমিক্যালমিশ্রিত তরল প্রায় শ’খানেক ড্রামে ভর্তি করে রাখা হয়েছিল। কারখানায় কোনও কেমিস্ট ও ল্যাব নেই। কারখানার মালিক মো. রাশেদ নিজেই ওই তরলগুলো বোতলে ভরছেন। তারপর বোতলের গায়ে বিভিন্ন কোম্পানির ভুয়া লেভেল লাগিয়ে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, হ্যাক্সিসল, স্যাভলনের মত জীবাণুনাশকের নাম করে নগরী ও জেলার বাজারগুলোতে সরবরাহ করে আসছিলেন।
কনজিউমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা ক্যাব’র চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন করোনাকালে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার পণ্য-সামগ্রী নিয়ে ভেজালের রমরমা কারবারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময়ও ভোক্তা বা সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য-সুরক্ষাকে উপেক্ষা করে যারা ভেজালের কারবারে সম্পৃক্ত রয়েছেন, তাদের বোধোদয় ঘটবে বলে মনে হয়না।