সুভাষ দত্ত

3

সুভাষ দত্ত, বাংলাদেশী বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা, সিনেমা চিত্রশিল্পী ও অভিনেতা। তিনি ষাটের দশক থেকে বাংলা চলচ্চিত্রের পরিচিত মুখ। তার কর্মজীবনের শুরু হয়েছিল সিনেমার পোস্টার এঁকে। এ দেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ-এর পোস্টার ডিজাইনার হিসেবে কাজ করেন তিনি। মাটির পাহাড় চলচ্চিত্রে আর্ট ডিরেকশনের মধ্য দিয়ে তার পরিচালনা জীবন শুরু হয়। এরপরে তিনি এহতেশাম পরিচালিত এ দেশ তোমার আমার ছবিতে প্রথম অভিনয়ের সুযোগ পান। তার পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র সুতরাং (১৯৬৪)। এবং সর্বশেষ চলচ্চিত্র ও আমার ছেলে ২০০৮ সালে মুক্তি লাভ করে। এছাড়া তিনি বেগম রোকেয়া’র জীবন ও কর্ম নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করার ইচ্ছে পোষণ করলেও তা পূরণ করে যেতে পারেননি।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে তার সুদীর্ঘ কর্ম জীবনে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাকে ১৯৭৭ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার-এ শ্রেষ্ঠ প্রযোজক-পরিচালকের পুরস্কারে ভূষিত করে। এবং ১৯৯৯ সালে একুশে পদক প্রদান করে। এছড়াও তিনি দেশি-বিদেশি অসংখ্য সম্মাননা লাভ করেছিলেন।
সুভাষ দত্ত জন্মগ্রহণ করেন মামার বাড়িতে ১৯৩০ সালের ৯ ফেব্রæয়ারি দিনাজপুরের মুন্সিপাড়া নামক স্থানে। তার পৈতৃক বাসস্থান বগুড়া জেলার চকরতি গ্রামে। বসবাস করতেন পুরান ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনের নিজ বাড়িতে। স্ত্রী সীমা দত্ত ২০০১ সালের অক্টোবরে পরলোকগমন করেন। মৃত্যুকালে তিনি দুই ছেলে, দুই মেয়ে, পুত্র-পুত্রবধূ, নাতি নাতনী রেখে গেছেন। বড় ছেলে শিবাজী দত্ত দেশে থাকেন, আর ছোট ছেলে রানাজী দত্ত থাকেন সুইডেনে।, বড় মেয়ে শিল্পী দত্ত বরিশাল এবং ছোট মেয়ে শতাব্দী দত্ত রংপুর স্বামীর বাড়িতে। শ্রী সুভাষ দত্তের ভাই বোনেরা ৫ জনঃ শ্রী সুভাষ দত্ত (সবার বড়), শ্রীমতি আরতী ধাম (মৃত, সন্তানাদি ভারতে বসবাস করছেন), শ্রী বিকাশ দত্ত (সুভাষ দত্তের ইউনিটের প্রধান সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন তার জীবনের সর্বশেষ ছবি পর্যন্ত, স্ত্রী পুত্র কন্যা সমেত একই ভবনের আলাদা ফ্ল্যাটে বসবাস করছেন), গীতু তরফদার এবং ডাঃ শ্রীমতি ঝরনা দত্ত (পেশায় চিকিৎসক, সুভাষ দত্তের মৃত্যু অবধি তার পাশে ছিলেন)।
সুভাষ দত্ত সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান ও সুশিক্ষিত হওয়া সত্তে¡ও চলচ্চিত্র নির্মাণের কৌশল শিখতে ভারতের বোম্বেতে গিয়ে পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে একটি ছায়াছবির পাবলিসিটির স্টুডিওতে মাত্র ত্রিশ টাকা মাসিক বেতনে কাজ শুরু করেন। ১৯৫৩ সালে ভারত থেকে ঢাকায় ফিরে যোগ দেন প্রচার সংস্থা এভারগ্রিন-এ। এরপর তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে পদার্পণ করেন চলচ্চিত্রের পোস্টার আঁকার কাজের মাধ্যমে। ১৯৫৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এ দেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ-এর পোস্টার ডিজাইনার হিসেবে কাজ করেন তিনি। ১৯৫৮ সালে চলচ্চিত্র পরিচালক এহতেশাম এর এ দেশ তোমার আমার চলচ্চিত্রে একজন দুষ্ট নায়েব (কানুলাল) এর ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। এটি মুক্তি পায় ১৯৫৯ সালের ১ জানুয়ারি। ষাটের দশকের শুরুর দিকে নির্মিত বহুল আলোচিত হারানো দিন চলচ্চিত্রেও তিনি অভিনয় করেছিলেন। মুস্তাফিজ পরিচালিত এই চলচ্চিত্রটি মুক্তি লাভ করে ৪ আগস্ট, ১৯৬১ এবং এটি বাংলা ভাষার প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে এক প্রেক্ষাগৃহে পঁচিশ সপ্তাহ প্রদর্শনের রেকর্ড তৈরি করে। এরপর তিনি বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। চলচ্চিত্রে তিনি কৌতুকাভিনেতা হিসেবে অভিনয় করেও বেশ প্রশংসা অর্জন করেছিলেন।
১৯৫৭ সালে ভারতের হাই কমিশনের উদ্যোগে একটি চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে ওয়ারিতে। সেখানে দেখানো হয় সত্যজিৎ রায়‘র পথের পাঁচালী চলচ্চিত্রটি। এবং পথের পাঁচালী দেখেই তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে অনুপ্রাণিত হন।
১৯৬৩ সালের মে মাসে তিনি নির্মাণ শুরু করেন সুতরাং চলচ্চিত্রটি এবং ১৯৬৪ সালে এটি মুক্তি দেন। এর প্রধান অভিনেতা হিসেবে তিনি অভিনয় করেন সেই সময়কার নবাগতা অভিনেত্রী কবরী’র বিপরীতে। এবং এটি বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সম্মাননা লাভ করেছিল। ১৯৬৮ সালে জহুরুল হক ও প্রশান্ত নিয়োগির লেখা কাহিনী নিয়ে আবির্ভাব চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেন সুভাষ দত্ত এবং ছবির একটি চরিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন তিনি। একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী একবার আটক করে সুভাষ দত্তকে। তবে কয়েকটি উর্দু ছবিতেও অভিনয় করার কারণে তখন পাকিস্তানেও তিনি পরিচিত মুখ। সেই সুবাদে সেদিন পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন তাকে ছেড়ে দিতে বলেন। এবং প্রাণে বেঁচে যান সুভাষ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমিতে নির্মাণ করেন অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী, যাকে তার বানানো অন্যতম সেরা ছবি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৭৭ সালে আলাউদ্দিন আল আজাদের বিখ্যাত উপন্যাস ‘২৩ নম্বর তৈলচিত্র’ অবলম্বনে বসুন্ধরা নামের যে চলচ্চিত্রটি সুভাষ দত্ত নির্মাণ করেন- তা আজো চলচ্চিত্র সমালোচকদের আলোচনার বিষয়। সত্তর দশকের শেষের দিকে ডক্টর আশরাফ সিদ্দিকীর লেখা গল্প গলির ধারের ছেলেটি অবলম্বনে তিনি নির্মাণ করছিলেন ডুমুরের ফুল চলচ্চিত্রটি। এ দেশের চলচ্চিত্র শিল্পে তিনি একাধারে চলচ্চিত্র অভিনেতা, প্রযোজক, পরিচালক, চিত্রনাট্যকার ও শিল্প নির্দেশক ছিলেন। এবং এর প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছিল তার সৃজনশীল কর্মের ঈর্ষণীয় সাফল্য।
সুভাষ দত্ত ১৬ নভেম্বর, ২০১২ , শুক্রবার ১২ রামকৃষ্ণ মিশন রোড়, ঢাকার নিজ ফ্ল্যাট ৫ম তলার সত্যাশ্রয়ে সকাল ৭টায় ৮২ বছর বয়সে হৃদরোগসহ বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন কারণে মৃত্যুবরণ করেন। ১৭ নভেম্বর সকাল ৯টায় তার মৃতদেহ নিজ বাসভবন থেকে থেকে নিয়ে যাওয়া হয় রামকৃষ্ণ মিশনে এবং সেখানে ধর্মীয় আচারানুষ্ঠান শেষে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। তার মৃতদেহ সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত রাখা হয় শহীদ মিনারে। এ সময় পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, কবি, সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীসহ সর্বস্তরের মানুষ এখানেই তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এবং সেখানে তার স্মরণে খোলা হয় একটি শোক বই। গুণী এই শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শোক বইয়ে অনেকেই লিখেন শিল্পীর গৌরবের কথা। শহীদ মিনারে তাকে ঢাকা জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা গার্ড অব অর্নার প্রদান করা হয়। শহীদ মিনার থেকে তার মৃতদেহ দুপুরে নিয়ে যাওয়া হয় তার দীর্ঘদিনের কর্মস্থল বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন (এফডিসি)-তে। সেখানে তাকে একনজর দেখার জন্য এফডিসির কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিল্পী, কলাকুশলীরা ভিড় জমান। এফডিসিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তার মৃতদেহ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় পোস্তগোলা শ্মশানে এবং সেখানেই চির শায়িত করা হয় তাকে। সূত্র : উইকিপিডিয়া