সুন্দরবনে স্যাটেলাইটযুক্ত কচ্ছপগুলো কিভাবে এলো?

47

সুন্দরবন ও এর আশেপাশের জলাশয় থেকে সম্প্রতি বিরল প্রজাতির তিনটি কচ্ছপ উদ্ধার করা হয়, যেগুলোর শরীরে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার যুক্ত করা ছিল। কচ্ছপের শরীরে কেন এই যন্ত্র যুক্ত করা হয়েছে, এবং এর পেছনে কারা সংশ্লিষ্ট সেটা নিয়ে প্রশ্ন জেগেছে অনেকের মনে।
এ নিয়ে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের প্রধান বন কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান জানিয়েছেন বাটাগুর বাসকা নামে বিলুপ্ত প্রজাতির কচ্ছপগুলোর জীবনাচার সম্পর্কে গবেষণার অংশ হিসেবেই ওই কচ্ছপগুলোর শরীরে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার যুক্ত করা হয়েছে। যেন তাদের গতিবিধি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
মূলত এই গবেষণা প্রকল্পের আওতায় দেশি বিদেশি মিলিয়ে মোট চারটি সংস্থা কাজ করছে বলে জানা গেছে।
সেগুলো হল বাংলাদেশের বন বিভাগ, প্রকৃতি ও জীবন, ভিয়েনা চিড়িয়াখানার গবেষণা দল ভিয়েনা জু এবং যুক্তরাষ্ট্রের কচ্ছপ সংরক্ষণ বিষয়ক সংস্থা টার্টেল সার্ভাইভাল অ্যালায়েন্স- যেটা কিনা প্রাণী সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর করজারভেশন অব নেচারের অন্তর্ভুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান।
এই গবেষণা পরিচালনার কারণ হিসেবে মাহমুদুল হাসান জানান, বাটাগুর বাসকা প্রজাতির এই কচ্ছপগুলোকে সুন্দরবনের প্রকৃতিতে আর পাওয়া যাচ্ছে না।
এ কারণে বন বিভাগ এই প্রজাতির কয়েকটা কচ্ছপ নিয়ে রিয়ারিং অর্থাৎ নিবিড় পর্যবেক্ষণে লালন পালন শুরু করেছে যেন বড় হওয়ার পর প্রকৃতিতে তাদের স্বাভাবিক প্রজনন নিশ্চিত করা যায়।
পরে গত বছরের দোসরা অক্টোবর ৫টি বাটাগুরা বাসকা প্রজাতির পুরুষ কচ্ছপের শরীরে রেডিও ট্রান্সমিটারের সঙ্গে স্যাটেলাইট যুক্ত করে সুন্দরবনের ৪৩ নম্বর কম্পার্টমেন্ট এলাকা কালিরচরে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় ছেড়ে দেয়া হয়।
বাংলাদেশে এ সংক্রান্ত প্রযুক্তি না থাকায় ভিয়েনা জু এর গবেষক দল ভিয়েনা থেকেই এই স্যাটেলাইট ট্র্যাকিংয়ের কাজ করছে বলে তিনি জানান।
হাসান বলেন, এই কচ্ছপগুলোর চলাফেরা, খাওয়া দাওয়া এবং আচরণ পর্যবেক্ষণের জন্য সেইসঙ্গে এই কচ্ছপগুলো যেন প্রকৃতিতেই তাদের প্রজাতির নারী কচ্ছপদের খুঁজে বের করে বংশবিস্তার করতে পারে সেই লক্ষ্যে এই যন্ত্রটি কচ্ছপগুলোর শরীরে যুক্ত করার হয়েছে।
করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন-কেন্দ্রে এই কচ্ছপগুলোর প্রায় আড়াইশ বাচ্চাকে রিয়ারিং করার কথা জানান মিস্টার হাসান। এরমধ্যে মধ্যে ৮টি মেয়ে বাচ্চা।
তিনি বলেন, প্রকৃতি থেকে এই ফিমেল কচ্ছপের সংখ্যা কমে আসায় এই প্রজাতিটি রক্ষা করা আশঙ্কার মধ্যে রয়েছে। এ কারণে ওই পাঁচটি পুরুষ কচ্ছপকে প্রকৃতিতে ছাড়া হয়েছে। যেন কোন ফিমেল কচ্ছপ পেলে সেটা সনাক্ত করা যায়।
তবে এই রেডিও ট্রান্সমিটার যুক্ত করায় ওই প্রাণীটির শারীরিক কোন ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই বলে নিশ্চিত করেছেন হাসান।
তিনি বলেন, আমরা চাই প্রকৃতিতে এই প্রজাতির কচ্ছপগুলো রি-প্রডিউস হোক। আমাদের রিয়ারিংয়ে যে কয়টা আছে সেগুলো আমরা সুন্দরবনে ছাড়তে চাই। তার আগে এদের জীবনাচার সম্পর্কে জানা দরকার। আর সেটা করতে হয় এই রেডিও ট্রান্সমিটার দিয়েই। এতে কোন ক্ষতি নাই।
কচ্ছপগুলোর ছাড়ার কয়েক মাসের মধ্যেই তিনটি কচ্ছপকে বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধার করা হয়। প্রথম কচ্ছপটিকে স্যাটেলাইট যন্ত্রসহ মৃত অবস্থায় পটুয়াখালীতে পাওয়া যায়। কচ্ছপটির মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে এখনও কিছু জানা যায়নি। এরপর গত সপ্তাহে বাগেরহাটের মংলা উপজেলার মিঠাখালী এলাকার পুঁটিমারী খালে জেলেদের জালে আটকা পড়ে দ্বিতীয় কচ্ছপটি। স্যাটেলাইট-যুক্ত ওই কচ্ছপটির ওজন প্রায় সাড়ে ১২ কেজি বলে জানা গেছে।
কচ্ছপটি ধরার পর জেলেরা শহরের প্রধান মাছ বাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে গেলে সুন্দরবনের করমজল বাটাগুর বাসকা প্রকল্পের স্টেশন ম্যানেজার ও বন বিভাগের সদস্যরা খবর পেয়ে সেটি উদ্ধার করে আনেন।
এর দুই দিন পর গত বুধবার সুতারখালী নদীতে মাছ ধরার জালে স্যাটেলাইটসহ আটকা পড়ে তৃতীয় কচ্ছপটি। আনুমানিক ৪০ বছর বয়সের এই কচ্ছপটির ওজন প্রায় ১০ কেজি বলে জানিয়েছে বন বিভাগ। পরবর্তীতে ওই কচ্ছপটিকেও করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন-কেন্দ্র কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
জীবিত অবস্থায় উদ্ধার হওয়া দুটি কচ্ছপকে পুনরায় প্রকৃতিতে ছাড়া হবে কিনা সেটা ভিয়েনার গবেষক দলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে তিনি জানান। তবে ওই দুটি কচ্ছপ সুস্থ আছে বলে তিনি নিশ্চিত করেছেন।
যে দুটি কচ্ছপ এখনও প্রকৃতিতে আছে সেগুলো সুন্দরবন ও এর আশেপাশের অঞ্চলে আছে বলে জানান তিনি। এই গবেষণার প্রাথমিক প্রতিবেদন এই মাসের শেষে অথবা সামনের মাসে প্রকাশ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে গবেষণাটি খ্বু প্রাথমিক পর্যায়ে আছে বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন রুপালি ঘোষ। ২০০৫ সাল থেকে শুরু হওয়া এই গবেষণা প্রকল্পটির সঙ্গে শুরু থেকে যুক্ত আছেন তিনি।
তিনি বলেন, এখনও নমুনা সংগ্রহের কাজ চলছে, পুরো গবেষণা পত্র তৈরিতে আরও সময় লাগবে।