সুউচ্চ ভবনগুলো পরিণত হয়েছে একেকটি মৃত্যুকূপে

15

সুপ্রতিম বড়ুয়া

আগুন হইল সেই শক্তি, যাহার নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার মানব জীবনকে সহজতর ও সুন্দর করে। বিপরীতে, এই আগুনই অনিয়ন্ত্রিত হইয়া গেলে সমূহ সর্বনাশ। তাহার লেলিহান শিখা গ্রাস করে জগতের সুন্দর-অসুন্দর, ভালো-মন্দ সকল কিছু। সভ্যতা সৃষ্টিতেও মূল অনুষঙ্গ আগুন, ধ্বংসেও আগুন। সুতরাং আগুনকে যাহাতে শুধু সৃষ্টি বা কল্যাণকর কাজেই ব্যাপৃত রাখা যায়, সেই সচেতনতার বিকল্প নাই। কিন্তু আমরা কি ততোখানি সচেতন? দেশের বিভিন্ন স্থানে অগ্নিকান্ডের যেই সমস্ত সংবাদ পাওয়া যায়, তাহার সকল ঘটনাই হয়তো অসচেতনতার জন্য ঘটে না। কিন্তু এমন অসংখ্য অগ্নিকান্ডের ঘটনা সারা বছরই শোনা যায়, যাহার মূল কারণ অসচেতনতা ও অসাবধানতা। গার্মেন্টস শিল্পকারখানা কিংবা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বৃহৎ ভবনসমূহে অগ্নিনির্বাপণের যাবতীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও অনেক ক্ষেত্রেই আগুনের সূত্রপাত ঘটে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির শর্ট সার্কিটে। কোনো ভবনে বা কারখানায় যদি দাহ্যজাতীয় পদার্থেরও আধিক্য থাকে, তবে কঠোরভাবে নিয়মনীতি অনুসরণ করা হইলে অগ্নি দুর্ঘটনার আশঙ্কা নাই বলিলেই চলে। তারপরও কেন বারবার অগ্নিকান্ড প্রশ্নটি সবার মুখে এবং উত্তরটাও জানা; কিন্তু প্রতিকারের উদ্যোগ নেই। মূলত অগ্নি দুর্ঘটনাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা না করা, বিল্ডিং কোড না মেনে ভবন নির্মাণ এবং ভবনের চারদিকে পর্যাপ্ত পরিমাণ জায়গা না রাখা, সর্বোপরি জানমালের নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষা করাই বারবার অগ্নিকান্ড এবং ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির অন্যতম কারণ। ফ্লোর ইনটেরিয়র ডিজাইনের সময় অগ্নিঝুঁকির বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয় না। ভবনের চারপাশে পর্যাপ্ত পরিমাণ জায়গা না থাকার ফলে অগ্নিকান্ডের সময় উদ্ধারকারীরা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারে না। ফলে জানমালের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায় এবং অগ্নি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। অধিকাংশ সুউচ্চ ভবনে জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি নেই। জানমালের ক্ষয়ক্ষতি বেশি হওয়ার এটিও অন্যতম কারণ। অগ্নি দুর্ঘটনা প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই বললেই চলে। অধিকাংশ সুউচ্চ ভবনের ফায়ার এলার্ম কাজ করে না। ফলে ভবনের লোকজন যখন অগ্নিকান্ডের খবর পান ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। ১ মার্চ রাতে বেইলি রোডের যে ভবনে আগুন লেগেছে, সেটি সাততলা। এতে নানারকম খাবারের দোকান রয়েছে। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে খাবারের দোকানগুলোতে ক্রেতাদের ভিড় হয়। অনেকেই পরিবার নিয়ে সেখানে খেতে যান। ভবনটি প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় আগুন লাগার পর তা ওপরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের মাধ্যমে জানা যায়। বেইলি রোডের ব্যস্ততম এলাকায় ওই ভবনে ছিল না কোনো অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা। জরুরি অবস্থায় বের হওয়ারও কোনো ব্যবস্থা ছিল না। আমরা দেখতে পাই, অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হয় না অধিকাংশ ভবনেই। সুউচ্চ ভবনগুলোতে অগ্নিনির্বাপণের জন্য বিশেষ জলাধার নির্মাণের আইন থাকলেও অধিকাংশ ভবনেই তা নেই। ফলে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় পানির প্রাপ্যতা। উপরোক্ত অবকাঠামোগত ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পরই একটি ভবনে ইউটিলিটি সংযোগের অনুমতি দেয়ার বিধান থাকলেও কখনই তা মানা হয়নি। ফলে দেশের সুউচ্চ ভবনগুলো পরিণত হয়েছে একেকটি মৃত্যুক‚পে। উপরিউক্ত বিষয়গুলোর পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবনের কিছু খুঁটিনাটি বিষয়ও অগ্নিকান্ডের জন্য দায়ী। যেমন গ্যাসের চুলা, ত্রুটিপূর্ণ গ্যাস ও বৈদ্যুতিক লাইন, ত্রুটিপূর্ণ ও নিম্নমানের বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ, দাহ্য বস্তুর যথেচ্ছ ব্যবহার, আবাসিক এলাকায় কেমিক্যালের দোকান ও গুদাম, নিয়মিত ফায়ার সেফটি চেকিং না করানো ইত্যাদি। পরিসংখ্যান বলছে, সিংহভাগ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে থাকে বৈদ্যুতিক শর্ট-সার্কিট আর রান্নার চুলা থেকে। অগ্নিকান্ড থেকে বাঁচতে প্রথমেই প্রয়োজন সচেতনতা। জানমালের ক্ষয়ক্ষতিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে চিহ্নিত কারণগুলো সমাধানের চেষ্টা করতে হবে।
সুষ্ঠু নগর পরিকল্পনা ও ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। অন্যথায় ভবনের ইউটিলিটি সার্ভিসের সংযোগ না দেয়ার মতো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আবাসিক, বাণিজ্যিক আর শিল্পাঞ্চলকে সম্পূর্ণ পৃথক করে ফেলতে হবে। কারণ বসতবাড়ি, বাণিজ্যিক ভবন আর শিল্পকারখানার অগ্নিঝুঁকি ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা একরকম নয়।
এতে অগ্নি-নিরাপত্তা সমন্বয় করা সম্ভব হবে। ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রতিবছর সুউচ্চ ভবনগুলো পরিদর্শনের মাধ্যমে লাইসেন্সিংয়ের আওতায় আনতে হবে, যা আইনেই বলা আছে। অন্যথায় ভবনের ইউটিলিটি সংযোগ বিচ্ছিন্ন এবং বড় অঙ্কের জরিমানার বিধান থাকবে। যেসব ভবনে নোটিশ জারি করার পরও অগ্নি-নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হবে না, সেসব ভবনে ফায়ার সার্ভিস কোনো সেবা প্রদান করবে না মর্মে খোলা নোটিশ জারি করতে হবে। এতে ভবন মালিক ও ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠান উভয়েই অগ্নি-নিরাপত্তা জোরদারে বাধ্য হবে। পদক্ষেপটি কঠিন হলেও এখন তা সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। কোনো ঘটনা থেকে কেবল শিক্ষা নিয়ে বসে থাকলেই পরবর্তী ঘটনা আটকানো যায় না। ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে তা যেন আর না ঘটে বা ক্ষয়ক্ষতি কমানো যায়, তা বাস্তবায়ন করাই আসল কাজ। গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মৃত্যুর ঘটনা আমাদের দেশে একেবারেই সাধারণ।
যানবাহনে মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার নিয়ে ঘুরে বেড়ানোও খুব সাধারণ একটি ঘটনা। বলা হয়, মেয়াদোত্তীর্ণ একটি সিলিন্ডার একটি বোমার মতো মারাত্মক। চলন্ত গাড়িতে এ রকম বোমা নিয়ে দেশের অনেক স্থানেই ঘুরে বেড়াচ্ছি আমরা। যেকোনো সময় আমি বা আপনি যে গাড়িতে চড়ে বসে আছেন নিশ্চিন্তে গন্তব্যে যাওয়ার জন্য, হয়তো সেটিতেই কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যাবে। এ রকম বহু ঘটেছে আমাদের দেশে। এ বিষয় নিয়ে বহু কথা হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এই না হওয়াতেই আমাদের যত অপারগতা। গাড়িতে মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার আছে কি না, তা সাধারণ যাত্রীর জানার কথা নয়। জনগণের জীবন নিয়ে যারা ছেলেখেলা করে, তাদের বিরুদ্ধে জোরদার পদক্ষেপ কেন নেওয়া হয় না। দুর্ঘটনা ঘটার পর অনেক কিছু করার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার চেয়ে আগেভাগেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিলে সেই দিনটাই হয়তো আর দেখতে হয় না। বাড়িতে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে বহু অগ্নিকাÐের ঘটনা এবং তার ফলে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। আমাদের চোখের সামনেই যেকোনো দোকানে গ্যাসের সিলিন্ডার বিক্রি করতে দেখা যায়। অথচ আইন অনুযায়ী এ গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রির জন্য অনুমতির প্রয়োজন এবং সব ধরনের দোকানে বা যত্রতত্র বিক্রি করা যায় না। আবার এ সিলিন্ডারগুলোর মেয়াদ কতটা সতকর্তার সঙ্গে নির্ণয় করা হয়, তাইবা কতজন ব্যবহারকারী জানে। সিলিন্ডার ব্যবহারেও সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। পত্রিকার পাতায় সে বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়। সেগুলো জানতে হবে।
প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা না নিলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আর সতর্কতা আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারে। নাগরিক জীবনে অগ্নিকান্ডের ভয়াবহতা ও ভিকটিম হিসাবে আমাদের অসহায়তার অন্ত নাই। কিন্তু ‘অসহায়তা’ থাকা এই কারণে উচিত নহে যে, যথাযথভাবে পূর্ব সতর্কতা অবলম্বন করলে এবং নিজেরা সচেতন থাকলে খুব সহজেই ভয়াবহ অগ্নি দুর্ঘটনা হইতে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। গ্রামে-গঞ্জে বা ছোটখাটো শহরে কোথাও আগুন লাগলে চকিতে ত্বরিতে বাহিরের খোলা জায়গায় চলে এসে প্রাণ বাঁচানোর ছোট্ট সুযোগটুকু অনেক সময় পাওয়া যায়। কিন্তু খাঁচাবদ্ধ নাগরিক জীবনে সেই সুযোগটুকুও সুদূরপরাহত। তাই আগুন হইতে রক্ষা পেতে সম্ভাব্য অগ্নিকান্ডের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ও সচেতনতা সৃষ্টি অপরিহার্য বললে অত্যুক্তি হবে না। কী কী কারণে অগ্নিকান্ড ঘটে তাহা যেমন জানা প্রয়োজন, তেমনি আগুনের ধর্ম, উৎস, স্বভাব ও অনুঘটকসমূহ কী কী এবং আগুনের আগ্রাসী অবস্থায় পৌঁছাইবার পূর্বেই প্রাথমিক অবস্থায় কীভাবে আগুনকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা যায়, তাহা অন্তত প্রত্যেক নাগরিকেরই জানিয়া রাখা অবশ্য কর্তব্য। এটাও মনে রাখতে হবে যে, কেহ নিজে যত সচেতনই হউন, তাহার পাশের ব্যক্তিটির অসচেতনতার কারণেও সকলে অগ্নি দুর্ঘটনার শিকার হতে পারেন। তাই শুধু নিজে সচেতন হলেই কাজ শেষ হয় না, অন্যকে সচেতন করাও আমাদের সকলের নাগরিক দায়িত্ব বটে। অগ্নিজনিত দুর্ঘটনা রোধে আপাতত নিয়মকানুন মেনে চলা এবং সতর্ক থাকা প্রয়োজন। না হলে প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতি বাড়তেই থাকবে। সেটা কারোই কাম্য নয়।
লেখক: কলেজ শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক