সীতাকুন্ড যেন জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ড

47

সীতাকুন্ড প্রতিনিধি

একের পর এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ড-প্রাণহানির জন্য সীতাকুন্ড এখন যেন এক অগ্নি আতঙ্কের নাম। সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে ভয়ানক বিস্ফোরণ-আগুনের এক সপ্তাহ না যেতেই গতকাল ভয়াবহ আগুন লেগেছে ছোট কুমিরার একটি তুলার গুদামে। এলাকার আতঙ্কিত লোকজন বলছেন, ‘সীতাকুন্ড এখন যেন জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ড’।
সীতাকুÐের কুমিরায় একটি তুলার গুদামে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। তবে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত (শনিবার রাত সাড়ে ১১টা) ফায়ার সার্ভিসের ৮টি ইউনিট টানা ৭/৮ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়েও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। সকালে লাগা আগুন নেভাতে রাতে সেনা ও নৌ বাহিনীর সদস্যরা যোগ দিয়েছেন; বিমান বাহিনীর একটি দলও ঘটনাস্থলে এসেছে।
ছোট কুমিরার হিঙ্গরী পাড়া এলাকায় নেমসন কন্টেইনার ডিপো সংলগ্ন এস এল স্টিলের লোকমান হোসেনের মালিকানাধীন এ গুদাম চুক্তিতে ‘ইউনিটেক্স’ গ্রুপের কাছে ভাড়া দেয়। ইউনিটেক্স গ্রুপ ভাড়া গুদামে তুলা রেখে আসছিল। গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার সময় ইউনিটেক্সের ভাড়াকৃত তুলার গুদামে আগুন লাগে। এ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ১০ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। কমিটিকে পাঁচ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
গতকাল রাতে আগুন নেভানোর কাজের অগ্রগিত সম্পর্কে জানাতে গিয়ে এসব তথ্য জানান চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের এনডিসি তৌহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ছোট কুমিরা এলাকার নেমসন কন্টেইনার ডিপো সংলগ্ন একটি তুলার গুদামে আগুন লাগে; পর্যাপ্ত পানি না পাওয়ায় দীর্ঘ চেষ্টাতে রাতেও নেভানো সম্ভবপর হয়নি। এরপর রাতে সেনা ও নৌ বাহিনীর ছয়টি ইউনিট কাজ শুরু করে এবং বিমান বাহিনীর একটি দলও ঘটনাস্থলে এসেছে।’
ওই গুদামে ইউনিটেক্স নামে একটি কোম্পানির দুই হাজার ৭০০ টন তুলা মজুদ ছিল বলেও জানান তিনি।
এর আগে সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় আগুন নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর সহায়তা চাওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন। এদিকে রাতে জেলা প্রশাসনের গঠন করা কমিটিতে প্রধান করা হয়েছে স্থানীয় সরকার বিষয়ক উপ পরিচালক বদিউল আলমকে।
এনডিসি তৌহিদুল জানান, ‘কমিটিতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার একজন, ফায়ার সার্ভিস, শিল্প পুলিশ, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের একজন করে প্রতিনিধি, সীতাকুন্ড উপজেলার ইউএনও ও থানার ওসি, বিটিএমসি, বিটিএমইএ ও বিস্ফোরক পরিদপ্তরের একজন করে প্রতিনিধি রাখা হয়েছে।’
আগুন নিয়ন্ত্রণে না আসার দুটি কারণ উল্লেখ করে ফায়ার সার্ভিসের চট্টগ্রাম সহকারী উপ-পরিচালক আবদুল হামিদ বলেন, ‘তুলা একটি দাহ্য পদার্থ। তুলায় আগুন লাগলে মুহূর্তে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আর দীর্ঘ সময় তুলায় পানি ছিটালেও ভিতরে ভিতরে আগুন জ্বলে। আরেক কারণ হচ্ছে, ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ শুরুর অল্প সময়ের মধ্যে গুদামের আশেপাশে পানির সংকট শুরু হয়। পরে ফায়ার সার্ভিসের কয়েকটি গাড়ি ভাগ হয়ে আধা কিলোমিটার দূর থেকে পানি এনে আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ করছে। যার দরুন আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে আমাদের বেগ পেতে হচ্ছে। তবে আগুন নিয়ন্ত্রণে না আসলেও ফায়ার সার্ভিস গুদামের চারদিক নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।’
গোডাউনের সিকিউরিটি ইনচার্জ মো. দিলদার আলী বলেন, ‘আগুন লাগার সময় আমি ডিউটিতে ছিলাম না। খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে এসে দেখতে পাই, গুদামে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। কি কারণে অথবা কোত্থেকে আগুন লাগলো এই মুহূর্তে বলতে পারছি না।’
জানা যায়, আগুন লাগার খুব কম সময়ের মধ্যে কুমিরা ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে গিয়ে তা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। কিন্তু গুদামের পাশে থাকা খালে ও নেমসন ডিপোর ভিতরে থাকা পানি শেষ হয়ে যায়। পানির সংকটে পড়ে ফায়ার সার্ভিস। এরপর প্রায় আধা কিলোমিটার দূর থেকে ফায়ার সার্ভিসের ৮টি ইউনিট ভাগ হয়ে পানি এনে আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ করে।
কুমিরা ইউনিয়ন পরিষদের স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. রফিক বলেন, ‘শনিবার সকালে তুলার গুদামের পাশে মালিক লোকমান সাহেব বর্ষা সামনে রেখে টিন সংস্কারে ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে, উপর থেকে ওয়েল্ডিংয়ের ছিটকে পড়া আগুন থেকে এর সূত্রপাত।’
কুমিরা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোরশেদ হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘এস এল স্টিলের মালিক গুদামটি অপর এক প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দিলে উনারা ভাড়া হিসেবে গুদামে তুলা রাখে। তবে তিনি এটি গুদাম হিসেবে ব্যবহার করলেও এর জন্য পরিষদ থেকে ট্রেড লাইসেন্স কিংবা কোনো ধরনের অনুমতি নেননি।’
সীতাকুন্ড ফায়ার সার্ভিসের জ্যেষ্ঠ স্টেশন কর্মকর্তা নুরুল আলম দুলাল বলেন, ‘আগুন লাগার খবর পেয়ে তাদের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে তা নিয়ন্ত্রণে আনার কাজ শুরু করে। পরে কুমিরা ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিটও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। বর্তমানে তাদের চারটি ইউনিটের পাশাপাশি আগ্রাবাদসহ ফায়ার সার্ভিসের ৪টি ইউনিট নিয়ে মোট ৮টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। শুরুতে পানি সংকটের কারণে কাজে বেগ পেতে হয়েছিল। তবে দুপুরের পর নেমসন কন্টেইনার ডিপো কর্তৃপক্ষ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করলে তা দিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করি। এরপর নেমসন ডিপোতেও পানি সংকট হলে আধা কিলোমিটার দূর থেকে আমরা পানি এনে আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ করে যাচ্ছি। তবে আগুনের ঘটনায় কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। আমরাও এখনো আগুনের সূত্রপাত কোথেকে বলতে পারছি না। একেকজন একেকভাবে বলছেন। তদন্ত সাপেক্ষে তা বলা যাবে।’
সীতাকুন্ড মডেল থানার ওসি তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘আগুন লাগার ঘটনায় তাৎক্ষণিক সংশ্লিষ্টদের অবহেলা রয়েছে। কারণ গুদামটি সাধারণ টিন দিয়ে তৈরি। গত কয়েকদিন ধরে এমনিতে অতিরিক্ত তাপ পড়ছে। তার উপর ঘটনাস্থলে থাকা লোকজন বলছেন সেখানে নাকি ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করছেন। ওয়েল্ডিংয়ের আগুন থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে বলে আমি প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘যতটুকু জেনেছি গুদামটি এস এল স্টিলের লোকমান হোসেনের। তিনি ইউনিটেক্স গ্রুপকে গুদামটি চুক্তিতে ভাড়া দেন। ইউনিটেক্স গ্রুপ তুলাগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করেছেন। স্থানীয়দের সাথে আলাপকালে জানতে পেরেছি তুলা যেখানে গুদামজাত করা হয়েছে, তার পাশে গুদাম মেরামতে ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করছিল গুদাম মালিকের লোকজন। যে কোন ভাবে ওয়েল্ডিংয়ের আগুন উড়ে এসে তুলার উপর পড়ে। এতে আগুনের সৃষ্টি হয়। আর মুহূতেই আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তারপর আমরা বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছি।’