সীতাকুন্ড ট্র্যাজেডি মালিকপক্ষের সহযোগিতার ঘোষণা দ্রতই বাস্তাবায়ন কাম্য

50

 

জীবন ধারণের তাগিদেই চাকুরী করছি আর মাসিক বেতন গ্রহণ করে নিজের পরিবার চালাচ্ছি। দ্রব্যমূল্য যেভাবে বেড়ে যাচ্ছে সেভাবে আমাদের আয় বাড়ছেনা। অনেক প্রতিষ্ঠান এখনো ইচ্ছা করেই হোক অথবা অনিচ্ছা করে হোক কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি করেনি। বাজারে এমন কোণ নিত্যপন্য ও খাদ্যপণ্য নেই, যার দাম বাড়েনি। তেলের দামে জ্বলছে আগুন, এরপর গতকালের বাজেটের পর আরেকদফা রেড়েছে। ভোজ্য তেল, চাল এবং আটা ময়দার দাম বাড়ার কারণে বিগত বেশ কিছুদিন থেকেই ভোগ্যপণ্যর দাম বেশি দিয়েই কিনতে হচ্ছে। এদিকে কয়েকদিন আগে আবাসিক গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। গ্যাসের দাম বাড়ানোর সংবাদটা পত্রিকার পাতায় ছোট করেই এসেছে কারণ পত্রিকার প্রধান হেড লাইন ছিল সীতাকুÐ বিএম কন্টেইনারের ভয়াবগ অগ্নি দুর্ঘটনার সংবাদ। সীতাকুন্ডের এই দুর্ঘটনায় অনেক মানুষ হতাহত হয়েছেন। এযাবৎ ৪৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন কয়েকশত। হতাহতদের সংখ্যা বড় কথা নয়, বাস্তবতা হচ্ছে, এ হতাহত মানুষগুলোর প্রত্যেকটির আয়ে নির্ভরতা ছিল তাদের পরিবার, সন্তান-সন্ততি, মা-বাবা, ভাই-বোন ও আত্মীয়স্বজন। অনেক সন্তান তার মা বাবার দিকে চেয়ে আছে কখন তার বাবা ফিরবে, মা-বাবা বিমূড় হয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন হয়ত তার আদরের সন্তানের কখন ঘওে ফিরবে! এভাবে বিএম ডিপোর মালিকপক্ষ যারা আছেন, তাদের তিলে তিলে গড়ে তোলা একটি বিশাল বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এভাবে আগুণে পুড়ে ছাই হওয়ার দৃশ্য চোখের সামনে দেখা কত কষ্টের, কত দুঃখের-তা যারা গড়ে তারাই একমাত্র বলতে পারেন। আর আমরা যারা একচোখা তারা হয়ত অযাচিত মন্তব্যই করতে পারি। এ মন্তব্যগুলোর পরিনাম সময়ে নিষ্ঠুর আগুনের পোড়াদাগ থেকে জগণ্য ক্ষতের সৃষ্টি করে। কারণ এ বিএম ডিপো শুধু বাংলাদেশের সম্পদ নয়, এটির সাথে নেদারল্যান্ডের মত একটি দেশের বড় একটি কেম্পানিও জড়িত। যারা কয়েক দশক ধরে স্মার্টগ্রুপের সাথে এবং তার আগে নিজেরাই ব্যবসা করে আসছিল। বিএম ডিপোর সাথে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও উন্নতির সম্পর্ক আছে। এ ডিপোটির একটি অংশের মালিক স্মার্টগ্রæপ, যাদেও শিল্প কারখানায় কমপক্ষে ৩০ হাজার জনবল কাজ করে যে ৩০ হাজার মানুষ তাদের পরিবারের ভরণ পোষণ করে এ কোম্পানির বেতন-ভাতার উপর। অর্থাৎ দেশের প্রায় দুই লাখ মানুষের রুটি-রোজগারের যোগানদাতা স্মার্টগ্রুপকে বাচিঁয়ে রাকতে হবে দেশের স্বার্থে। এ গ্রুপ বেঁচে থাকলে কর্মসংস্থান বাড়বে। দেশের অর্থনীতিতে আরো গতি সঞ্চার হবে। লেখাটা যখন লিখছি তার কিছু সময় আগে আমার গ্রামের একটা ছেলের সাথে দেখা হলো। আলোচনার এক পর্যায়ে জানতে পারি করোনাকালীন সময়ে তার চাকুরী চলে গেছে। এখনো নতুন চাকুরী জোগাড় করতে পারেনি। আমি তাকে উপদেশ দিলাম চাকুরী করতে হবে এই রকম কোনো কথা নাই। আপনি যেহেতু লেখাপড়া খুব বেশি জানেননা সেহেতু আপনি ড্রাইভিং শিখতে পারেন। কার অথবা মাইক্রো চালাতে পারেন। কয়েকমাস প্রশিক্ষুণ নিয়ে আপনি আয়ের একটা উৎস খুঁজে নিতে পারেন। ছেলেটির মত অসংখ্য মানুষ এখন বেকার জীবন যাপন করছেন। আর যারা নিম্ন পদে চাকুরী করছেন তাদের বর্তমান অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে সেটা অবশ্যই আপনারা বুঝতে পারছেন। দিনদিন মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে। কোনো কারণে বর্তমান সময়ে একটা গ্রুপ ঝুঁকিতে থাকা মানেই কর্মচারীদের জন্য, দেশবাসীর জন্য বড় বিপর্যয়।
সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা গেছে সীতাকুন্ডর বিএম কন্টেনার ডিপো চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী গ্রæপ স্মার্ট গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। হল্যান্ডের সাথে যৌথ বিনিয়োগে ২০১১ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসা পরিচালনা করছে। প্রায় ২৫ একর জায়গার উপর গড়ে তোলা বেসরকারি এই কন্টেনার ডিপোর ধারণক্ষমতা ৭ হাজার টিইইউএস কন্টেনার। এর মধ্যে গতকাল ঘটনার সময় এই ডিপোতে ৪ হাজার ৩শ টিইইউএস কন্টেনার ছিল। এর মধ্যে প্রায় ৩ হাজার টিইইউএস খালি কন্টেনার, যেগুলোতে পণ্য বোঝাই করা হতো। অপরদিকে ১ হাজার ৩শ টিইইউএস কন্টেনার ছিল পণ্য ভর্তি। এর মধ্যে অধিকাংশ প্রায় ৫শ কন্টেনার ছিল আমদানি পণ্য বোঝাই এবং প্রায় ৮শ কন্টেনার ছিল রপ্তানি পণ্য বোঝাই। আমাদের চলমান জীবনে অনেক ভুল ত্রুটি থাকে। ভুলত্রুটি ঊর্ধ্বে কেউ নয়। তাই আমি বলব বিএম ডিপোর ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যদি কোনো ভুল থাকে তাহলে সেই ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
এই ডিপোর পক্ষ থেকে বেশ কিছু ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার এক রিপোর্টে দেখা গেছে, বিএম কন্টেইনার ডিপোর মহাব্যবস্থাপক মেজর (অব.) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বিভিন্ন ঘোষণা দেয়া হয়। যারা গুরুতর আহত কিংবা অঙ্গহানির শিকার হয়েছেন এমন আহতদের পাশে থাকবে স্মার্ট গ্রæপ তাদের ৬লাখ টাকা কওে নগদ অনুদানসহ চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করবে। আর যারা নিহত হয়েছেন তাদের ১০লাখ টাকা করে অনুদানসহ নিহতদের স্বজনদের চাকরির ব্যবস্থা করবেন। এই মর্মান্তিক অগ্নি-দুর্ঘটনায় কর্মচারী নিহত হলে তাদের পরিবারে শিশু থাকলে প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত তাঁর পরিবারকে বেতনের সমপরিমাণ টাকা প্রদান এবং উপার্জনক্ষম সদস্য থাকলে চাকরির ব্যবস্থা করার ঘোষণা দেয়া হয়। ইতোমধ্যে ঘটনার তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটিও গঠন করেছে বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষ। দেশের ইতিহাসে এ জাতীয় দুর্ঘটনায় ব্যাপক ক্ষতির মধ্যেও মালিক পক্ষের এ ধরনের মানবিক ঘোষণা খুব কমই দেখা যায়। বি এম কন্টোইনার এই ক্ষেত্রে যে ভূমিকা রেখেছে তা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আমরা আশা রাখছি প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ তাদের ঘোষণা অনুসারেই কাজ করবেন। আশার কথা আগামীকাল রবিবার ও সোমবার জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন শুরু করবে।
আমরা আগুনে পুড়ে ছঅই হচ্ছি, এমন চোখের জল ভাসানো বেদনার মধ্যে আশার আলো দেখতে পেয়েছি। এ যেন অন্য এক চট্টগ্রাম। আবেগ এবং মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার এ দৃষ্টান্ত বিশ্ব আর কোথাও কি খুঁজে পাবে? এরপরও দীর্ঘশ্বাস হয় থেকে যাবে, এ হতাহত মানুষগুলোর ভবিষ্যৎ কি হবে? এখন হয়তো অনেকে মানবতার তাগিদে সাহায্য সহযোগিতা করছেন। কয়েকদিন পর যে যার কর্মজীবনে ফিরে যাবে। সীতাকন্ড ট্র্যাজেডির কথা মনে থাকবে কিন্তু যারা আহত হয়েছেন তাদের কথা আমরা কয়জনই বা মনে রাখব!
আমাদের মত দেশে এ জাতীয় দুর্ঘটনার পর পুনর্বাসনের জন্য সরকারী উদ্যোগে শ্রমিক কর্মচারীদের স্বার্থে স্থায়ী কিছু করতে হবে। এছাড়া প্রত্যেক বিভাগীয় সদরে পূর্ণাঙ্গ বার্ন হাসপাতাল প্রয়োজনীয়তার কথা আবারও আলোচনায় এসেছে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর নগর এ চট্টগ্রামে বার্ন হাসপাতালের প্রয়োজনীযতা আরো বেশী। যাতে আহত ব্যাক্তিরা শ্রুত চিকিৎসা সেবা পান। আমরা লক্ষ্য করেছি, সীতাকন্ড ডিপোতে যারা অগ্নিদগ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন তাদের অনেককে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় প্রেরণ করা হয়েছে। ঢাকা এবং চট্টগ্রামের দূরত্বের কারণে কোনো রোগীকে যখন ঢাকায় প্রেরণ করা হয় তখন রোগীর যারা আত্মীয় আছেন তাদের খুব বেগ পেতে হয়।
প্রত্যেক বিভাগীয় শহরের অগ্নিদগ্ধ মানুষের সেবার জন্য ভালো ব্যবস্থা থাকলে রাজধানীর উপরেও অনেক চাপ কমবে। বিশেষ করে চট্টগ্রামে হাজারো শিল্প কারখানা এবং গার্মেন্টস রয়েছে। যেখানে প্রতিদিন ছোট ছোট অনেক দুর্ঘটনা হচ্ছে যেগুলো আমাদের লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যায়। চট্টগ্রামের গার্মেন্টস এবং কল কারখানাগুলোতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ কাজ করেন। আমাদের মত সাধারণ চাকুরীজীবী যারা আছি তাদের শুধুই চিন্তা থাকে কোনো রকম দু’মুঠো ভাত খেয়ে জীবন ধারণ করলেই হয়। আমরা শ্রমজীবী যারা আছি তারা কাজ করার জন্য সামান্যতম নিরাপত্তা চাই। সেই নিরাপত্তা না পেলে একসময় শ্রম অসন্তোষ দেখা যাবে। তাই সময় থাকতেই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
বিএম ডিপোর মত আর কোনো দুর্ঘটনা আমরা প্রত্যাশা করিনা। যদি দুর্ভাগ্যবশত কোনো ঘটনা হয়ে যায় তার জন্য আহত ব্যাক্তি যাতে শ্রুত সুচিকিৎসা পায় তার জন্য সব সুযোগ সুবিধা দিয়ে চট্টগ্রাম শহরে শ্রুত একটা পূর্ণাঙ্গ বার্ন হাসপাতাল নির্মাণ করা হোক।

লেখক : প্রাবন্ধিক