সীতাকুন্ডে গ্রাম আদালতে আস্থা বেড়েছে সাধারণ মানুষের

197

মামলা নং-২৭ উপজেলার ২নং বারৈয়ঢালা ইউনিয়নের পশ্চিম লালানগর ১নং ওয়ার্ড এলাকার ফাতেমা আক্তার লাকি স্বামীর কিছু অনৈতিক কাজে সংসারে অশান্তি শুরু হলে সংসার করবে না বলে ২০২০ সালের জুন মাসে পারিবারিক ও নারী নির্যাতন আইনে মামলা করে ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম আদালতে। শুনানির পরে গ্রাম্য আদালতের ইউপি চেয়ারম্যান দক্ষতা ও বিছক্ষনতা দিয়ে খুব দ্রæততর সময়ে মামলাটি নিষ্পত্তি করেন। বর্তমানে ফাতেমা আক্তার লাকি ও স্বামী আইয়ুব আলী সুন্দর ফুটফুটে সন্তান নিয়ে সংসার জীবন অতিবাহিত করছেন। এভাবে অসংখ্য মামলা বর্তমানে গ্রাম আদালতে দ্রæততর সময়ে নিষ্পত্তি হয়ে থাকে। যা নিয়মিত আদালতের উপর অনেকটা চাপ কমছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বারৈয়াঢালা ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ রেহান উদ্দিন রেহান জানান, সরাসরি গ্রাম আদালতে যারা মামলা নিয়ে আসে আমরা চেষ্টা করি খুব দ্রæততম সময়ে নিষ্পতি করতে। এক্ষেত্রে তিন মাসের মধ্যে নিস্পত্তি করার কথা থাকলেও আমরা ১-২ মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করি। সম্প্রতি আমাদের গ্রাম আদালতে ৩৫টি মামলা নথিভুক্ত হয়েছে। তার মধ্যে ২৪টি মামলা আমরা নিষ্পত্তি করতে পেরেছি। তবে নিয়মিত আদালতকৃতক যে সকল মামলা আমাদের কাছে নিষ্পত্তির জন্য আসে তাও আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিষ্পত্তি করতে সক্ষম হয়। করোনাকালীন সময়েও আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে গ্রাম আদালত পরিচালনা করেছি এবং দ্রুততম সময়ে মামলা নিষ্পত্তি করছি। গ্রাম আদালত সাধারণ মানুষের মধ্যে দিন দিন আস্থা বাড়ছে। করোনাকালীন সময়ে সংঘটিত ছোটকাট অপরাধ নিষ্পত্তি হয়েছে গ্রাম আদালতে। সীতাকুন্ডে গত তিন বছরে (চলতি বছরের জুন পর্যন্ত) নয়টি গ্রাম আদালতে এক হাজার ৬০৩ টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে সরাসরি ইউনিয়ন পরিষদে মামলা হয়েছে এক হাজার ৪৮২টি। বাকি মামলা নিয়মিত আদালত থেকে পাঠানো হয়েছে। তার মধ্যে শুনানীর মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে এক হাজার ১৬৭টি। ইউনিয়নভিত্তিক তিন বছরে মামলা দায়ের, উপজেলার সৈয়দপুর ইউনিয়নে ৩৯১টি, বারৈয়ারঢালায় ১২৬টি, মুরাদপুরে ১১৪টি, বাড়বকুন্ড ১১৮টি, বাঁশবাড়িয়ায় ১৬৭টি, কুমিরায় ৯৯টি, সোনাইছড়িতে ১৬১টি, ভাটিয়ারীতে ৮২টি ও সলিমপুরে ৩৪৫টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। সূত্রে জানা যায়, উপজেলার নয়টি ইউনিয়নের ছয়টিতে অ্যাক্টিভেটিং ভিলেজ কোর্ট ইন বাংলাদেশ দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্পের আওতায় পরিচালিত হচ্ছে। প্রকল্পের আওতাভুক্ত গ্রাম আদালতে রয়েছে একটি আদালত কক্ষ, রয়েছে সুনির্দিষ্ট এজলাস, কাটগড়া, বেঞ্চসহকারির আসন ও সামনের খোলা জায়গায় রয়েছে পক্ষ বিপক্ষে আসা মানুষের বসার স্থান। ইউনিয়নগুলো হলো, বারৈয়ারঢালা, মুরাদপুর, বাড়বকুন্ড, বাঁশবাড়িয়া, সোনাইছড়ি, ভাটিয়ারী। এছাড়া প্রকল্পের বাইরে গ্রাম আদালত পরিচালিত হয়, সৈয়দপুর, কুমিরা ও সলিমপুর ইউনিয়ন পরিষদে। গ্রাম আদালতের আইন ২০০৬ অনুসারে, চেয়ারম্যান ও পক্ষগণের মনোনীত দুই ইউপি সদস্য ও দুইজন গণ্যমান্য ব্যক্তি নিয়ে আদালত গঠন হবে। বাদী-বিবাদীর মধ্যে কোন পক্ষ যদি নারী হন, সেক্ষেত্রে অবশ্যই নারী ইউপি সদস্য পক্ষগণের প্রতিনিধি হবে। যদি কোন পক্ষ তাদের প্রতিনিধি মনোনয়ন না দেন তাহলে চেয়ারম্যান তার পরিষদের চারজন সদস্য নিয়ে আদালত গঠন করবেন। উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের গিয়ে দেখা যায়, এজলাস প্রস্তুত। নির্দিষ্ট আসনে বসেন চেয়ারম্যান ও চারজন ইউপি সদস্য। এজলাসের সামনে থাকা আসনে বসেন আদালত সহকারি। একে এক হাজির হলেন বাদি-বিবাদী। ডানপাশে থাকা কাটগড়ায় তোলা হল মামলার বাদিকে। শপথবাক্য বলতে বলা হল, যা বলিব সত্য বলিব, সত্য বই মিথ্যা বলিব না। কোন কিছু গোপন করিব না। এরপর শুরু হল দুই পক্ষের আলোচনা। বাদি-বিবাদী তাদের পক্ষে নিজ নিজ ব্যাখ্যা উপস্থাপন করলেন। এরপর বাদি বিবাদীর যুক্তি শুনে চেয়ারম্যান সিদ্ধান্ত দেন। এভাবে সপ্তাহে একদিন গ্রাম আদালত বসে এবং প্রতিদিন মামলাও নিস্পত্তি হয়। মামলায় কোন পক্ষ উপস্থিত না থাকলে সেগুলো পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করা হয়। সীতাকুন্ড থানার ওসি মো. ফিরোজ হোসেন মোল্লা জানান, সমাজে কিছু দুষ্ট প্রকৃতির লোক থাকে যারা স্থানীয়ভাবে কোন মামলা নিস্পত্তি করার পক্ষে না। মূলত প্রতিপক্ষকে হয়রানি করার লক্ষে তারা থানায় মামলা দায়ের করেন। এসব মামলার ক্ষেত্রে অনেক সময় থানাকে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে হয়। সেক্ষেত্রে বিজ্ঞ আদালত মামলাগুলো মূল নিস্পত্তির জন্য গ্রাম আদালতে প্রেরণ করেন। সীতাকুন্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিল্টন রায় বলেন, সাধারণ জনগনের দোরগৌড়াই সহজভাবে সেবা প্রদানের স্বার্থে গ্রাম আদালত। যেখানে কোন উকিল ধরা লাগে না, টাকা খরচ করে নিয়মিত আদালতে যেতে হয় না, এখানে পুরুষ বাদী ও বিবাদীর পক্ষে মনোনিত পুরুষ ইউপি সদস্য থাকবে। মহিলা বাদী ও বিবাদীর ক্ষেত্রে অবশ্যই সংরক্ষিত মহিলা ইউপি সদস্য থাকবে। কোন পক্ষ যদি গ্রাম আদালতের বিচার সংক্ষুদ্র হয় তাহলে ঐ পক্ষ বিজ্ঞ আদালতের মাধ্যমে ফৌজদারি ও দেওয়ানী মামলাতে যেতে পারবেন। আর্থিক ৭৫ হাজার টাকার উপরে গ্রাম্য আদালতে কোন মামলা করা যাবে না। মূলত গ্রাম আদালতে ছোট-খাটো মামলাগুলো নিষ্পত্তি হলে বিজ্ঞ আদালতে মামলার জট কমাবে। একই ভাবে সাধারণ জনগণও সহজভাবে সেবা পাচ্ছে।