সিয়াম মানুষকে কুপ্রবৃত্তি থেকে মুক্ত করে

39

মাহে রমজানুল মোবারকের প্রথম দশক হলো রমহত। আল্লাহর অশেষ করুণাধারার মহা সুসংবাদবাহী মাসের প্রথম দশক আমাদের থেকে বিদায় নিতে চলেছে, তাই প্রত্যেকের উচিৎ আল্লাহ প্রদত্ত এ সিয়াম-সাধনা যথাযথ আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুযোগ হাতছাড়া না করা। মাহে রমজান আল্লাহর নেয়ামত আর এ নেয়ামত লাভ করবে প্রকৃত ঈমানদারগণ। রোজার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুধাবন করা মুসলমানদের কর্তব্য। দার্শনিক ইমাম গাযালী (রা.) সিয়ামের বিধান সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন, ‘মানুষকে আখলাকে ইলাহী বা আল্লাহর গুণে গুণান্বিত করাই হল সিয়াম-সাধনার উদ্দেশ্য। সিয়াম-সাধনা তাকে পুতঃপবিত্র ও নিষ্পাপ ফেরেশ্তাকুলের অনুকরণে পথচলায় অনুপ্রাণিত করে, পাশাবিকতা ও কুপ্রবৃত্তির গোলামী থেকে মুক্ত করে। ফেরেশ্তাগণ যেমন সকল মৌলিক চাহিদা থেকে মুক্ত ও পবিত্র এবং আল্লাহর দরবারে সুউচ্চ সম্মান ও মর্যাদার
অধিকারী; তেমনি মানুষও পাশাবিক জৈবিক চাহিদা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যম আল্লাহ প্রদত্ত বিবেক, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার সদ্ব্যবহার করে দরবারে ইলাহির সুউচ্চ মর্যাদার অধিকারী হতে পারে। এমনকি কখনও তার মর্যাদা হয় ফেরেশ্তার ঊর্ধ্বে। ইমাম গাজ্জালী (র.) ‘ইয়াহইয়া উল উলূম’ গ্রন্থে রোজার তিনটি স্তরের কথা বর্ণনা করেছেন। যার প্রথমটি হলো পরম আল্লাহর প্রেমে বিভোর ও তন্ময় থেকে সুবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার, কামাচার এবং সকর প্রকার পাপাচার থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকা।
দ্বিতীয়টি পানাহার, কামাচার এবং যাবতীয় পাপাচার পরিহার করা।
তৃতীয়টি শুধু পানাহার ও কামাচার থেকে বিরত থাকা, এটি রোজার সর্বনিম্ন স্তর।
মানুষের মধ্যে জন্ম নেয়া কুপ্রবৃত্তি দূর করে উত্তম আদর্শ নিজ জীবনে বাস্তবায়নের জন্যেই রোজার সাধনা। শুধুমাত্র পানাহার ও যৌন সম্ভোগ থেকে বিরত থাকাই রোজার উদ্দেশ্য নয়; যদিও এতে রোজা আদায় হয়ে যায়। রোজা পরিপূর্ণ করতে এবং রোজার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের রোজা আদায় করতে হবে। চোখের রোজা হলো চোখ দিয়ে অবৈধ কিছু দেখা হতে বিরত থাকা। কানের রোজা হলো অশ্লীল গান-বাজনা শোনা থেকে বিরত থাকা। জিহব্বার রোজা হল শরীয়ত বিরোধী কিছু না বলা। হাতের রোজা হলো অবৈধ কোন কাজ না করা, নিষিদ্ধ বস্তু স্পর্শ না করা। পায়ের রোজা হলো অবৈধ স্থানে গমন থেকে বিরত রাখা। পেটের রোজা হলো হারাম খাবার, সন্দেহজনক খাবার থেকে রক্ষা করা। মোটামুটি সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সংযমের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। তবেই সিয়াম-সাধনার উদ্দেশ্য পূরণ হবে।
মনে রাখতে হবে, মাহে রমজানের সংযম-সাধনার মাধ্যমে ত্যাগ-তিতিক্ষা ও আত্মসংযমের অভ্যাস রপ্ত করে বাকি জীবন সৎ ও ন্যায় নিষ্ঠাভাবে অতিবাহিত করতে হবে। সিয়াম-সাধনার মাধ্যমে মানুষ আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক পবিত্রতা অর্জন করে থাকে। আর এ আত্মশুদ্ধি যথাযথভাবে অর্জনের মাধ্যমে সে পৌঁছে যায় পারলৌকিক সাফল্যের স্বর্ণশিখরে। মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার মাধ্যমে নাফসের বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রাম করে খাঁটি মানুষ ও বিশুদ্ধ মনের অধিকারী হওয়া যায়। আল্লাহর নৈকট্য অর্জিত হয়। ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর হয়ে তার জৈবিক চাহিদা ও পাশবিক প্রবৃত্তিসমূহ দুর্বল হয়ে যায়, তার মনুষ্যত্ব সজীব ও সতেজ হয়ে ওঠে। তখন ক্ষুধা কাতর অভুক্ত মানুষের অনাহার ক্লিষ্ট মুখে তার হৃদয়ে সহানুভূতি ও সহমর্মিতার পবিত্র অনুভুতি জাগ্রত করে। সিয়াম দ্বারা ১১ মাসব্যাপী যেসব হতদরিদ্র মানুষ দুবেলা খেতে পারে না, অর্থ ও অন্নের অভাবে যন্ত্রণা এবং কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করে, তাদের প্রকৃত অবস্থা অনুভব ও উপলব্ধি করা যায়। এতে মানুষের প্রতি মানুষের সহানুভূতি ও দয়া সৃষ্টি হয়।
অতএব, সকল মু’মিন-মুসলমানের উচিৎ রোজা আদয়ের মাধ্যমে এর মূল লক্ষ অর্জনে সচেষ্ট হওয়া। মাহে রমজানের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুধাবন করা। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দিন- আমিন।