সিদ্দিক আহমেদ : সৎ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ

57

আ ব ম খোরশিদ আলম খান

জন্মিলে একদিন মরতে হবে এটাই দুনিয়ার অমোঘ বিধান। কিন্তু কিছু মানুষের মৃত্যু এমন যে, সান্ত্বনা খুঁজে পাওয়া যায় না। সাংবাদিক সিদ্দিক আহমেদের মৃত্যু তেমনই বেদনাদায়ক আমাদের জন্য। কৃতি সাংবাদিক ও লেখক সিদ্দিক আহমেদ একজন আপাদমস্তক জ্ঞানী-গুণী-জ্ঞানতাপস ব্যক্তিত্ব। জ্ঞান অন্বেষণের সাধনায় জীবনভর ব্যাপৃত ছিলেন। এমন একজন নির্লোভ, নির্মোহ ও সাদাসিধে মানুষ চারপাশে আজ খুব একটা দেখা যায় না। সিদ্দিক সাহেব ২৫ বছর আজাদী পত্রিকায় সাংবাদিকতা পেশায় ছিলেন। এর আগে তাঁর বাড়ি রাউজান গশ্চি এলাকায় স্কুল শিক্ষক ছিলেন। প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন যুবক বয়সে। এমনকি জীবনচক্রের এক পর্যায়ে এসে জীবিকার জন্য কৃষিকাজও করেন। নিজেকে কৃষক পরিচয় দিতেও তিনি কুণ্ঠিত হতেন না। শিক্ষকতা, কৃষিকাজ, লেখালেখি ও সাংবাদিকতাÑ সবখানেই তাঁর সপ্রতিভ পদচারণা ছিল। রাউজানের গশ্চিতে তাঁর বাড়িতে শিশুবাগ নামে একটি স্কুলও তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।
সিদ্দিক আহমেদের কর্মস্থল দৈনিক আজাদীতে ২০০৫ সন থেকে আমিও সম্পাদনা সহকারী হিসেবে দায়িত্বে ছিলাম। তিনি ছিলেন সহকারী সম্পাদক। আজাদীতে সম্পাদকীয় পাতা দেখাশোনাই তাঁর মূল দায়িত্ব ছিল। অরুণ দাশগুপ্ত, মো. মাহবুব উল আলম ও সিদ্দিক আহমেদ- তিনজনই আজাদীর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। আলম সাহেব চার/পাঁচ বছর আগে দায়িত্ব থেকে অবসর নিয়েছেন। জরাগ্রস্ত শরীরে অরুণ দাশগুপ্ত (দাদুমণি) আজাদীতে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। সিদ্দিক আহমেদ এখন প্রয়াত। এই তিনজনই অত্যন্ত প্রতিভাবান, প্রাজ্ঞ ও জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব। তাঁদের সহকারী হিসেবে আজাদীতে কাজ করতে পেরে নিজেকে আজ ধন্য মনে করছি।
সিদ্দিক সাহেব প্রচুর পড়াশোনা করতেন। জ্ঞান-বিজ্ঞান, বিশ্ব সাহিত্য, ইতিহাস ইত্যাদি নিয়ে তাঁর বিস্তর পড়াশোনা দেখে মুগ্ধ হতে হয়। পড়াশোনার পাশাপাশি লিখতেনও বেশ। ৬/৭ টি গ্রন্থ বেরিয়েছে তাঁর। ‘কবিতার রাজনীতি’, ‘আপেলে কামড়ের দাগ’, ‘পৃষ্ঠা ও পাতা’ তাঁর রচিত বইগুলো সুখপাঠ্য মনে হয়েছে। পাঠকনন্দিত লেখক ছিলেন তিনি। এমনকি তিনি এতোই ভাগ্যবান যে, জীবিতকালেই তিনি তাঁর জীবন-কর্মের ওপর প্রকাশিত সম্মাননা স্মারক গ্রন্থ দেখে যেতে পেরেছেন। তাঁর ইন্তেকালের পর প্রকাশিত প্রাবন্ধিক-লেখক মুহাম্মদ নুরুল আবসার সম্পাদিত ‘সিদ্দিক আহমদ স্মারক গ্রন্থটি’ বেশ আকর্ষণীয় ও মানোত্তীর্ণ হয়েছে বলা যায়।
পাঠক-সুধীজনের কাছ থেকে যে ভালোবাসা, সম্মান ও স্বীকৃতি পেয়েছেন তাতে তিনি তৃপ্ত ও মুগ্ধ বলে অকপটে স্বীকার করেছেন। সারল্য, সাধুতা, সততা, কাজের প্রতি নিষ্ঠা, পেশার প্রতি দায়বদ্ধতা এবং নিরহংকার-নির্লোভ-নির্মোহ জীবনযাপনÑএই ছিল সিদ্দিক আহমেদের জীবনের বড় বৈশিষ্ট্য। সর্বজন নন্দিত কীর্তিমান এ সাংবাদিক জীবনের শেষ দিকে এসে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলেও মনের জোর হারাননি। তবে তাঁর ব্যয়বহুল চিকিৎসার খরচ জোগাতে পরিবারের পক্ষে যথেষ্ট বেগ পাওয়া দেখে তিনি হতাশ ও বিমর্ষ হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর শত শত গুণগ্রাহী স্বজন ছিল। কিন্তু কয়জনই তাঁর পাশে ছিলেন অন্তিম সময়ে। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে তিনি আক্ষেপ করে বলে গেছেন-‘আমার বন্ধুরা অনেকেই বিত্তবান। তাদের মতো টাকা থাকলে আমি বলতাম- ‘নাও এই টাকা। চিকিৎসা করো।’
সিদ্দিক আহমেদের লেখার পাঠোদ্ধার করা সহজসাধ্য ছিল না। তাঁর টানা অস্পষ্ট হস্তাক্ষর সবাই বুঝতে পারতেন না। অনেক সময় নিজের লেখার প্রুফ নিজেই দেখতেন। বলতেন, লেখা পাঠোদ্ধার করতে না পারলে নিঃসংকোচে তাঁকে দেখাতে। তবে আমার সৌভাগ্য যে, আমি তাঁর লেখা বুঝতে পারতাম। তিনি আমাদের উদ্দেশ্যে প্রায়ই বলতেন, পত্রিকার সংশোধনী বিভাগ তথা সম্পাদনা সহকারী পদটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলায় মাস্টার্স পাস তথা ভাষা জ্ঞানে অভিজ্ঞরাই সম্পাদনা সহকারী হওয়ার প্রকৃত যোগ্যতা রাখেন। সিদ্দিক সাহেব বলতেন, আমাদের লেখাজোখায় ভুল থাকবে, স্লিপ হবে কিন্তু তা সংশোধনের দায়িত্ব সংশোধনী বিভাগের। সম্পাদনা সহকারীরা যদি ভুল করেন পত্রিকার মান পড়ে যায়, পাঠক পাঠোদ্ধার করতে না পেরে বিরক্ত হয়ে ওঠে। এজন্য লেখা-নিউজ যথাযথ নির্ভুল সম্পাদনা-সংশোধনের ওপর তিনি প্রায়ই জোর দিতেন। একবার তাঁর একটি লেখায় ইংরেজি বাক্য ভুলভাবে আজাদীতে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। অথচ তাঁর লেখা সঠিক ও নির্ভুল ছিল। ইংরেজি ভাষায় দেশের ক্ষেত্রে সম্বোধনে স্ত্রীবাচক শব্দ ব্যবহার হয়। তাঁর লেখায় এ ধরনের একটি বাক্য ছিল। প্রুফ দেখতে গিয়ে যা অজান্তে ভুল করে ফেলেন আমাদের এক সম্পাদনা সহকর্মী। এজন্য খুবই ব্যথিত হন সিদ্দিক আহমেদ। আমাদের সেকশনে এসে এই বিরাট ভুলের জন্য আক্ষেপ করলেও আমাদের ক্ষতি হতে পারে ভেবে বিষয়টি কর্তৃপক্ষীয় নজরে আনেননি তিনি। মৃদু ক্ষোভ ঝেড়ে কোথায় অশুদ্ধ হয়েছে তা ধরিয়ে দেন। একেই বলে মহানুভবতা ও ঔদার্য। যা সবার জীবনে দেখা মেলে না। এক্ষেত্রেই অনন্য সাংবাদিক সিদ্দিক আহমেদ।
সাংবাদিক সিদ্দিক আহমেদ ছিলেন একজন ভালো অনুবাদক। ৭/৮ বছর আগের ঘটনা। চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে আমার ছোট চাচা আন্তর্জাতিক বক্তা আল্লামা আবু সুফিয়ান খান আবেদি আলকাদেরী তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা ও কমপ্লেক্সের একটি আবেদনপত্র ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ ও ছাপানোর দায়িত্ব অর্পণ করেন আমার ওপর। বাংলা ভাষার ওপর আমার দখল থাকলেও ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র নই বলে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদের দায়িত্ব পেয়ে একটু চিন্তিত হয়ে পড়ি। আন্দরকিল্লায় অনুবাদ কেন্দ্রে যাই। তারা অনেক টাকা দাবি করে এবং কয়েকদিন সময় চায়। এদিকে আমার হাতে সময় নেই। হঠাৎ আমার মাথায় এলো, সিদ্দিক সাহেব তো ভালো অনুবাদক। ইংরেজি ভাষা তাঁর পুরোপুরি আয়ত্তে। অবশেষে তাঁর শরণাপন্ন হলাম। তিনি দুই/তিন দিনের মধ্যে আবেদনপত্রটি ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে দিলেন। বিনিময়ে কোনো টাকা বা পারিশ্রমিক দাবি করেন নি। তবুও আমি জোর করে কিছু টাকা বিনিময় হিসেবে তাঁর হাতে গছিয়ে দিয়েছি। তখন তাঁর ধূমপানের অভ্যাস ছিল। আমি তাঁকে সিগারেটের প্যাকেট দিতাম। তবে তিনি বড়জোর চাইতেন শুধু একটি সিগারেট। বলতেন, সিগারেট খাওয়া বদ অভ্যাস। তাই, পকেটে একটির বেশি সিগারেট না থাকাই ভালো। বেশি থাকলে বেশি টানতে হবে।
সিদ্দিক আহমেদ ছিলেন একাধারে গবেষক, অনুবাদক-প্রাবন্ধিক ও কবি। নিরন্তর লেখালেখি, পড়াশোনাই ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। বিদেশি বই পুস্তক ও ইংরেজি পত্রিকাগুলোর ওপর নিয়মিত চোখ বুলাতেন সিদ্দিক সাহেব। ডেইলি স্টার, নিউ অ্যাজ, ঢাকা ট্রিবিউন ও সাপ্তাহিক হলিডে পড়তে দেখেছি তাঁকে। আমি মাঝে মাঝে তাঁকে এ পত্রিকাগুলো কিনে দিতাম। তিনি খুবই খুশি হতেন। সত্যিই এ ধরনের মানুষের কোনো তুলনাই হয় না। সাদা মনের সাদাসিধে মানুষ তিনি। তাঁকে বলা চলে বিরল জ্ঞানতাপস। সিদ্দিক আহমেদের মতো নির্লোভ, নিরহংকারী, সৎ, নির্মোহ সাংবাদিক আজ সত্যিই বিরল। আজকের সৎ সাংবাদিকতার ক্রান্তিকালে সত্যিই তিনি ছিলেন সৎ ও আদর্শবাদী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ। তিনি লেখালেখি ও সাংবাদিকতাকে জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। ২০১৭ সনের ১২ এপ্রিল তিনি আমাদের ছেড়ে পরপারের বাসিন্দা হন। আল্লাহর দরবারে তাঁর রূহের মাগফিরাত কামনা করছি।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট