সিজারে বাচ্চা প্রসব প্রয়োজনটা কার বেশি?

16

ফারুক আবদুল্লাহ

বেসরকারি ক্লিনিক-হাসপাতাল ও এনজিও পরিচালিত মাতৃসদনগুলোতে সিজার বা অস্ত্রোপচারে ডেলিভারির সংখ্যা অনেক বেশি। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রায় ৯৮ শতাংশ সিজারের মাধ্যমে ডেলিভারি করা হচ্ছে। এজন্য বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর অতি মুনাফার লোভ এবং প্রসূতি ও তার পরিবারের অসচেতনতাই দায়ী।
এতে শিশুর জন্মগত অসুস্থতা ও মৃত্যুহার বাড়ছে। কমে যাচ্ছে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। এটিকে অস্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবে উল্লেখ করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, একটি দেশে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব হার ১০-১৫ শতাংশের মধ্যে থাকা উচিত। কিন্তু বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালে এ হার ৩৮ শতাংশ। এবং বেসরকারি হাসপাতালে ৮০ শতাংশের বেশি।
শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, নরমাল ডেলিভারিতে প্রসব হওয়া সন্তানের তুলনায় সিজারের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া সন্তানের অসুস্থতা ও মৃত্যুহার বাড়ে। পরবর্তীতে এ শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও বুদ্ধিবৃত্তি কম থাকে। এবং নানা ধরনের জটিলতা বৃদ্ধি পায়। বলতে গেলে এটি একটি অস্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন কার্যালয়ের পরিসংখ্যান মতে, চলতি বছরের জুলাইয়ে চট্টগ্রাম জেলায় এনজিও পরিচালিত ১০টি মাতৃসদন ও প্রাইভেট ক্লিনিকে গর্ভকালীন সেবা নিয়েছেন ১২ হাজার ৫৭৩ জন নারী। এর মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪ হাজার ৬৪৪ জন। তাদের মধ্যে আবার গর্ভকালীন জটিলতা ছিল ৪৭০ জনের। সবমিলিয়ে মোট ডেলিভারি হয়েছে ৩ হাজার ১৯৬ জনের। এর মধ্যে নরমাল ডেলিভারি হয়েছে ২ হাজার ১৩৮ জনের এবং সিজারে ডেলিভারি হয়েছে ১ হাজার ৪৮ জন গর্ভবতী নারীর। শুধুমাত্র এ মাসে প্রাইভেট ক্লিনিকে ৩ হাজার ২৩৮ জন নারী গর্ভকালীন সেবা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ডেলিভারির সময় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ২৩৭ জন। এর মধ্যে গর্ভকালীন জটিলতা ছিল ২৮১ জনের। সবমিলিয়ে মোট ডেলিভারি হয়েছে ১ হাজার ২৮ জনের। এর মধ্যে নরমাল ডেলিভারি হয়েছে ৪৪২ জনের এবং সিজার হয়েছে ৫৮০ জনের।
এদিকে সিজারের মাধ্যমে সন্তান জন্মদান যে শুধু চট্টগ্রামের চিত্র, তা নয়। নগর ছাড়াও প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখন মাতৃসেবার নামে অনেক ক্লিনিক গড়ে উঠেছে। সেসব ক্লিনিকেও গর্ভবতী মায়েদের অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসবে রীতিমত উৎসাহ দেয়া হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, গর্ভবতী মা সন্তান জন্মদানের আগে হাসপাতালে গেলে নানাভাবে ভয় দেখানো হয়। সিজার না করলে শিশু মারাও যেতে পারে, এমন ভয়ও দেখানো হয়। এতে বাধ্য হয়ে অনেকে সিজারে সন্তান নিতে রাজি হয়। এছাড়া এসব বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সিজারের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের বিভিন্ন দামের প্যাকেজ রয়েছে। তাতে খরচ ২০ হাজার টাকা থেকে শুরু সর্বোচ্চ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়। তবে সরকারি এবং এনজিও পরিচালিত হাসপাতাল তুলনামূলক কম টাকায় সিজার করা হয়।
চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি গতকাল মঙ্গলবার একটি বেসরকারি হাসপাতালের অনুষ্ঠানে বলেন, বাংলাদেশে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ২০৩০ সালের মধ্যে সব সূচকে আমরা আমাদের লক্ষ্য অনুযায়ী এগিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু মাতৃমৃত্যুর হার কমাতে আমাদেরকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আমাদের ইনস্টিটিউশনে ডেলিভারির ক্ষেত্রে যে সমস্যাটা দেখছি- আমাদের বেসরকারি হাসপাতালগুলো এবং এনজিও পরিচালতি প্রতিষ্ঠানে সিজারে ডেলিভারির সংখ্যা অত্যন্ত বেশি। অথচ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ১৫ থেকে ১৭ শতাংশ ডেলিভারি সিজারে হতে পারে। আমাদের বাংলাদেশে সেটা ৩৭ শতাংশের মতো। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সত্য, আমাদের বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে শতকরা ৯৮ শতাংশের মতো সিজারের মাধ্যমে ডেডিলভারি করা হচ্ছে। এমনকি অনেক হাসপাতাল পরিদর্শন করতে গিয়ে আমরা সেখানে নরমাল ডেলিভারির রুম পাইনি।
তিনি বলেন, বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে নরমাল ডেলিভারির সুযোগ বৃদ্ধি করা দরকার। একটা যুক্তিসঙ্গতভাবে তাদের জন্য ফি নির্ধারণ করা দরকার। তাহলে আমরা মাতৃমৃত্যু কমাতে পারবো। আর মাতৃমৃত্যু কমাতে পারলে আমরা মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য দুটোই নিশ্চিত করতে পারেবো। তাহলে ২০৪১ সালে আমরা যে উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি, সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।