সিএমপির ১৬ থানা ঘিরে ১৭০ ‘গোপন চোখ’

55

বিদায়ী বছরের সেপ্টেম্বরের শুরুতে নগর পুলিশ কমিশনারের দায়িত্ব নিয়েই থানাগুলোকে নাগরিকদের সেবা প্রাপ্তির প্রাথমিক ও প্রধানতম কেন্দ্রস্থল উল্লেখ করে সেগুলোর প্রতিদিনের কার্যক্রম নজরদারি ও তদারকির আওতায় আনার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন সালেহ মোহাম্মদ তানভীর। সাড়ে ছয় মাসের মাথায় সেই পরিকল্পনার বড় অংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। সিএমপির আওতাধীন ১৬ থানা কম্পাউন্ড ঘিরে বসানো হয়েছে একশ’ ৭০টি ‘গোপন চোখ’ বা আইপি (ইন্টারনেট প্রটোকল) ক্যামেরা। দামপাড়ার সদর দপ্তরে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ ছাড়াও নিজের কার্যালয়ে বসানো মনিটরের পর্দায় থানাগুলোর প্রতিদিনকার চিত্রে নিয়মিত নজর রাখছেন পুলিশ কমিশনার। প্রয়োজন হলে নিজেই ফোন করে থানার ওসিদের তাৎক্ষণিক নির্দেশনা দিচ্ছেন। এতে থানায় নাগরিকদের পুলিশি সেবাপ্রাপ্তি ও মান উন্নত হওয়ার পাশাপাশি জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
নিজের দায়িত্ব পালনের মেয়াদকালে কাজই তার হয়ে কথা বলবে বলে মন্তব্য করা নগর পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা সালেহ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, পুলিশের সেবা বা সহায়তা পাওয়ার কথা চিন্তা করতেই সাধারণ মানুষ চোখ বন্ধ করে থানাকেই জানেন। প্রচলিত ব্যবস্থায় বাস্তবেও থানা হল পুলিশি সেবাপ্রাপ্তির প্রাথমিক ও প্রধানতম জায়গা। আর দীর্ঘদিনের দুঃখজনক সত্য হল, জনমনে থানার কার্যক্রম নিয়ে নেতিবাচক ধারণা বিঁধে আছে। বিদ্রæপাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এমন কথাও প্রচলিত রয়েছে যে, থানার পাশ দিয়ে নাকি কানাও হাঁটে না। আমরা থানা নিয়ে মানুষের সেই ‘মাইন্ডসেটকে’ বদলে দিতে চাই। তারই অংশ হিসেবে প্রতিদিনের কার্যক্রম মনিটর করতে মোট ১৬ থানার একেকটিতে কমপক্ষে ছয়টি থেকে ১৫টি করে আইপি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। সবমিলিয়ে একশ ৭০টি ক্যামেরার মাধ্যমে থানার কার্যক্রম মনিটরিং করা হচ্ছে। পুলিশ প্রবিধানমালা অনুযায়ী থানার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে কিনা সেসব বিষয়াদি পর্যবেক্ষণ ও তদারক হচ্ছে।
সিএমপি কমিশনার জানান, আইপি ক্যামেরায় থানার প্রতিমুহূর্তের দৃশ্য কেবল আমি একাই দেখছি না। আমার পাশাপাশি বিভিন্ন জোনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডিসিরাও দেখতে পাচ্ছেন। আবার নিয়ন্ত্রণ কক্ষে সার্বক্ষণিক দায়িত্বপ্রাপ্ত জনবল রয়েছে। কারও নজরে কোনও অসঙ্গতি দৃশ্যমান হলেই সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থানার ওসিকে ইনফর্ম করা হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাকেও জানানো হয়। আপাতত আইপি ক্যামেরায় ধারণকৃত ফুটেজের মাধ্যমে থানা কম্পাউন্ডের ভেতরের দৃশ্য দেখে তদারকির ব্যবস্থা নেয়া হলেও সহসা থানা ভবনের প্রতিটি কক্ষ, হাজতখানা ও অস্ত্রাগারসহ সবকিছু ক্যামেরার আওতায় আনা হবে। পাশাপাশি কর্তব্যরত অফিসারদের কক্ষে অডিও কথোপকথন বা নির্দেশনা শোনা যাওয়ার যন্ত্রপাতিও সংযোজন করা হবে।
সিএমপি কমিশনারের এ কার্যক্রমকে ইতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখছেন নাগরিক সমাজ। সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদার বলেন, থানায় পুলিশি সেবার মান উন্নয়ন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে এই পদক্ষেপ ভাল ফল দেবে বলেই আমি মনে করি। তাছাড়া, পুলিশ বাহিনীর অভ্যন্তরে পেশাদারিত্ব সঞ্চারিত করতেও এটা গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখবে। থানায় গিয়ে সেবাপ্রাপ্তি নাগরিকদের রাষ্ট্রীয় অধিকার। থানা সেবাপ্রাপ্তি ও হয়রানি নিয়ে মানুষের মনে যে পারসেপশন রয়েছে, তাতে পরিবর্তন আনার সুযোগ সৃষ্টি হবে। জনবান্ধব পুলিশি ব্যবস্থা কার্যকর করতে এ ধরনের পদক্ষেপ প্রশংসনীয়।
পুলিশ প্রবিধানমালা অনুযায়ী, থানার প্রতিদিন ভোর এবং রাত দশটার পর হাজতিদের বিষয়ে তথ্য নেয়া, হাজতখানার অভ্যন্তরে বিদ্যমান পরিবেশ, নারী ও শিশু-কিশোর হাজতিদের জন্য বিশেষায়িত ব্যবস্থা, আইনের বিধিবিধান মেনে হাজতিদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা, সেবাপ্রার্থীদের সাথে প্রবেশপথে দায়িত্বরত সেন্ট্রি বা পুলিশ সদস্যের আচার-আচরণ, কাউকে কোনও ধরনের অনৈতিক সুবিধা প্রদান ইত্যাদি বিষয়গুলো আইপি ক্যামেরার মাধ্যমে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও তদারকি করা হচ্ছে। আগে প্রত্যেক জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) মধ্যরাতে সশরীরে সংশ্লিষ্ট থানায় হাজির হয়ে এসব বিষয় দেখভাল করে পরিদর্শন বইয়ে রিপোর্ট করতেন। কখনওবা পুলিশ কমিশনার নিজেও থানা ভিজিট করতেন। প্রচলিত সেসব ব্যবস্থার পাশাপাশি এখন নগর পুলিশের আওতাধীন ১৬ থানার প্রতিমুহূর্তের কার্যক্রম ভিজুয়্যালি পর্যবেক্ষণ ও তদারক করা হচ্ছে। কেবল নিয়ন্ত্রণ কক্ষ বা দপ্তরে বসা অবস্থায় মনিটরে চোখ রেখেই নয়, মোবাইল ফোনেও অ্যাপসের মাধ্যমে থানার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও তদারকির সুযোগ রয়েছে।
সিএমপি সূত্র জানায়, নগরীর ১৬ থানার কম্পাউন্ড ঘিরে বসানো একশ’ ৭০টি আইপি ক্যামেরার মাধ্যমে বর্তমানে যাচ্ছে কর্তব্যরত কর্মকর্তা, হাজতখানা ও সেন্ট্রির অবস্থান মনিটরে দৃশ্যমান হচ্ছে। প্রতিটি থানা কম্পাউন্ডের চারপাশে ছয় থেকে ১৫টি পর্যন্ত আইপি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। এসব ক্যামেরায় ধারণকৃত দৃশ্য পুলিশ কমিশনারের পাশাপাশি সিএমপির চার জোনের উপকমিশনার (ডিসি)এবং দামপাড়ার সদর দপ্তরে থাকা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকেও সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ ও তদারক করা হচ্ছে। ক্যামেরায় প্রতিমুহূর্তে যা কিছু দৃশ্যমান ও রেকর্ড হচ্ছে, তা ফুটেজ আকারে একমাস পর্যন্ত সঞ্চিত থাকবে। এতে করে পূর্বেকার কোনও দিনের দৃশ্য পরবর্তীতে ফুটেজ বের করে দেখার সুযোগ রয়েছে। ক্যামেরাগুলোতে সংযুক্ত করা হয়েছে জুম ক্যাপাসিটি। তাই যে কোনও মুহূর্তের চলমান দৃশ্য ও ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ কিংবা স্থিরচিত্র আকারে প্রয়োজনমত ছোট-বড় করেও দেখা যায়। কোনও ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে বা ঘটনা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে এই সুবিধা ব্যবহার করা হয়ে থাকে।