সিআরবি এলাকায় কোনো স্থাপনা নয়

21

 

২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল প্রত্যেক বিভাগীয় শহরে একটি করে বিশেষায়িত শিশু হাসপাতাল গড়ে তোলার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী ওয়াদার অংশ হিসেবে ২০১৭ সালে দেশের প্রত্যেকটি বিভাগীয় শহরে সরকারি উদ্যোগে বিশেষায়িত শিশু হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে এক মতবিনিময় সভায় নগরে এই শিশু হাসপাতাল গড়ে তোলার ঘোষণা দেন। চট্টগ্রামে এই হাসপাতাল নির্মাণের জন্য ২ একর জায়গার সন্ধান করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। হাসপাতালের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তখন ৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ পায়। এই প্রকল্পের স্থান খোঁজার জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী চমেক হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জালাল উদ্দিনকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তিনি নগরের সরকারি সিটি কলেজের সামনে রেলওয়ের খালি জায়গায় শিশু হাসপাতাল নির্মাণের জন্য সাড়ে তিন একর জায়গা চিহ্নিত করে গত বছরের ২৫ জুলাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠান। কিন্তু ওই জায়গা নিয়ে রেল মন্ত্রণালয়ের আপত্তির কারণে প্রস্তাবটি আটকে যায়। এর আগে শিশু হাসপাতাল প্রকল্পের জন্য নগরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তিনটি জায়গা চিহ্নিত করেছিল। এগুলো ছিল, আগ্রাবাদ আমেরিকান হাসপাতালের সীমানায়, সিনেমা প্যালেসের দক্ষিণ পাশে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় সীমানা ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গোঁয়াছি বাগান এলাকায়। কিন্তু সেসব জায়গা বেদখল হয়ে থাকার কারণে সেখানে হাসপাতাল নির্মাণের আগ্রহ দেখায়নি প্রকল্পের স্থান নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা। শেষ পর্যন্ত জায়গা না পাওয়ায় শিশু হাসপাতাল প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখছে না। কিন্তু রাজধানীর পূর্বাচলে সরকারি উদ্যোগে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১ হাজার শয্যার একটি বিশেষায়িত শিশু হাসপাতাল নির্মাণের কাজ চললেও চট্টগ্রামে মাত্র দুই একর জায়গার অভাবে এমন একটি হাসপাতাল হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এর ১০ একর জমিতে শিশু হাসপাতাল গড়ে উঠছে।
তবে সরকারি শিশু হাসপাতালের জন্য মাত্র দু একর জায়গা পাওয়া না গেলেও এখন একটি বেসরকারি হাসপাতালকে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ৬ একর জায়গা দিয়ে দিয়েছে। সিআরবি এলাকায় বাংলাদেশ রেলওয়ের জমিতে গড়ে তোলা হবে ৫০০ শয্যার একটি বেসরকারি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ। প্রকল্পটি অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা বৈঠকেও নীতিগত অনুমোদন পেয়েছে। গত বছর সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে ডিপিপি প্রস্তুত ও চূড়ান্তের পর গত বছরের শুরুর দিকে প্রকল্পটি রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পায়। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর ২০২০ সালের ১৩ ফেব্রæয়ারি এ প্রস্তাবে সরকার নীতিগত অনুমোদন দেয়। সিআরবি এলাকায় বিদ্যমান রেলওয়ে বক্ষব্যাধি হাসপাতাল সংলগ্ন ৬ একর জমি জুড়ে এই হাসপাতাল ও কলেজ গড়ে তোলা হবে। পিপিপি অর্থাৎ পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের আওতায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। তবে সরকারি জমিতে হলেও এই হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা হবে সম্পূর্ণ বেসরকারি মালিকানায়। যেহেতু বেসরকারি মালিকানায় পরিচালিত হবে সেহেতু এ হাসপাতালের চিকিৎসাব্যয় আর সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে থাকছে না অন্য দশটি বেসরকারি হাসপাতালের মতোই। ইতিমধ্যে সিআরবি এলাকায় কর্তৃপক্ষ একটি সাইনবোর্ডও টাঙ্গিয়ে দিয়েছে। এ নিয়ে অনেকে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
চট্টগ্রামে সরকারি বেসরকারি চিকিৎসা সেবার বড়ো দৈন্যদশা একথা চট্টগ্রামবাসী মাত্রই জানেন। গত শতকের ষাট দশকের মাঝামাঝি নির্মিত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছাড়া বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলায় আর বড় ও আধুনিক কোনো সরকারি হাসপাতাল নেই। এই একটি হাসপাতালের ওপর নির্ভর করতে হয় দেশের জনসংখ্যার বৃহৎ একটি অংশকে। বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ধারণক্ষমতার কয়েক শ গুণ বেশি রোগীকে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা প্রদান করতে বাধ্য হয়। সক্ষমতার বেশি রোগীকে বছরের পর বছর চিকিৎসাসেবা দিতে দিতে বর্তমানে এই হাসপাতালের চিকিৎসাসেবার মানও নিম্নমুখী। ফলে দেশের বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠী চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে জেনারেল হাসপাতালকে আরও উন্নত এবং এর সঙ্গে একটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করার দাবি থাকলেও তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে জেনারেল হাসপাতাল চিকিৎসাসেবা প্রদানে এক প্রকার ব্যর্থ ছিল। তবে মহামারি শুরু হওয়ার পর জেনারেল হাসপাতালকে কভিড ডেডিকেটেড ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে সরকারি-বেসরকারি নানামুখি উদ্যোগের কারণে এই হাসপাতালের ব্যপক উন্নতি হয়েছে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে এইসব দৈন্যদশা কাটিয়ে উঠতে চট্টগ্রামবাসী দীর্ঘদিন ধরে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাতে ফল তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। ঢাকায় সরকারি হাসপাতালের সংখ্যা অনেক বেশি। সে সঙ্গে আছে বেসরকারি হাসপাতালেরও। চট্টগ্রামে বেসরকারি খাতেও বড় ও আধুনিক কোনো হাসপাতাল এতদিন ছিল না তবে মাত্র কিছুদিন আগে ইম্পেরিয়াল ও এভারকেয়ার নামে দুটো বেসরকারি আধুনিক হাসপাতাল যাত্রা শুরু করেছে। এছাড়া চট্টগ্রামে তীব্র অভাব থাকা সত্তে¡ও বিশেষায়িত কোনো হাসপাতাল গড়ে তোলার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়নি। ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, লিভার, কিডনি, হৃদরোগ, বার্ন, শিশু, পঙ্গু, মানসিক ইত্যাদির মতো জটিল রোগের চিকিৎসাসুবিধা চট্টগ্রামে নেই। চট্টগ্রামে বিশেষায়িত হাসপাতাল গড়ে তোলার দাবি অনেকদিন থেকে করে আসা হলেও সরকারি-বেসরকারি কোনোভাবেই তা বাস্তবায়ন হয়নি। সরকারি জায়গা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ছেড়ে দিয়ে চিকিৎসা বাণিজ্যিকরণের প্রতিবাদ করছেন চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনেরা।
রেলওয়ের কী পরিমাণ জায়গা বেহাত, বেদখল আছে তার সঠিক পরিসংখ্যান খোদ রেলপথ মন্ত্রণালয়েও নেই। দেশের প্রচুর জায়গার মালিক রেলওয়ে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির হাজার হাজার একর জমি অবৈধ দখলদারদের হাতে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ মাঝেমধ্যে অনেকটা লোকদেখানো উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে বটে তবে তাতে রেল কর্তৃপক্ষের বাড়তি খরচ হলেও লাভ তেমন কিছু হয় না। উচ্ছেদকৃত জায়গা কয়েকদিনের মধ্যে আবার দখল হয়ে যায়। মাঝখানে লাভবান হয় রেলের দুর্নীতিবাজ কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী।
চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকার। সরকারি চিকিৎসাসুবিধা সংকুচিত করে চিকিৎসাকে বাণিজ্যিকরণ বা ব্যয়বহুল করে তুলে সাধারণ মানুষকে কষ্ট দেওয়ার এ ধরনের পদক্ষেপের বিরোধিতা করতে হবে নৈতিক স্বার্থেই। সরকারি শিশু হাসপাতাল করার জন্য যে রেলওয়ে থেকে মাত্র দুই একর জায়গা পাওয়া গেল না সে কর্তৃপক্ষ একটি বেসরকারি হাসপাতালকে খুব সহজভাবে ৬ একর জায়গা কেন দিচ্ছে সে প্রশ্ন রাখতে চাই। সরকারি হাসপাতাল থেকে সাধারণ মানুষ কম খরচে চিকিৎসাসুবিধা পাবে আর বেসরকারি বাণিজ্যিক হাসপাতালগুলোতে সাধারণ মানুষতো দূরের কথা রেলের লোকজনই তো চিকিৎসাসেবা নিতে পারবে না। তারপরও মন্ত্রণালয় ও রেলওয়ে কর্তাদের বেসরকারি হাসপাতালকে জায়গা দিতে এত আগ্রহ কেন তা ভাবনার বিষয় বৈ কি।
এই প্রকল্পের বিরোধিতা যাঁরা করছেন তাঁদের উন্নয়নবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করলে অন্যায় হবে। তাঁরা হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করছেন না। তাঁদের বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট। তাঁরা সরকারি জায়গায় একটি বেসরকারি হাসপাতাল যেখানে কখনো সাধারণ রোগীদের চিকিৎসাসেবা নেওয়ার সুযোগ হবে না তা তুলে ধরতে চাইছেন।
বর্তমান সরকার তথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের চিকিৎসাসেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে চান। কমিউনিটি ক্লিনিক তাঁর একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তার পিতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারাজীবন গরিব দুখী মেহনতি মানুষের কথা ভেবেছেন, তাঁদের জন্য রাজনীতি করেছেন। জনগণের একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লড়াই করেছেন, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন এবং শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন। জাতির পিতার স্বপ্নের শোষণহীন বঞ্চনাহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে, গরিবের কথা ভাবতে হবে, তাদের শিক্ষা-চিকিৎসার কথা ভাবতে হবে। জাতির পিতার শততম জন্মবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর প্রধান উপায়ই হচ্ছে তার আদর্শ ও স্বপ্নের বাস্তবায়ন।
ব্যক্তিগতভাবে কিছু ব্যক্তির পকেট ভারী করার এই সিদ্ধান্ত থেকে সরকার সরে আসবে বলে আশা করি।

লেখক : সাংবাদিক