সিআরবি’র শিরিষতলা এবং নির্মিতব্য হাসপাতাল

42

গত কয়েকদিন যাবৎ সিআরবি এলাকাটি সর্বসাধারণের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এই এলাকায় ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ আর রেলওয়ের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি মোতাবেক, পাঁচশ শয্যার একটি হাসপাতাল হতে যাচ্ছে। বর্তমান করোনা পরিস্থিতি আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে, বাঁচার জন্যে অন্য সব থেকে জরুরি প্রয়োজন হাসপাতাল নির্মাণ। ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ এন্ড কোম্পানি লিমিটেড চট্টগ্রামে এই জরুরি কাজটি করতে যাচ্ছে। এখানে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০০ আসন বিশিষ্ট একটি মেডিক্যাল কলেজ, ৫০ আসনবিশিষ্ট নার্সিং ইনস্টিটিউট এবং ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট একটি আধুনিক হাসপাতাল নির্মান নিঃসন্দেহে একটি ভালো ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন উঠেছে এটি এই এলাকায় কেন; যে এলাকায় রয়েছে প্রাকৃতিক নৈসর্গিক পরিবেশ আর ১৮৭২ সালে নির্মিত বর্তমান চট্টগ্রামের সর্ব প্রাচীনতম ভবন এই সিআরবি। এছাড়া ১৯৩০ সালে চট্টগ্রামে যুববিদ্রোহীরা অর্থ সংগ্রহের জন্যে অভিযান চালিত এটি ঐতিহাসিক স্থানও বটে।
চট্টগ্রাম মহানগর এলাকায় হাতেগোনা যে কয়টি প্রাকৃতিক নৈসর্গিক এলাকা রয়েছে তার মধ্যে সিআরবি সন্নিহিত এলাকায় এই সাত রাস্তার মোড় একটি, যা অধুনা শিরিষতলা হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। পাহাড়ঘেরা প্রাচীন শতবর্ষী বৃক্ষরাজি সুশোভিত ছায়া ও মায়া মিশিয়ে মাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে চট্টলবাসীকে। ইট পাথরে দুর্বিসহ নগর জীবনে নিক্ষিপ্ত মানুষ প্রতিদিন বিক্ষিপ্তভাবে প্রশান্তির অন্বেষায় ছুটে আসে এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমÐিত এলাকায়। নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের আধার এই সিআরবি সংলগ্ন শিরিষতলায় বিশ্রাম, যেন যান্ত্রিক জীবনের যন্ত্রনা থেকে খানিক মুক্তির উপায়। এখানে আঁকা বাঁকা উঁচু নিচু ছোট বড় পাহাড় টিলা বনবনানী সমৃদ্ধ বিরাট এলাকাটি, ভ্রমণ পিপাসু মানুষের কাছে অঘোষিত পর্যটন স্পটে পরিণত হয়েছে।
এই সিআরবি বা সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে, একসময় অবিভক্ত ভারতবর্ষের আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের কেন্দ্রিয় সদরদপ্তর বা হেডকোয়ার্টার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিল। এখন প্রধানদপ্তর এখান থেকে সরিয়ে ঢাকায় স্থানান্তর করা হলে, সরকারি দাপ্তরিক কাজের পরিধি কিছুটা কমে যায়। কিন্তু এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জুলুস তিল পরিমাণ কমেনি। অধিকন্তু কালক্রমে হয়ে উঠেছে নগরবাসীর অতি প্রাণপ্রিয় প্রাঙ্গণ। বর্তমান সময়ে সিআরবি সংলগ্ন এই শিরিষতলায় বাঙালি জাতির প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখ নববর্ষ পালন, বৈশাখীমেলা উদযাপন, বসন্ত বরণ উৎসব, বিভিন্ন জাতীয়দিবস, লোকজ সংস্কৃতি পালনসহ সামাজিক সাংগঠনিক কর্মসূচি অনুষ্ঠানিকভাবে পালনের পীঠস্থানে পরিণত হয়েছে। তাই এখানে হাসপাতাল নির্মাণে যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠা অমূলক কিছু নয়।
আমরা চট্টগ্রামবাসী হাসপাতাল চাই। চট্টগ্রামে এমন কোন সচেতন নাগরিক নেই যে হাসপাতাল নির্মাণের মত এমন মহৎ কাজের বিপক্ষে দাঁড়াবে বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে! তবে মূলকথা হচ্ছে এই সিআরবি এলাকায় কেন? চট্টগ্রাম নগরে হাসপাতাল নির্মাণের মত আরো স্থান রয়েছে, রেলওয়ের অন্যত্র নিজস্ব জায়গাও রয়েছে, যেখান থেকে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ হস্তান্তর করতে পারে। এই এলাকা থেকে যেখানে প্রাকৃতিকভাবে পরিশোধিত বিনা পয়সায় অক্সিজেন পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে মেডিক্যাল বানিয়ে সিলিন্ডার ভর্তি অক্সিজেন, টাকা দিয়ে কেনা কারো কাম্য নয়। এছাড়া বলতে গেলে সিআরবি তো নিজেই একটি হাসপাতাল, এখানে প্রাকৃতিক অক্সিজেন পাওয়া যায়, রোগ প্রতিরোধ করার জন্যে হাঁটার সুযোগ পায়। তাছাড়া এখানে অনেক ঔষধি গাছ রয়েছে।
চট্টগ্রামের বিশিষ্ট নাগরিকগণ প্রদত্ত বিবৃতি থেকে জানতে পারলাম, এই এলাকার সিআরবি ভবনকে সংবিধানে ২য় ভাগের ২৪ ধারা অনুযায়ী ঐতিহ্য হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। অন্যদিকে ‘জাতীয় পরিবেশ নীতি ২০১৮’ এর ৩.১৭ ধারায় আবাসন, নগরায়ন, গৃহায়ন সম্পর্কিত বিষয়ে লেখা আছে; সারা দেশে খেলার মাঠ, পার্ক, বাগান, নার্সারি, উন্মুক্তস্থান ও ঐতিহ্যবাহী প্রতœতাত্তি¡ক স্থাপনাসমূহ সংরক্ষণে গ্রহণযোগ্য মানদÐ অনুযায়ী ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে উন্নয়ন কাজে অগ্রসর হতে হবে।
২০০০ সালে প্রণীত ‘মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকায় খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ’ আইন রয়েছে। এছাড়া জীববৈচিত্র্য ও প্রতœতাত্তি¡ক সংরক্ষণ সম্পর্কিত আরো অনেক আইন ও নীতিমালা রয়েছে। এত সব আইন নীতিমালা উপেক্ষা করে হাসপাতাল নির্মাণ পরিকল্পনা কিভাবে আসে! আগামীতে যাতে সিআরবি এলাকায় কেউ কোন প্রকার নির্মাণ পরিকল্পনা করতে না পারে, এবং পরিবেশের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে, তার জন্যে স্থায়ী ব্যবস্থাগ্রহণ করতে হবে। আর এই জন্যে শতবর্ষী বৃক্ষ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য এলাকাটিকে প্রচলিত আইন অনুযায়ী জীববৈচিত্র্য সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করার দাবী জানাচ্ছি।
পরিশেষে বলতে চাই, অতীতে চট্টগ্রামের প্রাচীনতম এই সিআরবি ভবন ভেঙ্গে নতুন ভবন নির্মাণ, শতবর্ষী বৃক্ষ কাটা, গ্যাসফিলিং স্টেশন প্রতিষ্ঠাসহ অনেক সমস্যা উদ্ভব হয়েছিল, কিন্তু সফল হতে পারেনি, এবারেও পারবেনা। কারণ বীর চট্টলার জনগণ ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় প্রতিবাদ করতে জানে, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে, প্রয়োজনে প্রতিহত করার ক্ষমতা রাখে।
লেখক: সাহিত্যিক ও কলামিস্ট