সাহিত্যে বাংলার নীল বিদ্রোহ

621

ভারতীয় উপমহাদেশে কৃষক সংগ্রামের ইতিহাসে নীল বিদ্রোহ এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। ১৮৫৯-৬০ সালে সারা বাংলায় নীল প্রধান এলাকায় নীল চাষের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল অবিভক্ত বাংলায় নীল চাষের বিরুদ্ধে বাংলার কৃষকরাই এতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। নীল চাষের বিরুদ্ধে সারা বাংলার কৃষক মজদুর সংগ্রামী জনতা সংঘবদ্ধভাবে এটার বিরুদ্ধে গণ প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলেন।
নীলকর সাহেবদের অকথ্য অত্যাচারের কাহিনী গ্রাম-বাংলার জীবনকে তখন ভয়াবহ ও দুর্বিসহ করে তুলেছিল। দীন বন্ধু মিত্রের “নীল দর্পন” নাটক এক সময় বাংলায় অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সমাজ চিন্তার মধ্যেই রাষ্ট্র চিন্তার খোরাক আছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের সংযুক্তবোধ আমরা সর্ব প্রথম দেখতে পাই দীনবন্ধু মিত্রের নীল দর্পন নাটকে। এই মহান নাট্যকার ১৮৭৩ সালের পহেলা নভেম্বর মাত্র ৪৩ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেন।
বাংলার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে প্রায় এক শতাব্দীর মতো সময় ধরে নীলচাষ প্রচলিত ছিল। অবিভক্ত বাংলায় নীল চাষের ইতিহাস থেকে জানা যায় মসিয়ে লুই বণার নামক জনৈক ফরাসী চন্দন নগরের কাছে তালডাঙ্গা ও গোন্দল পাড়ায় সর্বপ্রথম নীলকুঠী স্থাপন করে প্রথম নীলচাষ শুরু করে। সম্ভবতঃ তারই দেখা দেখি “ক্যারল বুম” নামক জনৈক ইংরেজ এদেশে সর্বপ্রথম নীলকুঠী স্থাপন করেন। ১৭৭৯ সালে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানী এদেশে নিজেই নীলচাষ শুরু করেন। নীলচাষে কত কৃষককে যে পিতৃ-পিতামহের ভিটে বাড়ি ছেড়ে পালাতে হয়েছিল, নীলকুঠীর গুদামে অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে সকরুন মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল তার কোন ইয়ত্তা নাই। ফরিদপুরের ম্যাজিষ্ট্রেট “ডেলাতুর” সে সময়ে তাঁর সাক্ষ্য প্রমাণে নীল কমিশনকে বলেছিলেন “এমন একটা নীলের বাঙ্কা ইংল্যান্ডে পৌছায় না যেটা মানুষের রক্তে রঞ্জিত নয়”। ইন্ডিগো কমিশনের মতে ১৮৫৯ সালে বাংলায় প্রায় ৫০০ শত নীলকর মোট ১৪৩টি “ইন্ডিগো কনসার্ণে” কাজ করতো। এই ফার্মগুলোতে পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট নীল উৎপাদন হতো। বাংলার যে যে অঞ্চলে নীলচাষ হতো এবং যেসব স্থানে নীলের কারখানা স্থাপিত হয়েছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, বারাসত, যশোর, খুলনা, বর্ধমান, বাকুড়া, মেদিনীপুর, বীরভূম, হুগলী, হাওড়া রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, রংপুর, চট্টগ্রাম, ঢাকা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ। মুর্শিদাবাদ জেলায় James ঐরষষ ছিলেন অন্যতম প্রধান নীলকর। ঢাকা ও পাশ্ববর্তী জেলা সমূহে যিনি নীলকর ছিলেন তার নাম ছিলsp.wise. তৎকালীন উত্তরবঙ্গ অর্থাৎ রাজশাহী বিভাগে ছিলেন Robert Watson & Company.. সুন্দরবন অঞ্চলের মোড়েলগঞ্জে নীলকর বিরোধী আন্দোলনে এখানে প্রথম শহীদ হয়েছিলেন বীর রহিমুল্লাহ। ১৮৬১ সালের ২৬ নভেম্বর তিনি তৎকালীন কুখ্যাত ইংরেজ জমিদার রবার্ট মোড়েল বাহিনীর হাতে শাহাদৎ বরণ করেন। ইংরেজ নীলকর ছাড়াও ঘধঃরাব দের কিছু কিছু ছোট ছোট নীল ঈড়হপবৎহ ছিল। এমনই একজন Native নীলকর ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ প্রিন্সাদ্বারক নাথ ঠাকুর। নীলকরদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের মধ্যে ছিল নারীর অবমাননা, অপহরণ, জুলুম, অত্যাচার ও ধর্ষণের নানা জনশ্রূতি। বিষয়টি বিতর্কিত এবং এ বিষয়ে তখনো নানা মুনির নানা মত ছিল।
ফরিদপুরের ডেপুটি কালেক্টর ডেলাতুর আরো বলেছেন- “ম্যাজিষ্ট্রেট হিসেবে বহু রাইয়তকে আমার কাছে পাঠাতে দেখেছি যাদের এপিঠ ওপিঠ বর্শাবিদ্ধ। অন্যদেরকেও বর্শাবিদ্ধ করে গুম করা হয়েছে। এরকম নীল পদ্ধতিকে আমি রক্তপাত পদ্ধতি মনে করি।”
তবে একটি বিষয় আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই নীলচাষকে কেন্দ্র করে নানা উপাখ্যান, প্রবাদ গান, গাঁথা, ছড়া ইত্যাদি গড়ে উঠেছিল। আমার বিশ্বাস এখনো যদি প্রচেষ্টা চালানো যায় তাহলে নীল এলাকা থেকে এসব পুরনো প্রবাদ, কবিতা ও গাঁথা উদ্ধার করা সম্ভব। এ জাতীয় ছড়া ও গাঁথাগুলো তখন করে যুগের মন-মানসিকতা ও চৈতন্য চেতনাকে নির্ভূল ও সুস্পষ্টভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরে। এ ধরনের ছড়া, কবিতা, প্রবচন ও গানের কিছু নমুনা এখানে তুলে ধরা হলো—-
মুর্শিদাবাদ জেলায় প্রচলিত পাদ্রী হিল সাহেবের জবান বন্দীতে উল্লিখিত ছড়াটি নীলচাষের অপকারিতা তুলে ধরা হয়েছে ঃ
জমিনের শত্রূ নীল
কর্মের শত্রূ ঢিল
তেমনি জাতের শত্রূ পাদ্রী হিল।
খুলনার নীলকর রেনী সাহেবের লাঠিয়ালদের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হয়েছিলেন শিবনাথ ও সাদেক মোল্লা। স্থানীয় কবির কবিতায় তা সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে-
গুলি গোল্লা সাদেক মোল্লা, রেনীর দর্প করল চুর,
বাজিল শিবের ডঙ্কা, ধন্য বাঙ্গালা বাহাদুর।
নীলকরদের জীবন স্মৃতি সম্পর্কে কটাক্ষ ও বিদ্রুপ করে ডেভিস নামক নীলকর সম্পর্কে বলা হয়েছে-
বজব্য চলে এলোমেলো ডিঙা চলে সাথে,
ডেভী সাহেবের নীল ঘোড়া চলে ভাঙ্গা পথে।
রেণী সাহেব তথা নীলকরদের অত্যাচার সম্বন্ধে অতি সম্প্রতি একটি ছড়া আমাদের হাতে এসেছে। বিষয়টি কৌতুহলোদ্দীপক। পথিক যাচ্ছিল পথ দিয়ে তাকে নীলকর রেণী সাহেবের লোকেরা ধরে এনে বেগার খাটাচ্ছে-
কপালের ফের
যাচ্ছিলাম শউর বাড়ি
কাটতি বসলাম রেনা সাহেবের খের।
নীল বিদ্রোহের আগুন সারা বাংলায় একত্রে জ্বলে উঠেছিল। এই বিদ্রোহ ও হাঙ্গামায় যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের একটি বিবরণ পল্লী চারণের গানে পাওয়া যায়-
আর এল ক্ষেতু পাড়ার রায়।
বিজয় গোবিন্দ চৌধুরী তাঁতি বন্দয়ার বাড়ি\
দুলাইর মুন্সী সাহেব, নন্দী মহাশয় যার নায়ের
আর যান স্থলের পাকরাশী।
মৌলভী আবদুল আলী
ঢাকা শহর যার বাড়ি
সিরাজগঞ্জে হিস্যা যার আছে
তাড়াশে ছোট বাবু, কুঠাল দেখে বড়ই কাবু,
ফরিদপুরে সে দিয়েছে ইজারা।
বড় তরফ বনোয়ারী লাল, যার ডঙ্কা চিরকাল,
সাহেব মারে কল্ল ছার খার।
সে পূণ্যা করে জ্যৈষ্ঠ মাসে
আমরাগণ সব চতুষ্পার্শে
আগে বাঁঝে লাঠির আগায় ফুল।
ড্যামরা আছে ছালু সরকার, করতে দেনা নীলের কারবার।
লাঠি মারে ড্যামরার পচা রায়।
ডেমনগিরী সন্ন্যাসী, বগুড়া জেলা যার বাড়ি
গোসাইদের গুরুদেব সে হয়।
হামকুড়ার মজুমদার, বিশিদের কারপর দাজ,
নাটোরের মহারাজা, বড়ই সুখী তার প্রজা
রতন বিশীর দেখে করে ভয়
(সংক্ষেপিত)
১৮৫৯-৬০ সালে সারা বাংলায় নীল বিদ্রোহ ব্যাপকভাবে সংঘটিত হয়। তারই ফলশ্রুতিতে পল্লী কবির লেখনিতে বাংলায় নীলের গান রচিত হয়েছিল-
মুল্লুকের গুড়াগুড়ি, কবিতার শুরু করি,
যা’ করেন গুরু।
শুন কুঠালের সমাচার কালিদহে কুঠি যার,
ক্যানি সাহেব ক্যাজার করলো শুরু\
সে আউশের জমিতে বুনে নীল, সব রায়তের হলো মুস্কিল
সব রায়তের মনে অবিস্তর।
দিলেতে পাইয়া ব্যথা, নালিশ করে কলকাতা,
দরখাস্ত ছিল তিন সয়াল।
দরখাস্ত হল স্পষ্ট, লাট সাহেব হলো ব্যাস্ত,
বাঙ্গালাতে পাঠাল গবনাল \
(সংক্ষেপিত)
“নীল দর্পন” ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশ করার অপরাধে পাদ্রীলং সাহেবের সে সময় হাজার টাকা জরিমানা ও কারাদন্ড হয়েছিল। “হিন্দু প্যাট্রিয়ট” এর সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নামে মোকদ্দমা ও তাঁর আকস্মিক মৃত্যুর করুন চিত্র তৎকালীন বাউল কবির একটি গানে উঠে এসেছে-
নীল বানরে সোনার বাংলা
করলে এবার ছারকার,
অসময়ে হরিশ মলো
লঙ এর হলো কারাগার।
প্রজা আর প্রাণ বাঁচানো ভার \
নীলকর ডানলপের অত্যাচার ও হত্যাকান্ডের প্রত্যুত্তরে তাঁর কর্মচারী কাঞ্জিলালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ঘটনা ফরায়েজীদের একটি পুঁথিতে উঠে এসেছে-
ফরিদপুর জিলাধীন পাঁচ চড় পর
বাঙালীর নীল কুঠী ছিল তথা বড়।

কালী কাজলিয়া ছিল কর্মচারী বড়।
উৎপীড়ন করিত বড় মোসলমান পর \
একদিন মিঞার শিষ্য কাদের বক্রজান।
দুদু মিঞার এ সারায় লিয়া মুরিদান।
বেঈমানের তরে সবে মারিয়া ফেলিল \
নীল বিদ্রোহের সময় যখন নদীয়ার মোল্লাহাটির নীলচাষ বন্ধ হয়ে গেলো এবং নীলকুঠি লাঠিয়ালদের বড় বড় লাঠি বেকার হয়ে পড়ে রইল তা’ উদ্দেশ্য প্রণিত ছড়াটি হলো-
মোল্লা হাটির লম্বা লাঠি রইল পড়ে হুদোর আটি
কলকাতার বাবু ভেয়ে এল সব বজরা চেপে লড়াই দেখবে বলে।
জোর করে নীলচাষে বাধ্য করার জন্য কৃষকদের শুধু যে গুদামে বন্দী করা হতো তাই নয় তাদের আত্মীয় স্বজনেরা যাতে এ হতভাগ্যদের কোন খোঁজ খবর না’ পান সেজন্য তাদের এককুঠি থেকে অন্য কুঠিতে ঘুরানো হতো। প্রজাদেরকে নীলকররা তাই চৌদ্দ কুঠির জল খাওয়ানোর ভয় দেখাতো।
কেদার নাথ মজুমদার ময়মনসিংহের ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে ১৮৪৩ সালে বাগমারী নীলকুঠীর অধ্যক্ষ কিং সাহেব নীল বুনতে অস্বীকার করায় একজন প্রজার মাথা মুড়িয়ে তাতে কাদা মেখে নীলের বীজ বুনে দিয়েছিলেন।
আজ আর এদেশে নীলচাষ নেই। প্রজারা উৎপীড়িত হয় না নীলকরদের নিকট। তবুও প্রাচীন লোকেরা আজ ও নীলকরদের বর্বোরোচিত অত্যাচার ও জুলুমের কথা মনে করে শিহরীত হয়ে ওঠে।
নীলচাষের শতাব্দীর অভিশাপ ও যাতনা বঞ্চনার ইতিহাস কিভাবে বাঙালীর মন মানসিকতা ও জীবন যাত্রাকে প্রভাবিত করেছিল স্থানীয় কিংবদন্তী, উপাখ্যান কবিতা, গান, ছড়া ও প্রবচন ইত্যাদিতে তার সে ভূরি ভূরি প্রমাণ মিলবে।