সার্ভার ভার্চুয়ালাইজেশন ও ক্লাউড কম্পিউটিং

139

গত পর্বে আপনাদের ভার্চুয়ালাইজেশন কী এবং পিসি বেইজড ভার্চুয়ালাইজেশন সম্পর্কে বলেছিলাম। আজ আপনাদের সার্ভার ভার্চুয়ালাইজেশন সম্পর্কে বলব। সার্ভার কী তা আমরা কম-বেশি সবাই জানি। সার্ভারের মূল কাজ হচ্ছে কম্পিউটারের বিভিন্ন সার্ভিস সার্ভ করা। সাভির্সের ধরন ভেদে সার্ভারের নাম বিভিন্ন রকমের হয়। যেমন : এফটিপি সার্ভার, ওয়েব সার্ভার, মেইল সার্ভার, ডাটাবেজ সার্ভার ইত্যাদি। যখন কোনো নেটওয়ার্কে কোনো ক্লায়েন্টের সঠিক রিকোয়েস্টের বিপরীতে একটা হোস্ট কম্পিউটার রিসোর্স সরবরাহ করে তখন হোস্ট কম্পিউটারকেই সার্ভার বলা হয়।
সার্ভার একটি সাধারণ কম্পিউটারের মতোই কিন্তু এটি ক্লায়েন্ট কম্পিউটারগুলোকে সার্ভিস প্রদান করে বিধায় এর হার্ডওয়্যার সক্ষমতা অনেক বেশি হতে হয়। বর্তমান প্রযুক্তির উন্নতির ফলে এই সার্ভারের কার্যক্রমকে ভার্চুয়ালভাবে পরিচালনা করা যায়। সার্ভার ভার্চুয়ালাইজেশনকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত ফিজিক্যাল মেশিন ভার্চুয়ালাইজেশন এবং দ্বিতীয়ত ক্লাউড ভার্চুয়ালাইজেশন।
ফিজিক্যাল মেশিন ভার্চুয়ালাইজেশন মানে হলো একটি ফিজিক্যাল সার্ভার বা মেশিনে মাল্টিপল সার্ভিস চালানো। যেমন ধরুন, আপনার কাছে একটি ভালো মানের হার্ডওয়্যারযুক্ত একটি সিপিউ বা মেশিন আছে যেখানে আপনি শুধু এফটিপি সার্ভিস ব্যবহার করেন কিন্তু আপনার মেইল ও ওয়েব সার্ভিসের জন্য আরো দুটি সার্ভার প্রয়োজন। আপনার এই ৩টি সার্ভার বা মেশিনের কাজকে ভার্চুয়ালাইজেশনের মাধ্যমে একটি মেশিনে নিয়ে আসাই ফিজিক্যাল মেশিন ভার্চুয়ালাইজেশন অর্থাৎ কম রিসোর্স ব্যবহার করে বেশি সুবিধা নেয়ার জন্যই ভার্চুয়ালাইজেশন। একই মেশিনে ৩টি আলাদা মেশিনের মতো কাজ করা যাবে এবং প্রত্যেকটিতে আলাদা অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করা যাবে।
গত পর্বে আমরা জেনেছিলাম ভার্চুয়াল মেশিন তৈরির জন্য হাইপারভাইজর সফটওয়্যার ব্যবহার করতে হয়। তবে পিসি বেইজড আর সার্ভার বেইজডের জন্য হাইপারভাইজর সফটওয়্যার ভিন্ন। পিসি বেইজড ভার্চুয়ালাইজেশনের জন্য হোস্ট মেশিনের মধ্যে গেস্ট মেশিন তৈরি করতে হয় অর্থাৎ একটি অপারেটিং-এর মধ্যে আরেকটি অপারেটিং সিস্টেম ইন্সটল করতে হয় কিন্তু এক্ষেত্রে তেমনটি নয়। হাইপারভাইজর সফটওয়্যার একটা এনভায়রনমেন্ট তৈরি করে দেবে যা সিস্টেম বুট হতে সাহায্য করবে এবং সেখানে আপনি আপনার প্রয়োজনমতো হার্ডওয়্যার কাস্টমাইজ করে ভার্চুয়াল মেশিন তৈরি করতে পারবেন। ফিজিক্যাল মেশিন ভার্চুয়ালাইজেশনের জন্য হাইপারভাইজর সফটওয়্যার হিসাবে হাইপার-ভি, ভিএমওয়্যার ইএসএক্সআই এবং লিনাক্স এ জেন সার্ভার উল্লেখযোগ্য। আমি ব্যক্তিগতভাবে ভিএমওয়্যার ইএসএক্সআই ব্যবহার করি। এটি খুবই সহজ ও সুবিধাজনক।
এবার আসি ক্লাউড ভার্চুয়ালাইজেশনের ব্যাপারে। বর্তমান সময়ে ভার্চুয়ালাইজেশনকে আরো একধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে এই ক্লাউড কম্পিউটিং। এই নাম শুনে মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে কেন এর নাম এই রকম রাখা হলো। আসলেই কি আকাশে বা মেঘে কোনো কম্পিউটার আছে? না আসলে ব্যাপারটি সেরকম কিছু নয়। আপনি যদি মেঘের কথা ভাবেন মানে এর গঠনের কথা তাহলে আমরা জানি যে পানির অণুগুলো একত্রিত হয়ে মেঘের সৃষ্টি হয় এবং এই মেঘ থেকে যখন বৃষ্টি হয় তখন তা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বৃষ্টি কিন্তু এক জায়গায় নির্দিষ্ট হয়ে পড়ে না এবং একইভাবে মেঘ তার অবস্থানের পরিবর্তন করে সব জায়গায় বৃষ্টি বর্ষণ করে থাকে। এই ক্লাউড কম্পিউটারও অনেকটা মেঘের গঠনে তৈরি এবং এর কাজও প্রায় একই রকম। ক্লাউড কম্পিউটারগুলো হাজার হাজার কম্পিউটার একত্রিত করে বানানো হয় এবং এটি দুনিয়ার যেখান থেকে ইচ্ছা সেখান থেকে ব্যবহার করা সম্ভব। এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে এই প্রযুক্তিটিকে ক্লাউড কম্পিউটিং নামকরণ করা হয়েছে।
একটা উদাহরণ দিলে আশা করি ব্যাপারটি বুঝতে পারবেন। মনে করুন আপনার কাছে একটি কম্পিউটার আছে যেটি দিয়ে আপনি সাধারণ কাজ যেমন টাইপ করা, গানশোনা ইত্যাদি করে থাকেন। এখন ধরুন আপনার প্রয়োজন পড়ল কোনো উচ্চমান কাজ যেমন গ্রাফিক্স বা ভিডিও রেন্ডারিং-এর মতো কাজ অথবা একটি সার্ভারই বানাতে চাইছেন। আমরা জানি এই কাজ আপনি একটি সাধারণ কম্পিউটার দিয়ে করতে পারবেন না। আর যদি করতেও চান তবে আপনাকে আপনার কম্পিউটারটি আপগ্রেড করাতে হবে, আর এতে অনেক টাকা খরচ হতে পারে। ক্লাউড কম্পিউটিং এ কাজটিকে খুব সহজ করে দিয়েছে যেখানে আপনি ইন্টারনেটের মাধ্যমে একটি উচ্চমানের কম্পিউটারের সাথে যুক্ত হয়ে আপনার প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারবেন। আর এটির জন্য খরচও খুব কম। আপনি দূর হতেই এই কম্পিউটারটি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন অর্থাৎ আপনি অর্থের বিনিময়ে আরেকজনের রিসোর্স ব্যবহার করছেন। বর্তমানে বিশ্বের সব বড় বড় কোম্পানি এ খাতে বিনিয়োগ করে বিশাল আকৃতির ইনফ্রাস্ট্রাকচার গড়ে তুলেছে। আপনারা আমাজন-এর নাম শুনে থাকবেন। ই-কমার্স সাইট হিসাবে যার খ্যাতি বিশ্বজুড়ে। ক্লাউড সার্ভিসে তাদের আমাজন ওয়েব সার্ভিস (এডবিøউএস) প্রথম স্থান দখল করে রেখেছে। ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানি গত বছর প্রায় ২৫.৬ বিলিয়ন ডলার ব্যবসা করেছে। তাদের ক্লায়েন্ট লিস্টে বিশ্বের বড় বড় প্রতিষ্ঠানের নাম যুক্ত আছে। নেটফ্লিক্স, লিংকডইন এবং এডোবির মতো প্রতিষ্ঠান তাদের ক্লায়েন্ট। আমাজন ছাড়াও মাইক্রোসফট-এর আ্যজুর ও গুগল ক্লাউড-এর ক্লাউড সার্ভিস অন্যতম।
এখন আপনাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে ক্লাউডে সার্ভার ভার্চুয়ালাইজেশন কীভাবে হয়? প্রায় সব ক্লাউড সার্ভিস প্রতিষ্ঠানেরই কাজ একই। এখানে আমরা আমাজন সম্পর্কে জানি। আপনি ক্লাউড সার্ভিস কোম্পানির অফার থেকে প্রথমে হার্ডওয়্যার ক্যাপাসিটি ঠিক করবেন মানে আপনার কী মানের মেশিন লাগবে, তার প্রসেসর কী হবে, র‌্যামের সাইজ কত হবে, হার্ডডিস্কের সাইজ কত হবে সেটি নির্বাচন করবেন। তারা আপনাকে একটি কন্ট্রোল প্যানেল দেবে। যেকোনো ওয়েব ব্রাউজার দিয়ে আপনি সেটাতে প্রবেশ করতে পারবেন। এবার আপনি তাদের লিস্ট থেকে আপনার প্রয়োজনীয় সার্ভিসের অপারেটিং সিস্টেম ইন্সটল করে নেবেন।
আপনার মেশিনটি লাইভে ব্যবহার করার জন্য একটি পাবলিক আইপিও পেয়ে যাবেন। বিশ্বের যেকোন স্থান থেকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে আপনার সার্ভার সর্বদা যুক্ত থাকবে। এখানে একটি ব্যাপার আমাজন এই যে আপনাকে ক্লাউড সুবিধা দিচ্ছে তাও কিন্তু ভার্চুয়ালাইজেশনের মাধ্যমে। তা না হলে প্রতিটি ক্লায়েন্টকে একটি করে মেশিন দিতে হতো। আমাজন তাদের সেবা পরীক্ষা করার জন্য ৭৫০ ঘণ্টার একটি ফ্রী অফার দিয়েছে। আপনারা চাইলে বিনামূল্যে ক্লাউড সার্ভারের সুবিধা নিতে পারেন। ভার্চুয়ালাইজেশন কম্পিউটার ব্যবহারে এক যুগাস্তকারী পরিবর্তন এনেছে। তাই প্রযুক্তিবিদদের কাছ এটি এত জনপ্রিয়।