সার্বিক পর্যবেক্ষণে সীমান্ত পরিস্থিতি

15

বান্দরবান ও নাইক্ষ্যংছড়ি প্রতিনিধি

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমারের ওপারে গোলাগুলি অব্যাহত রয়েছে। গতকাল সোমবার সকালেও তীব্র গোলাবর্ষণ হয়েছে। এতে আতঙ্কে স্থানীয় লোকজন নিরাপদ আশ্রয়ে সরতে শুরু করেছে।
এদিকে সীমান্তের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে গতকাল সোমবার সকালে তুমব্রু সীমান্তের বিভিন্ন জায়গা পরিদর্শন করেছেন বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি। এসময় তিনি নো ম্যান্স ল্যান্ডসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখেন এবং ঘুমধুম থেকে স্থানান্তরিত হওয়া উখিয়ার কুতুপালং উচ্চ বিদ্যালয় এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। জেলা প্রশাসকের সাথে বান্দরবান জেলা পুলিশ সুপার মো. তারিকুল ইসলাম, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সালমা ফেরদৌস, জেলা পরিষদ সদস্য ক্যনুয়ান চাক, থানা অফিসার ইনচার্জ টান্টু সাহা, ঘুমধুম ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ, সাবেক চেয়ারম্যান তসলিম ইকবাল চৌধুরীসহ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সীমান্ত পরিদর্শনকালে জেলা প্রশাসক সাংবাদিকদের বলেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে গোলাগুলি ও বাংলাদেশ সীমান্তে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে গত শনিবার শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বিবেচনায় ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে উখিয়ার কুতুপালং উচ্চ বিদ্যালয়ে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। সীমান্তের বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষ যেন নিরাপদে থাকে, এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হবে। এছাড়া সীমান্ত থেকে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারগুলো সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে বাচাই করার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তবে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে পরিবারগুলোর মতামতকে প্রধান্য দেওয়া হবে বলে জানান জেলা প্রশাসক।
এর আগে রবিবার সকালে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ে নাইক্ষ্যংছড়িতে উপজেলা পরিষদে অনুষ্ঠিত জরুরি সভায় স্থানীয়দের সরিয়ে নেওয়াসহ বৈঠকে বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাব জেলা প্রশাসক বরাবরে পাঠানো হয়। এ বিষয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সালমা ফেরদৌস জানান, গত রবিবার জরুরি বৈঠকে সীমান্তের ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারগুলোকে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব আসে জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে তাদের সরিয়ে নেয়া হতে পারে।
জেলা পুলিশ সুপার মো. তারিকুল ইসলাম জানান, সীমান্তে গোয়েন্দা নজরধারী বাড়ানো হয়েছে এবং পুলিশ বিজিবি’র সাথে সমন্বয় করে সীমান্তে কাজ করছে। স্থানীয়রা জানান, গত শুক্রবারের ঘটনার পর থেকে সীমান্তের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে বিজিবির সদস্যসংখ্যা বাড়ানো হয়েছে, জোরদার করা হয়েছে বিজিবির টহল। সীমান্তে উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে তুমব্রু সীমান্তের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ রাখা হয়েছে। আশপাশের বিদ্যালয়গুলো খোলা থাকলেও উপস্থিতি কম।
স্থানীয়রা আরো জানান, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘর্ষে ব্যবহার করা হচ্ছে হাল্কা ও ভারি অস্ত্রের ব্যবহার। বিস্ফোরণের শব্দে কম্পিত হচ্ছে তুমব্রু, বাইশফারি, ফাত্রাঝিরি, রেজু আমতলি, গর্জবনিয়াসহ সীমান্ত লাগোয়া গ্রামগুলো। এতে স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ফাটল ধরেছে মাটি দিয়ে তৈরি ঘরের দেয়াল। প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছেন না কেউ।
জেলা প্রশাসক ইয়াসমিন পারভীন তিবরীজি ও পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলামসহ প্রতিনিধি দলটি বেলা ১১টায় ঘুমধুম পৌঁছে পার্শ্ববর্তী কুতুপালং উচ্চবিদ্যালয় পরীক্ষা কেন্দ্রে যান। সেখানে ঘুমধুম উচ্চবিদ্যালয় থেকে সরানো সাড়ে ৪শত পরীক্ষার্থীর খোঁজখবর নেন তারা। পরে তারা তুমব্রু শূন্যরেখায় বসবাসরতদের অবস্থান দেখেন। আর তাদের প্রতিনিধিদের সাথে কথা বলেন।
এ সময় শূন্যরেখায় অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের নেতা মাস্টার দিল মোহাম্মদ ও মোহাম্মদ আরেফ আহমদ জেলা প্রশাসককে বলেন, শূন্যরেখা থেকে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে দিতে ২০১৮ সালের ২ মার্চ তুমব্রু সীমান্তে সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছিল মিয়ানমার। তখন প্রতিদিন গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যেত। মাইকিং করে শূন্যরেখার রোহিঙ্গাদের দ্রæত স্থান ত্যাগ করতে বলা হতো। নইলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে বলে হুমকি দিত তারা। বিজিবির তৎপরতায় তখন সেনা সমাবেশ সরিয়ে নিলেও একাধিক চৌকি স্থাপন করে রোহিঙ্গাদের কঠোর নজরদারিতে রাখা হয়েছিলো তখন।
তারা আরো বলেন, তারই ধারারবাহিকতায় সর্বশেষ কৌশল হিসেবে তাদের ক্যাম্পে মর্টারশেল নিক্ষেপ করে হত্যা করা হয় এক নিরীহ রোহিঙ্গাকে। সে ঘটনায় আহত হয় আরো ৭ জন। যারা এখনও চিকিৎসা নিচ্ছে বিভিন্ন হাসপাতালে।
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জাহাঙ্গির আজিজ এ প্রতিবেদককে বলেন, সীমান্ত পরিস্থিতি নাজুক হয় শুক্রবার রাত থেকে। সেদিন রোহিঙ্গা মো. ইকবাল উদ্দিন নিহত হয়েছিল। তখন আহত হয় আরো কয়েকজন। আর এর পরদিন শনিবার থেকে ঘুমধুম উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের পরীক্ষার্থীদের সরানো হয় অন্যত্র। সবর্ত্র আতংক ছড়িয়ে পড়লে নাজুক পরিস্থিতিতে তুমব্রু থেকে বাইশফাঁড়ি পর্যন্ত বেশ কয়েকটি পাড়ার ৩শ বাংলাদেশি পরিবারকে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে নিতে পরিদর্শনে আসেন জেলা ও উপজেলা প্রশাসকরা।