সারাদিন ধর্মঘট সন্ধ্যায় প্রত্যাহার

22

নিজস্ব প্রতিবেদক

চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যানকে প্রত্যাহার, চরপাড়া ঘাটের ইজারা বাতিলসহ পাঁচ দফা দাবিতে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট শুরু করেছিলেন লাইটারেজ জাহাজ শ্রমিকরা। এতে চট্টগ্রাম থেকে বন্ধ ছিল দেশের বিভিন্ন স্থানে পণ্য পরিবহন। তবে ঘাট ইজারা স্থগিতের আশ্বাসে ১৩ ঘণ্টা পর ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছে লাইটারেজ শ্রমিক ইউনিয়ন। সন্ধ্যায় বন্দর ভবনে স্থানীয় সংসদ সদস্য, বন্দর চেয়ারম্যান, লাইটারেজ শ্রমিক ইউনিয়ন, লাইটারেজ শ্রমিক ফেডারেশন ও ঠিকাদার সমিতির নেতাদের সভায় কর্মবিরতি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হয়। এতে পতেঙ্গা চরপাড়া ঘাটের ইজারা বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু এবং লাইটারেজ শ্রমিকদের কাছ থেকে ঘাটে টাকা না নেওয়ার আশ্বাসে কর্মবিরতি প্রত্যাহার করেছেন লাইটারেজ শ্রমিকরা। বিষয়টি নিশ্চিত করেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক।
গতকাল শুক্রবার ভোর ৬টা থেকে লাইটারেজ জাহাজের শ্রমিকরা কর্ণফুলী নদীর ১৬টি ঘাট এবং বহির্নোঙ্গরে অবস্থানরত মাদার ভ্যাসেল থেকে পণ্য উঠা-নামা বন্ধ রেখেছিলেন। সন্ধ্যা ৭টা থেকে তা পুনরায় চালুর সিদ্ধান্ত হয়।
জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দর এবং বহির্নোঙর থেকে সারাদেশের নৌরুটে অন্তত হাজার লাইটারেজ জাহাজ পণ্য আনা-নেওয়া করে। এসব জাহাজে শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। আমদানি করা ভোগ্যপণ্য, সিমেন্ট ক্লিংকারসহ বিভিন্ন খোলা পণ্য নিয়ে বহির্নোঙ্গরে আসা মাদার ভ্যাসেল (বড় জাহাজে) থেকে পণ্য খালাস হয় লাইটারেজ জাহাজে। এরপর নৌ-রুটে বিভিন্ন গন্তব্যে সেসব পণ্য নিয়ে যায় লাইটারেজ জাহাজগুলো।
বাংলাদেশ লাইটার শ্রমিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি মোহাম্মদ নবী আলম পূর্বদেশকে বলেন, ‘নৌযান শ্রমিকদের আপত্তি সত্তে¡ও বন্দর কর্তৃপক্ষ চরপাড়া ঘাট ইজারা দিয়েছে। ইজারাদারদের আর্থিক ও শারীরিক অত্যাচার নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে শ্রমিকরা চরপাড়াঘাট ত্যাগ করে পারকির চরে আশ্রয় নেয়। তারপরও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ইজারাদারদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে বরং বন্দর কর্তৃপক্ষ পারকির চর থেকে সকল জাহাজ চরপাড়া ঘাটে নিয়ে যাওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। এতে নৌযানের নাবিকরা কিনারে নামার পর চাইনিজ ঘাট থেকে জাহাজে ওঠার সব ধরনের ট্রলার ও স্পিডবোট বন্ধ করে দিয়েছে। এ অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে বন্দর চেয়ারম্যান আর ইজারাদার জাহাজের নাবিকদের মানুষ ভাবছেন না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই অপমান অত্যাচার বন্ধ না করে বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান নৌযানের শ্রমিকদের বন্দর ব্যবহারের সুযোগকে বাধাগ্রস্ত করে চলেছেন। তাই চরপাড়া ঘাটের ইজারা বাতিল, বন্দর চেয়ারম্যানকে প্রত্যাহার, পতেঙ্গা থানার ওসিকে প্রত্যাহার, লোড ও খালি জাহাজ সার্ভে করা এবং সাঙ্গু নদীর মুখ ড্রেজিং করে পরিষ্কার করার দাবিতে শুক্রবার ভোর থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য চট্টগ্রামে আমাদের কার্যক্রম বন্ধ রাখি। পরে কর্মকর্তাদের আশ্বাসে আবার প্রত্যাহার করে নিয়েছি।’
আকস্মিক লাগাতার কর্মসূচির বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ লাইটারেজ শ্রমিক ইউনিয়নের চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি শেখ মোহাম্মদ ঈছা মিয়া বলেন, ‘গতবছর পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত সংলগ্ন চরপাড়া এলাকায় বন্দর কর্তৃপক্ষ একটি ঘাট নির্মাণ করে। শ্রমিকরা সেই ঘাট ব্যবহার করতো। কিন্তু হঠাৎ করে বন্দর কর্তৃপক্ষ সেটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দেয়। তারা ঘাট ব্যবহারে দশ টাকা মাশুল নির্ধারণ করে। এ নিয়ে ইজারাদারের লোকজনের সঙ্গে শ্রমিকদের প্রায়ই অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে থাকে। গত ৩ নভেম্বর শ্রমিকদের বিরুদ্ধে হামলার ঘটনা ঘটে। কিন্তু পতেঙ্গা থানা পুলিশ মামলা না নিয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) নেয়। এ অবস্থায় শ্রমিকরা চরপাড়া ঘাট ত্যাগ করে আনোয়ারায় পারকি সমুদ্র সৈকত সংলগ্ন এলাকা থেকে লাইটারেজ জাহাজে ওঠা নামা শুরু করেন। কিন্তু স¤প্রতি বন্দর কর্তৃপক্ষের ম্যাজিস্ট্রেট অভিযান চালিয়ে পারকি থেকে জাহাজে ওঠানামা বন্ধ করে দেন। এরপর শ্রমিকরা চাইনিজ ঘাট এলাকা থেকেও জাহাজে ওঠানামার চেষ্টা করলে বন্দর কর্তৃপক্ষ সেখানেও অভিযান পরিচালনা করে।’
ঈছা মিয়া আরও বলেন, ‘বন্দর কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ শ্রমিকদের মানুষ মনে করছে না। ইজারাদারদের মাধ্যমে শ্রমিকদের জিম্মি করে ফেলেছে। আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এজন্য আমরা বন্দরের চেয়ারম্যান ও পতেঙ্গা থানার ওসি প্রত্যাহার, চরপাড়া ঘাটের ইজারা বাতিলসহ পাঁচ দফা দাবিতে কর্মবিরতি শুরু করেছি। দাবি মেনে না নেওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।’
নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মোহাম্মদ শাহআলম বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কারও সঙ্গে আলোচনা না করেই নৌযান শ্রমিকদের যাতায়াতের একটি ঘাট বন্ধ করে দিয়েছে। এর প্রতিবাদে চট্টগ্রামে নৌযান শ্রমিকরা শুক্রবার সকাল থেকে কর্মবিরতি পালন করছে। আমরা এটিকে সমর্থন করেছি। কর্মবিরতি শুধু চট্টগ্রামের ঘাটগুলোতে চলছে। বাকিগুলো স্বাভাবিক ছিল।’
বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, বিষয়টি ভুল বুঝাবুঝি ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি বলেন, শ্রমিকদের সুবিধার জন্যই বন্দর কর্তৃপক্ষ ঘাট তৈরি করে দিয়েছে। কিন্তু ঘাটটি তো কাউকে না কাউকে পরিচালনা করতে হবে। সবদিক বিবেচনা করে শ্রমিকদের থেকে শুধুমাত্র দশ টাকা মাশুল নেওয়ার শর্তে বন্দর কর্তৃপক্ষ ঘাটটি ইজারা দিয়েছে। এটা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। আমরা শ্রমিকদের সঙ্গে সন্ধ্যায় আলাপ-আলোচনা করেছি। সেখানে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণও ছিলেন। এতে সিদ্ধান্ত হয় যে, পতেঙ্গা চরপাড়া ঘাটের ইজারা বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু এবং লাইটারেজ শ্রমিকদের কাছ থেকে ঘাটে টাকা না নেওয়ার আশ্বাস প্রদান করা হয়। এরপর কর্মবিরতি প্রত্যাহার করেন লাইটারেজ শ্রমিকরা।