সাতই মার্চের ভাষণের নূতন প্রাসঙ্গিকতা

51

আবদুল মান্নান

একটি ভিন্ন মাত্রায় ২০২১ সালের ঐতিহাসিক সাতই মার্চ পালিত হবে। এখন জাতির পিতা শেখ মুজিবের জন্ম শতবর্ষ পালিত হচ্ছে। ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি আর গত ২৬ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এক অজ্ঞাত কারণে এই বছর বিএনপি সাতই মার্চ পালন করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। এটি একটি কৌতুহল উদ্দিপক ঘটনা। ইতোমধ্যে বিএনপি’র মহাসচিব ঘোষণা দিয়েছেন তারা সাতই মার্চের বক্তৃতাকে খাটো করতে চান না। তিনি হয়তো ভুলে গেছেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর তার নেতা ও বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা, বাংলাদেশের প্রথম সেনা শাসক আইন করে বঙ্গবন্ধুর নাম নেয়া নিষিদ্ধ করেছিলেন। নিষিদ্ধ করেছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সহ সকল রাজনৈতিক দলের কর্মকান্ড।অনেক স্থানে কিছু তরুন সাতই মার্চের ভাষণ বাজানোর জন্য গ্রেফতার হয়েছিলেন। যখন জিয়া জামায়াত, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামি সহ অন্যান্য স্বাধীনতা বিরোধী দলগুলোকে রাজনীতি করার জন্য প্রস্তুত করেছেন তখন তিনি সেই সব দল গুলোর সাথে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকেও ঘরোয়া রাজনীতি করার অনুমতি দেন। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে বাহাত্তর সালের সংবিধান রচিত হলে সেই সংবিধানে এই সব স্বাধীনতা বিরোধী দলগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এর আগে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ নির্বাহী আদেশ বলে এই সব দল নিষিদ্ধ করেছিলেন। জিয়া এই সব স্বাধীনতা বিরোধী দলগুলোকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার অনুমতি দেয়ার আগে পাকিস্তানি নাগরিক, একাত্তরে জামায়াতে ইসলামের আমির ও সেই সময়কারের ঘাতকদের শিরোমনি গোলাম আযমকে বাংলাদেশ আসার অনুমতি দেন।
কেমন হবে বিএনপি’র সাতই মার্চ পালন তার কিছু আলামত পাওয়া যাচ্ছে। বিএনপি’র একজন নেতাতো বলেই ফেলেছেন সাতই মার্চের বক্তৃতা শুনে বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে যায়নি তারা জিয়ার তথাকতিথ ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করছিল। কথাবার্তা শুনে মনে হয় বিএনপি’র নেতৃবৃন্দের ইতিহাস জ্ঞান কম। তাদের জানা উচিত আভিধানিক অর্থে বিশ্বের কোন দেশে কারো ঘোষণা শুনে ফুটবল খেলার মতো মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়নি। যে কোন মুক্তিযুদ্ধের জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতি প্রয়োজন হয়। কোন দেশের স্বাধীনতা বা মুক্তি কেন প্রয়োজন তার যুক্তিসংগত সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ থাকতে হয়। সেই কারণগুলোকে জনগণের কাছে নিয়ে যেতে হয় বা জনগণ নিজ হতেই তা উপলব্দি করেন। মুক্তি বা স্বাধীনতার জন্য তাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে হলে চাই সংগঠন আর যোগ্য নেতৃত্বের। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন, আলজেরিয়ার বেন বেল্লা, ইন্দোনেশিয়ার সোয়েকার্নে, ভিয়েতনামের হো চে মিন বা ভারতের মহাত্মা গান্ধি, এরা কেউ বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে তাদের দেশকে স্বাধীন করেন নি। তার জন্য নিজে দেশের মানুষকে প্রস্তুত করতে হয়েছে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে সম্ভব না হলে দেশের মানুষ নেতার নেতৃত্বে দেশের মুক্তির জন্য যুদ্ধ গিয়েছেন। বিএনপি’র অনেক পÐিত রাজনীতিবিদ আছেন। তাদের অনুরোধ করি আর কিছু না হোক অন্তত যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ইতিহাস পড়ে দেখুন। বাংলাদেশেও পাকিস্তানের দীর্ঘ তেইশ বছরের শাসনকালে এই কাজটি আওয়ামী লীগ করেছে। মূল নেতৃত্বে ছিলেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানি, হোসেন শহীদ সোহরোওয়ার্দী আর শেখ মুজিবুর রহমান। এক সময় মাওলানা ভাসানি আওয়ামী লীগ হতে সরে গিয়ে নিজে ন্যাপ গঠন করেন এবং ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সেনা প্রধান আইউব খান দেশটির ক্ষমতা দখল করলে মাওলানা ভাসানি তাকে সমর্থন করা শুরু করেন। হোসেন শহীদ সোহরোওয়ার্দি পাকিস্তানি কারাগারে দীর্ঘ দিন কাটানোর পর মুক্তি পেয়ে বৈরুতে ইন্তেকাল করেন। এরপর আওয়ামী লীগের হাল ধরেন দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব। কিছুদিন আবদুর রশিদ তর্কবাগিশ দলের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব ছয়দফা ঘোষণা করলে তিনি তাঁর সাথে দ্বিমত প্রকাশ করে দল হতে পদত্যাগ করেন। ১৯৭৫ সালের পনেরই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলে তিনি ও মাওলানা ভাসানি সেই হত্যাকাÐে তাঁদের সমর্থন প্রকাশ করেন। এই সব ইতিহাস বিএনপি নামক সংগঠনটির ক’জনে জানেন তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। বিএনপি’র সাতই মার্চ পালন উপলক্ষ্যে দলের শীর্ষ ইতিহাসবিদ জিয়ার লন্ডনে পলাতক ও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যদি ঘোষণা করেন ‘শেখ মুজিব সাতই মার্চ বক্তৃতা দিতে যাওয়ার আগে তার পিতার সাথে দীর্ঘ সময় ধরে আলাপ করে যান’ তা হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবেন না। হয়তো বিএনপি’র মহাসচিব এমনও বলতে পারেন জিয়া যে লিখিত ভাষণ শেখ মুজিবকে দিয়েছিলেন তাই তিনি সে দিন রমনা রেস কোর্সে পাঠ করেছিলেন। গত মঙ্গলবার মির্জা ফখরুল রাজশাহীতে তাদের দলের এক অঙ্গসংগঠনের সভায় গণতন্ত্রের সবক দিচ্ছিলেন। সেই সভায় আবর একজন জানিয়ে দিলেন ২১ আগষ্ট ছিল ১৫ আগষ্টের ধারাবাহিকতা। কি ভয়াবহ উচ্চারণ! যে দলের প্রতিষ্ঠাতা বছরের পর বছর রাতের বেলায় কারফিউ দিয়ে দেশ শাসন করেন, যিনি প্রায় বিনা বিচারে প্রায় চার হাজার সেনা সদস্যকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেন তার প্রতিষ্ঠিত দলের নেতা নেত্রীদের কাছ হতে গণতন্ত্র শিখতে হলে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
আসি সাতই মার্চের সেই ঐতিহাসিক জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রসঙ্গে। তার আগে আমাদের ঐসময়ের এক সপ্তাহ আগের ঘটনা পঞ্জির দিকে ফিরে তাকাতে হবে। ১৯৭০ এর নির্বাচনে পাকিস্তানের গণপরিষদের তিনশটি আসনের মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসনে জিতে সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেল। নিয়ম অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পাকিস্তানের সরকার গঠিত হবে। পাকিস্তানের সেনা শাসক ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করলেন ৩রা মার্চ ঢাকায় সংসদ অধিবেশন শুরু হবে। সেই মতে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক দল হতে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা ঢাকা আসা শুরু করলেন। পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাদের প্ররোচনায় বিগড়ে বসলেন পাকিস্তানের রাজনীতির চানক্য খ্যাত পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলি ভুট্টো। তিনি সংসদে দ্বিতীয় সংখ্যা গরিষ্ঠ আসনে জয়ী হয়েছেন। জানিয়ে দিলেন সংসদের বাইরে সংবিধানের মৌলিক বিষয় গুলোর মিমাংসা হতে হবে। এর আগে যদি কোন সংসদ সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান হতে পূর্ব পাকিস্তানে সংসদ অধিবেশনে যোগ দিতে যান তা হলে তাদের ঠ্যাং ভেঙে দেবেন। ইয়াহিয়া খান গেলেন ভূট্টোর লারকানার বাড়িতে। দুজনে শলা পরামর্শ করলেন কিভাবে বঙ্গবন্ধুকে সরকার গঠন হতে ঠেকানো যায়। বাঙালিরা পাকিস্তানিদের শাসন করবে এটাতো মানা যায় না। বঙ্গবন্ধু নির্বাচনের আগেই ঘোষণা করেছেন আওয়ামী লীগের ছয় দফাই হবে দলের নির্বাচনি মেনিফেস্টো। সংবিধান রচিত হবে তার ভিত্তিত। ছয় দফা বঙ্গবন্ধুর কাছে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির পবিত্র আমানত। তিনিতো তাদের সাথে বেইমানি করতে পারেন না। ইয়াহিয়া ভূট্টো আঁতাত বঙ্গবন্ধুর সক্ষমতা আর তার পিছনে জনগণের সমর্থনের বিষয়টা আঁচ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
সত্তরের নির্বাচন পরবর্তিকালে বঙ্গবন্ধু নিয়মিত দলের নির্বাচিত সংসদ সদস্য আর নেতা কর্মীদের নিয়ে হোটেল পূর্বানিতে সভা করতেন। সংসদ অধিবেশন বসলে সংসদে নিজেদের কর্মকৌশল কি হবে তা নিয়ে আলোচনা করতেন। সভার পর সাংবাদিকদের সাথে নিজে কথা বলতেন। ইতোমধ্যে ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেছেন মার্চের তিন তারিখ ঢাকায় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন শুরু হবে। এক তারিখ ঢাকা স্টেডিয়ামে (এখন বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম) পাকিস্তান বনাম ইংল্যান্ড হতে আগত এমসিসি‘র ক্রিকেট ম্যাচ চলছিল। দুপুর একটার রেডিও সংবাদের মাধ্যমে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করলেন ৩রা মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। সে দিন এই একটি ঘোষণাই পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেকটা টোকা হয়ে গিয়েছিল। রেডিওর খবরটা সারা দেশে অগ্নিষ্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়লো। পন্ড হয়ে গেল ঢাকা স্টেডিয়ামের ক্রিকেট খেলা। হঠাৎ ঢাকা হয়ে উঠলো মিছিলের নগরি। শ্লোগান উঠলো ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। বঙ্গবন্ধু হোটেল পূর্বাণি হতে বের হয়ে এসে উপস্থিত সাংবাদিকদের জানালেন জাতীয় সংসদ অধিবেশন স্থগিত করা খুবই দুঃখজনক। তিনি ঘোষণা করলেন এর প্রতিবাদে পরদিন ঢাকা শহরে ও তিন তারিখ সারা দেশে সকাল সন্ধ্যা হরতাল পালিত হবে। তিনি এও ঘোষণা করলেন সাতই মার্চ রমনা রেস কোর্স ময়দানে এক জনসভায় তিনি চূড়ান্ত কর্মসূচী ঘোষণা করবেন। এক তারিখ রাতেই ঢাকা দেশের অন্যান্য বড় বড় শহরে জারি হলো কারফিউ। ঘোষণা করা হলো ‘দেখা যাওয়া মাত্র গুলি করা হবে’। যে বাঙালি অনেক আগেই মৃত্যুকে জয় করেছে সেই বাঙালি কি আর গুলিকে ভয় পায়। রাতে প্রায় সব বড় বড় শহরে কারফিউ ভেঙ্গে রাজপথে হাজার হাজার মানুষ শ্লোগান তুললো ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন করো। জয় বাংলা।’ টঙ্গি আর আদমজির শ্রমিকরা বের হয়ে একই শ্লোগান তুললো। ঢাকা সহ সারা বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর ডাকে আন্দোলন ছড়িয়ে গেল। যে সব নাদানরা আজকের প্রজন্মকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার নূতন ইতিহাস শিখাতে চায় তারা কি এই সব ইতিহাস জানে? না ভুলে গেল? নাকি মানুষকে বোকা মনে করে? দ্রæত পূর্ব বাংলার প্রশাসনিক ক্ষমতা সরকারের হাত হতে বঙ্গবন্ধুর হাতে চলে যাওয়া শুরু হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে ৬ মার্চ ইয়াহিয়া খান পূর্ব বাংলার ভদ্রলোক গভর্নর ভাইস-এডমিরাল আহসানকে পরিবর্তন করে বেলুচিস্তানের কসাই হিসেবে খ্যাত লেঃ জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব বাংলার গভর্নর নিয়োগ করেন।
এলো সেই সাতই মার্চ ১৯৭১, রবিবার। আজ বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালিকে আসন্ন কঠিন সময় মোকাবেলা করার পথ দেখাবেন। বলবেন যেই ঝড় আসবে বলে তিনি আঁচ করছেন সেই ঝড় মোকাবেলা করার কৌশলের কথা বলবেন। দিনের বেলায় অনেকে বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর ধানমন্ডির বাড়িতে গিয়ে দেখা করলেন। সে দিন তিনি ১০৩ ডিগ্রী জ্বরে আক্রান্ত। সকলে গিয়ে পরামার্শ দিচ্ছেন তিনি তাঁর বিকালের ভাষণে কি বলবেন। এক সময় এলেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন কন্সাল জেনারেল জোসেফ ফ্যারল্যান্ড। তিনি বঙ্গবন্ধুকে সাফ জানিয়ে দিলেন তিনি যদি আজ এক তরফা ভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন তা হলে তাতে তার দেশ সমর্থন দেবে না। বিকেল তিনটা নাগাদ রমনা রেসকোর্স কানায় কানায় পূর্ণ। কত মানুষ সেদিন হাজির ছিলেন তা শুধু অনুমান করা যেতে পারে। কেউ বলেন বিশ লাখ, কেউ ত্রিশ লাখ আবার কোন কোন বিদেশি সাংবাদিক অনুমান করে লিখেছেন পঞ্চাশ লাখ। কবি নির্মলেন্দু গুনের ভাষায় ‘ একটি কবিতা লেখা হবে আজ, তার জন্য অপেক্ষায় উত্তেজনা নিয়ে লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে। ভোর থেকে জনসমূদ্রের উদ্যান সৈকতে : কখন আসবেন কবি ?’
রমনা রেস কোর্সের উদ্দেশ্যে যাত্রার প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু বাড়ির দোতলায়। বেগম মুজিব গায়ে হাত দিয়ে দেখলেন জ্বরটা একটু কমেছে। পাঞ্জাবির বোতামটা লাগাতে লাগাতে বললেন ‘তুমি আজকের জনসভায় কী বলবে জানিনা। তবে তোমার সামনে থাকবে তোমার জনগণ আর পেছনে বন্দুকের নল’। ঢাকা সেনা নিবাসে পাকিস্তানি সেনা বাহিনী প্রস্তুত। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণার করার সাথেই সাথেই তারা বের হয়ে পরবে। রেসকোর্সের উপর টহল দিচ্ছে বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার। ধানমন্ডির বাড়ি হতে যিনি নিজের গাড়িতে বঙ্গবন্ধুকে রেসকোর্স ময়দানে ঘুর পথে নিয়ে আসেন তিনি বঙ্গবন্ধু কলকাতা দিনের অনুজ প্রতিম বন্ধু হাজী গোলাম মোর্শেদ। বঙ্গবন্ধু সামনের সীটে তার পাশে বসা ছিলেন। পিছনের সিটে গাজী গোলাম মোস্তাফা আর মহিউদ্দিন আহমেদ। কয়েক বছর আগে তিনি আমাকে এই তথ্যটা দিয়েছিলেন। গাড়ি যখন এলিফ্যান্ট রোডে তখন হাজী মোর্শেদ বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করলেন ‘কি বলবেন আজ মুজিব ভাই’ ? ধ্যানমগ্ন বঙ্গবন্ধু মাথা তুলে বললেন ‘জানিনা। আল্লাহ আমাকে দিয়ে যাই বলায় তা বলব।’ গাড়ি যখন রমনা রেসকোর্সে প্রবেশ করলো তখন চারিদিকে একটা শ্লোগান। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন করো। জয় বাংলা।’ আমরা যারা সে দিনের সে জনসভায় উপস্থিত ছিলাম তাদের জন্য সেটি এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত।
সর্বসাকুল্যে ঊনিশ মিনিটের বক্তৃতা। সেই বক্তৃতাই হয়ে গেল ‘রাজনীতির কবির অমর কবিতা’। সেই উত্তাল জনসমুদ্রকে সামনে রেখে জানিয়ে দিলেন তিনি প্রধানমন্ত্রীত্ব চান না। তিনি দেশের মানুষের অধিকার চান। এর আগে ইয়াহিয়া খান ১০ মার্চ ঢাকায় রাজনৈতিক নেতাদের একটি সমঝোতা বৈঠক আহŸান করেছিলেন যা বঙ্গবন্ধু প্রত্যাখান করেন। তারপর ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন ২৫ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সভা বসবে। বঙ্গবন্ধু দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে জানালেন তিনি শহীদের রক্তের উপর পা দিয়ে কোন বৈঠক অথবা সংসদ অধিবেশনে যেতে পারেন না। তিনি জানতেন যে কোন সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে যেতে পারে। তিনি জনগণের উদ্দেশ্যে জানিয়ে দিলেন তিনি যদি হুকুম দিতে নাও পারেন তা হলে তাদের কর্তব্য কি হবে। তিনি দলের ভিতরে ঘাপটি মেরে থাকা পাকিস্তানি চরদের সম্পর্কে সতর্ক করে দেন। দেশের বেসামরিক প্রশাসন কি ভাবে চলবে সেই সম্পর্কে তিনি পরিষ্কার নির্দেশ দেন। সে দিন হতে আসলে বঙ্গবন্ধু হয়ে গেলেন বাংলাদেশের বেসামরিক সরকার প্রধান। দাবি জানানো হয় যেন সকল সেনা বাহিনীকে তাদের ব্যারাকে ফেরত নিয়ে যাওয়া হয়। বক্তৃতা শেষ করলেন এই বলে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদেও মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম‘ বলে। কবি নির্মলেন্দু গুনের মতে ‘সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের‘। এই চেয়ে পরিষ্কার ভাষায় স্বাধীনতা ঘোষনা আর কি হতে পারে? বঙ্গবন্ধু আজীবন নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করেছেন। তিনি কোন বিপ্লবি ছিলেন। একজন নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি যদি সেদিন অন্য ভাবে স্বাধনতার ঘোষণা দিতেন তা হলে তা হতো বিচ্ছিন্নতাবাদি আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ নয়।
১৯৭৫ সালের পনেরই আগস্ট অবৈধ ভাবে ক্ষমতা দখলকারি জিয়ার অনেক অনুসারি বলে থাকেন ‘শেখ মুুজিব যদি সেদিন সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিতেন তা হলে দেশের সেনা নিবাসগুলোতে বাঙালি সৈন্যরা যুদ্ধ শুরু করে দিত’। বাস্তবতা হচ্ছে শুধু ঢাকা সেনানিবাস নয় বাংলাদেশের কোন সেনা নিবাসেই পর্যাপ্ত বাঙালি সৈন্য ছিল না। আর বঙ্গবন্ধুর ভাষণতো সেদিন রেডিও টিভিতে প্রচারিত হয় নি। হয়েছিল পরদিন। বিএনপি জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে থাকে। সেই জিয়াতো পঁচিশ মার্চ রাতে বাঙালিদের হত্যা করার জন্য আনিত অস্ত্রশস্ত্র খালাস করার জন্য চট্টগ্রাম বন্দরে যাচ্ছিলেন। পরবর্তিকালে জিয়ার একান্ত ঘনিষ্ঠ কর্নেল (অবঃ) অলি বীর বিক্রম চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এলাকা হতে ফিরিয়ে আনেন এই বলে ‘ঢাকায় স্বাধীনতা ঘোষিত হয়েছে‘। এটি কর্নেল অলির বইয়ে (বর্তমানে নিষিদ্ধ) বলা আেেছ। কর্নেল সাহেব একবার লন্ডনের এক বাংলা টেলিভিশনে বলেছিলেন শেখ মুজিব যদি রমনা রেসকোর্স হতে হেঁটে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গিয়ে বিদেশী সাংবাদিকদের স্বাধীনতার কথা বলতেন তা হলে নাকি বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যেত। যেন স্বাধীনতা হাতের মোয়া। বাস্তবে কোন সেনা নিবাসে বাঙালি সৈনিকরা যুদ্ধ শুরু করেন নি। তারা সকলে সেনা নিবাসের বাইরে করেছেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর মাসে বিএনপি ও তাদের সমমনা পÐিতজনদের কাছ হতে এমন অনেক রূপকথার গল্প শোনা যাবে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর বিএনপি অনেক চেষ্টা করেছে তাদের প্রতিষ্ঠাতা নেতাকে টেনে বঙ্গবন্ধুর সমান করতে। বাস্তবতা হচ্ছে যতই টানাটানি করুক বঙ্গবন্ধুর হাঁটুর উপর কাউকে টেনে তোলা সম্ভব হয় নি। আজকের এই দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নামক মহামানবের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা আর অভিবাদন। সাতই মার্চের চেতনা অমর হোক। বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক। জয় বাংলা।

লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক