সাগরে শক্তি সঞ্চয় করছে ‘অশনি’

18

নিজস্ব প্রতিবেদক

বৈশাখের শেষ সপ্তাহে এসে আন্দামান সাগর হয়ে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড় ‘অশনি’ ক্রমাগত শক্তি সঞ্চয় করছে। আজ থেকে ১১ মে নাগাদ এটি প্রতিবেশি দেশ ভারতের উড়িষ্যা উপকূল দিয়ে স্থলভাগে উঠে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে দেশের সাতক্ষীরা ও আশপাশের এলাকা অতিক্রম করতে পারে বলে ধারণা করছেন আবহাওয়াবিদরা। ঘুর্ণিঝড় অশনি শেষ পর্যন্ত আঘাত হানলে তাতে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতীয় উপক‚ল ও স্থলভাগে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা বেশি। তবে বাংলাদেশ একেবারে শঙ্কামুক্ত নয়।
দেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের আবহাওয়াবিদ মো. তরিফুল নেওয়াজ কবির পূর্বদেশকে গতকাল রবিবার সন্ধ্যা ছ’টায় জানান, দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন দক্ষিণ আন্দামান সাগর এলাকায় অবস্থানরত নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড় অশনি- এ পরিণত হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। এটি আরও শক্তিশালী ও ঘনীভূত হয়ে উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে পারে। আজ সোমবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী চব্বিশ ঘন্টার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের অনেক জায়গায়; ময়মনসিংহ, ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং রংপুর, রাজশাহী ও ঢাকা বিভাগের দুয়েক জায়গায় অস্থায়ীভাবে ঝড়ো হাওয়ার সাথে প্রবল বিজলী চমকানোসহ বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া মাদারীপুর, রাঙামাটি, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী, খুলনা ও যশোর জেলাসহ সিলেট বিভাগের উপর দিয়ে যে মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে তা কিছু কিছু এলাকায় প্রশমিত হতে পারে। রবিবার রাজধানী ঢাকায় দেশের সর্বোচ্চ ২৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। আর যশোরে দেশের সর্বোচ্চ ৩৬ দশমিক আট ডিগি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। দেশের সমুদ্র বন্দর ও কক্সবাজার উপক‚লকে দুই নম্বর হুঁশিয়ারি সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
আবহাওয়া ও ঘূর্ণিঝড়ের গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণকারী বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় অশনির প্রভাবে পুরো বঙ্গোপসাগর জুড়ে গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা তেরি হচ্ছে। এই মেঘমালার কিছু অংশ ইতিমধ্যেই উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। যার ফলে গতকাল রবিবার রাতেই দেশের উপকূলের আকাশে মেঘের আনাগোনা বাড়তে শুরু করেছে। সেই সাথে আজ সোমবার দিনে বা রাতের যে কোনও সময় দেশের উপকূলীয় জেলাসমূহ বিশেষ করে সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, লক্ষীপুর, নোয়াখালী, টেকনাফ, কক্সবাজার, কুতুবদীয়াসহ খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের বেশকিছু স্থানে দমকা বাতাসসহ আকস্মিকভাবে বৃষ্টি অথবা বজ্রবৃষ্টি হতে পারে। বৃষ্টিপাতের এই ধারা পরদিন থেকে দক্ষিণাঞ্চলের পাশাপাশি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের উত্তরাঞ্চলের দিকে বিস্তার লাভ করতে পারে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে আগামী কয়েকদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে বজ্রপাত, প্রবল বর্ষণ, ঝড়ো বাতাসসহ উপকূলে জোয়ারের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেতে পারে।
আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক পিএইচডি গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশের মতে, ঘূর্ণাবর্তটি অবস্থান করছে দক্ষিণ বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগরের সন্নিহিত এলাকায়। এটির গতিপ্রকৃতি নিয়ে আমেরিকা ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেলগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে, গত শনিবার ঘূর্ণিঝড়টি সৃষ্টির প্রাথমিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। গতকাল রবিবার সেটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়টির স্থলভাগে আঘাত করার সময় তিন দিন পেছানোর পাশাপাশি সেটির গতিমুখও পরিবর্তন হয়েছে। আগামী ১৪ মে সকাল থেকে ভারত ও বাংলাদেশের সুন্দরবনের ওপর দিয়ে (ইউরোপিয়ান মডেল অনুসারে) ও আমেরিকান মডেল অনুসারে আগামী ১৩ মে দুপুরের পর থেকে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী উপকূল দিয়ে স্থলভাগে আঘাতের আশঙ্কার কথা নির্দেশ করছে। ঘূর্ণিঝড়টি স্থলভাগে আঘাত করার সময় বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ উঠতে পারে ঘণ্টায় একশ’ থেকে একশ’ ৩০ কিলোমিটার। ইউরোপিয়ান মডেলের পূর্বাভাস সঠিক প্রমাণিত হলে ঘূর্ণিঝড়টি সাতক্ষীরা, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের জেলাগুলো লÐভÐ করে দিতে পারে। পক্ষান্তরে আমেরিকান মডেলের পূর্বাভাস সঠিক প্রমাণিত হলে চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাগুলোতে প্রভাব বেশি পড়বে।
ফ্ল্যাশব্যাকে চোখ রাখলে ট্র্যাক রেকর্ডটা এই রকম- ২০০৯ সালের ২৫ মে ধেয়ে এসেছিল প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’। যার বীভৎস ধ্বংসযজ্ঞে চিরচেনা রূপ হারিয়েছিল সুন্দরবন। এরপর ১১ বছরের ব্যবধানে ২০২০ সালে এই অঞ্চলে পুনরায় আছড়ে পড়েছিল ‘আম্ফান’। সেটাও ছিল ২০ মে। পরের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের ২৬ মে হাজির হয়েছিল ‘ইয়াস’। এবার আসছে ‘অশনি’। নামটি শ্রীলঙ্কার দেয়া। ‘অশনি’ মানে ক্ষুব্ধ। গতকাল সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদন লেখার সময় ঘূর্ণিঝড়টি দেশের বিভিন্ন সমুদ্রবন্দর থেকে হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দূরত্বে অবস্থান করছিল। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর উত্তাল রয়েছে। এ কারণে চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর এবং কক্সবাজার উপক‚লকে এক নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সঙ্কেত পাল্টে দুই নম্বর নৌ হুঁশিয়ারী সঙ্কেত দেখাতে বলা হয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগের অবস্থানরত সকল মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে উপক‚লের কাছাকাছি এসে সাবধানে চলাচল করতে বলা হেয়েছ। সেইসাথে তাদেরকে গভীর সাগরে বিচরণ না করতে বলা হয়েছে।