সাগরে মাছ ধরা বন্ধ থাকবে ৬৫ দিন

77

‘রূপকথার গল্পে কৃষক সব স্বর্ণের ডিম এক সঙ্গে পেতে হাঁস জবাই করেছিলেন। কিন্তু একটি ডিমও পাননি। বরং হারাতে হয়েছে স্বর্ণের ডিম পাড়া হাঁসকে। বঙ্গোপসাগর আমাদের জন্য রূপকথার সেই স্বর্ণের ডিম পাড়া হাঁস। বিরতি না দিয়ে সারা বছর যদি আমরা এখানে মাছ আহরণ করি, তাহলে মাছ আর থাকবে না। সব মাছ শেষ হয়ে যাবে।’
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে ২০ মে থেকে ৬৫ দিন বঙ্গোপসাগরে সামুদ্রিক মাছ আহরণে সরকারি নিষেধাজ্ঞা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু।
আশরাফ আলী খান খসরু বলেন, আমি হাওর অঞ্চলের মানুষ। ৫০-৬০ বছর আগেও আমাদের গ্রামে গরুর গাড়ি নিয়ে মাছ আনতে হতো। কিন্তু অতিরিক্ত আহরণের কারণে হাওরে এখন মাছ শেষ হয়ে যাচ্ছে। আগের ১০০ ভাগের বিপরীতে এখন ১০ ভাগ পাওয়া যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে কিছু দিনের মধ্যেই উপকূলীয় এলাকার মানুষ বেকার হয়ে যাবে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মৎস্য অধিদফতরের অনুসন্ধানী জাহাজ নিয়ে আমরা বঙ্গোপসাগরে অনুসন্ধান চালিয়েছি। সেখানে দেখা গেছে, মাছের সংখ্যা বঙ্গোপসাগরে এখন অনেক কমে এসেছে। এ অবস্থায় নিয়ম না মেনে অতিরিক্ত মাছ আহরণ চলতে থাকলে বেশি দিন লাগবে না- কয়েক বছরের মধ্যেই বঙ্গোপসাগর মাছ শূন্য হয়ে যাবে। তখন ৬৫ দিন মাছ আহরণ বন্ধ রাখলে যে কষ্ট পাবেন, তা ৬৫ বছরেও লাঘব হবে না।
প্রজনন সময়ে মা মাছ যদি ডিম ছাড়তে না পারে, মা মাছ আহরণ করা হয়- তাহলে মাছ বৃদ্ধি পাবে না। আমাদের অসাবধানতার কারণে ইতোমধ্যে অনেক প্রজাতির মাছ ধ্বংস হয়ে গেছে। অনেক গুলো যাওয়ার পথে। প্লিজ, বঙ্গোপসাগরকে মাছ শূন্য করবেন না। একটু কষ্ট হলেও সরকারি সিদ্ধান্তু বাস্তবায়নে সহায়তা করুন।’ যোগ করেন প্রতিমন্ত্রী। খবর বাংলানিউজের
আশরাফ আলী খান খসরু বলেন, মাছ ধরা বন্ধ থাকলে জেলেদের যাতে কষ্ট না হয়, এজন্য আমরা বৃহৎ কর্মসূচি নিয়েছি। আগামী বছর থেকে জেলেদের শুধু মাছ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করতে হবে না। জেলেদের আমরা ছাগল, ভেড়াসহ বিভিন্ন উপকরণ দেবো। জালের উপর, মাছের উপর যাতে তাদের নির্ভরতা কমে আসে। তারা যাতে মাছ ধরার পাশাপাশি অন্যভাবেও সংসার চলাতে পারে।সভায় সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, সিটি মেয়র হিসেবে আমি একদিকে জনপ্রতিনিধি আবার অন্য দিকে সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান। তাই আমাকে সরকারের সঙ্গে জনগণের সেতুবন্ধনকারী হিসেবে ভূমিকা রাখতে হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে সরকারি আদেশ বাস্তবায়নে যেমন আমি ভূমিকা রাখবো, তেমনি কোনো আদেশের কারণে জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কী না- সেটাও আমাকে দেখতে হবে।
তিনি বলেন, মাছের প্রজনন সময়ে বঙ্গোপসাগরে মাছ আহরণ বন্ধ রাখা প্রয়োজন। তবে ৬৫ দিন দীর্ঘ সময়। এতো সময় মাছ না ধরলে জেলেরা কীভাবে চলবে সেটা আমাদের ভাবতে হবে। জেলেদের জন্য বিকল্প কী কী ব্যবস্থা করা যায় তা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের বসতে হবে। কারণ বেকার হয়ে সংসার চালাতে না পারলে তারা অপরাধে জড়াতে পারে। যার প্রভাব পড়বে সবখানে।
সভায় ফিশিং ট্রলার মালিক সমিতি, জলদাস সমবায় সমিতিসহ মাছ ধরার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক সমিতির নেতারা ২০ মে থেকে ৬৫ দিন বঙ্গোপসাগরে সামুদ্রিক মাছ আহরণে সরকারি নিষেধাজ্ঞা পুনরায় বিবেচনার আহŸান জানান। এ বছর বাদ দিয়ে আগামী বছর থেকে এ নিষেধাজ্ঞা জারির দাবি জানান।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব রইছউল আলম মÐলের সভাপতিত্বে সভায় জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন, চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মাহবুবুল আলম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজের অধ্যাপক সাইদুর রহমান, নৌ-বাহিনী, কোস্ট গার্ড, পুলিশ, ফিশিং ট্রলার মালিক সমিতি, জলদাস সমবায় সমিতিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সমিতির প্রধানরা অংশ নেন।
এদিকে বঙ্গোপসাগরে সামুদ্রিক মাছ আহরণে সরকারি নিষেধাজ্ঞা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে এসে জেলেদের বিক্ষোভের মুখে পড়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু।
গতকাল দুপুরে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে ২০ মে থেকে ৬৫ দিন বঙ্গোপসাগরে সামুদ্রিক মাছ আহরণে সরকারি নিষেধাজ্ঞা নিয়ে মতবিনিময় শেষে বের হওয়ার পথে জেলেদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন তিনি।
এ সময় জেলেরা ‘মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা, মানি না মানবো না’ ¯েøাগান দিয়ে প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরুর গাড়ি আটকে তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও পুলিশের সহায়তায় সার্কিট হাউজ থেকে বের হয়ে যান তিনি।
তবে প্রতিমন্ত্রীর পেছনের গাড়িতে থাকা সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন গাড়ি থামিয়ে জেলেদের সঙ্গে কথা বলেন। মাছ আহরণে সরকারি নিষেধাজ্ঞা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে বিকল্প ব্যবস্থা, সহায়তার আশ্বাস দেন তিনি।
এদিকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে আসছেন- এমন সংবাদে গতকাল সকাল থেকেই ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে সার্কিট হাউজ প্রাঙ্গণে আসতে শুরু করেন চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকার জেলেরা। দুপুর সাড়ে ১১টা থেকে সার্কিট হাউজের সম্মেলন কক্ষে মতবিনিময় সভা শুরু হলেও বাইরে মানববন্ধন, বিক্ষোভ করেন জেলেরা।
উত্তর চট্টলা উপকূলীয় মৎস্যজীবী জলদাস সমবায় কল্যাণ ফেডারেশনের সভাপতি লিটন দাস বলেন, ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই ৬৫ দিন সমুদ্রে সব ধরনের মাছ আহরণে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার। কিন্তু জেলে পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চট্টগ্রামের প্রায় ৫০ হাজার পরিবারের জন্য বিকল্প কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি।
তিনি বলেন, আমরা মাছ ধরে দৈনিক যা আয় করি, তা দিয়েই সংসার চালাই। প্রায় আড়াই মাস যদি মাছ ধরা বন্ধ রাখতে হয়, তাহলে এতোগুলো পরিবার চলবে কীভাবে? আমরা সরকারের কাছে অনুরোধ জানাই, মাছ আহরণে সরকারি নিষেধাজ্ঞা পুনরায় বিবেচনা করুন। জেলেদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা নিন। অর্থাভাবে কোনো জেলে খারাপ কাজে জড়িয়ে গেলে এর দায়ভার কে নেবে?