সর্বোত্তম আমল আল্লাহ ও প্রিয় নবী (সা.) প্রতি মহব্বত

154

 

যাবতীয় প্রশংসা কেবলই আল্লাহ তা‘আলার যিনি সমগ্র জগতের মালিক ও রব। আর সালাত ও সালাম নাযিল হোক আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর, যিনি সমস্ত নবীগণের সরদার ও সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী। আরও নাযিল হোক তার পরিবার-পরিজন ও সমগ্র সাথী-সঙ্গীদের ওপর।
মহব্বত, প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসা খোদার সৃষ্ট প্রকৃতিরই অংশ। মানবীয় গুণাবলি বিকাশে ও মনুষ্য চরিত্রের উৎকর্ষ সাধন বা সুকুমার বৃত্তি অর্জনের মূলে রয়েছে বিশ্বাস,আশা ও ভালোবাসা। সৃষ্টিকুল কায়েনাত ভালোবাসারই ফল। হাদিসে কুদসিতে রয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি ছিলাম গোপন ভাÐার; ভালো বাসলাম প্রকাশ হতে, তাই সৃজন করলাম সমুদয় সৃষ্টি।’ আল্লাহর কুদরতের জগতে ভালোবাসাই হলো প্রথম সম্পাদিত ক্রিয়া বা কর্ম।
সৃষ্টির আদিতে বা সূচনায় গ্রষ্টার ভালোবাসা, সৃষ্টির অন্তে বা পরিণতিতে সৃষ্টির ভালোবাসা; ইমানের শর্ত নবীজি (সা.)এর ভালোবাসা, নবীজি (সা.) এর ভালোবাসার প্রমাণ সুন্নতের প্রতি ভালোবাসা; জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আল্লাহ ও নবী (সা.)–এর ভালোবাসা। হাদিস শরিফে প্রিয় নবীজি (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য মহব্বত করে ও আল্লাহর জন্য ঘৃণা করে এবং আল্লাহর জন্য দান করে ও আল্লাহর জন্য বিরত থাকে; অবশ্যই তার ইমান পূর্ণ হলো।’ (আবুদাউদ: ৪০৬৪)।
মহব্বতের ধারাবাহিকতা হলো আল্লাহর প্রতি মহব্বত, রাসুলের প্রতি মহব্বত, আল্লাহ ও রাসুলের প্রিয়জনদের প্রতি মহব্বত, পিতা-মাতার প্রতি মহব্বত, স্বামী-স্ত্রীর প্রতি মহব্বত, সন্তানের প্রতি মহব্বত, ভাইবোনের প্রতি মহব্বত, আত্মীয়স্বজনের প্রতি মহব্বত, পাড়া-প্রতিবেশীর প্রতি মহব্বত, স্বদেশ ও স্বজাতির প্রতি মহব্বত, বিশ্ববাসীর প্রতি মহব্বত, সমগ্র সৃষ্টিজগতের প্রতি মহব্বত।
আল্লাহকে ভালোবাসার জন্য রাসুল (সা.)-এর পথ অনুসরণ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে কোরআনে আছে, ‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তবে আমার (নবীর) অনুসরণ করো; তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ মার্জনা করবেন।’ (আলে ইমরান:৩১)।
আল্লাহ কাদের ভালোবাসেন আর ভালোবাসেন না, তা পবিত্র কোরআনে বিধৃত হয়েছে। ‘আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন। (সুরা বাকারা: ১৯৫)। ‘আল্লাহ পবিত্রদের ভালোবাসেন।’ (সুরা তাওবা: ১০৮)। ‘আল্লাহ তওবাকারীদের ভালোবাসেন।’ (সুরা বাকারা: ২২২)। ‘আল্লাহ মুত্তাকিদের ভালোবাসেন।’ (সুরা আলে ইমরান: ৭৬)। ‘আল্লাহ ধৈর্যশীলদের ভালোবাসেন।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৪৬)। ‘আল্লাহ (তাঁর ওপর) নির্ভরকারীদের ভালোবাসেন।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৫৯)। ‘আল্লাহ ন্যায়নিষ্ঠদের ভালোবাসেন।’ (সুরা মায়িদা: ৪২)।
‘আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীদের ভালোবাসেন না।’ (সুরা বাকারা: ১৯০)। ‘আল্লাহ অকৃতজ্ঞদের ভালোবাসেন না।’ (সুরা আলে ইমরান: ৩২)। ‘আল্লাহ জালিমদের ভালোবাসেন না।’ (সুরা আলে ইমরান: ৫৭)। ‘আল্লাহ অহংকারীদের ভালোবাসেন না।’ (সুরা নাহল: ২৩)। ‘আল্লাহ অপব্যয়কারীদের ভালোবাসেন না।’ (সুরা আনআম: ১৪১)। ‘আল্লাহ আমানতের খেয়ানতকারীদের ভালোবাসেন না।’ (সুরা আনফাল: ৫৮)। ‘আল্লাহ ফ্যাসাদকারীদের ভালোবাসেন না।’ (সুরা মায়িদা: ৬৪)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেহ ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ মোমিন হবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার সন্তান অপেক্ষা, তার পিতা অপেক্ষা এবং সকল মানুষ অপেক্ষা বেশি প্রিয় (ভালোবাসার বস্তু) না হই।’ (বুখারি)। তিনি আরও বলেন, ‘যে যাকে ভালোবাসে, সে (পরকালে) তার সাথে থাকবে।’ (মুসলিম)। হাদিসে আরও রয়েছে, ‘যে আমার সুন্নতকে ভালোবাসে, সে অবশ্যই আমাকে ভালোবাসে; আর যে আমাকে ভালোবাসে সে জান্নাতে আমার সঙ্গেই থাকবে।’ (নাসায়ি)। নবীজি (সা.) বলেন, ‘সর্বোত্তম আমল হলো আল্লাহর জন্য ভালোবাসা।’ (আবুদাউদ)। ইসমে আজম বা মহানাম, শক্তির আধার শক্তিময়ের গুণ। এর মাঝে লুকায়িত আছে মহাশক্তি। অসাধ্য সাধন করা যায় ইসমে আজম আমল দ্বারা। কী এই ইসমে আজম? কোথায় আছে ইসমে আজম? এই বিষয়ে হাদিসে ও কিতাবে বিভিন্ন বর্ণনা রয়েছে। সাকল্যে ১০টি মত পাওয়া গেলেও এর সুরাহা হয়নি। ইসমে আজম সম্পর্কে হজরত সুফি খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ (র.) আমার জীবনধারা গ্রন্থে লিখেছেন, ‘মহব্বতের সহিত যেই নামই ডাকিবে, তাহাই ইসমে আজম।’ (কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত নবী-রাসুল (আ.) গণের দোয়া ও মোনাজাত, পৃষ্ঠা: ২৫৫-২৫৯)।
আল্লাহর রহমত বান্দার জন্য সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ। তার অনুগ্রহ লাভে বান্দার একমাত্র কাজ। যেসব কাজে আল্লাহর রহমত লাভ হবে, আল্লাহর প্রতি বান্দার ভালোবাসা বেড়ে যাবে, সেসব আমল করাই মুমিন বান্দার জন্য আবশ্যকীয় কাজ।
কেননা আল্লাহ তাআলা বান্দার জন্য অসংখ্য নেয়ামতে দুনিয়া ভরপুর করে দিয়েছেন। আল্লাহর ভালোবাসা হৃদয়ে বাড়াতে পারলে পরকালের চিরস্থায়ী জীবনও থাকবে তার নেয়ামতে ভরপুর। সুতরাং বান্দার উচিত আল্লাহর ভালোবাসা পেতে এ আমলগুলো বেশি বেশি করা। আর তাহলো-
** বুঝে বুঝে কুরআন অধ্যয়ন করা
কুরআনুল কারিম তেলাওয়াতের পাশাপাশি কুরআনের ভাব ও ভাষা বুঝে বুঝে কুরআন অধ্যয়ন করা। সে আলোকে জীবন সাজানো। কুরআনের হুকুমগুলো যথাযথ আদায় করা। কুরআনের প্রতি প্রেম ও ভালোবাসা বাড়ানো। কুরআনের ভালোবাসাই বান্দাকে আল্লাহর সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করাতে পারে।
** জিকিরে মাশগুল থাকা
ব্যস্ততা কিংবা অবসর, সব সময় আল্লাহর জিকিরে নিজেদের জবানকে সিক্ত রাখা। আল্লাহর জিকিরে বান্দার সঙ্গে আল্লাহর ভালোবাসা বেড়ে যায়।
** বেশি বেশি সুন্নাতের আমল করা
ফরজ ও ওয়াজিব বিধান পালনের পর বেশি বেশি সুন্নাতের আমল ও নফল ইবাদত করা। সুন্নাত ও নফল ইবাদত দ্বারাই বান্দার ইবাদতের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যাবে। আর তাতে আল্লাহর সঙ্গে বান্দার মহব্বত সৃষ্টি হবে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদিসে কুদসিতে বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমার বান্দার ফরজ ও ওয়াজিব ইবাদতের মাধ্যমে আমার নিকটবর্তী হতে থাকে। এরপর সে সুন্নত ও নফল ইবাদতের মাধ্যমে আমার নিকটতম হয়। যখন সে আমার নিকটতম হয়, আমি তাকে ভালোবাসি। আমি তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখে, তার পা হয়ে যাই, যা দিয়ে সে হাঁটে, তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শোনে।’ (সুবহানাল্লাহ!)
** সৎ মানুষের সোহবত
যারা আল্লাহর বিধানগুলো যথাযথ মেনে চলে, এমন ব্যক্তির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা। প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ হাদিসের ওপর যথাযথ আমল করা। আর তাহলো- ‘কাউকে ভালোবাসতে হবে আল্লাহ ও তার রাসুলের জন্য আবার কাউকে ঘৃণা করলেও তা করতে হবে আল্লাহ ও তার রাসুলের জন্য।’
** আল্লাহর গুণবাচক নামের জিকির করা
আল্লাহ তাআলার ৯৯টি নাম রয়েছে। যারা এ নামগুলো পড়বে, আমল করবে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাতের ঘোষণা। সুতরাং মানুষের উচিত আল্লাহর গুণবাচক নামের আমল নিজেদের মধ্যে বেশি বেশি জারি করা। আর এতে আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সুসম্পর্ক তৈরি হয়। বান্দার অন্তরে আল্লাহর ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়।
হাদিসে ইরশাদ হয়েছে,‘সর্বোত্তম আমল হলো আল্লাহর জন্য ভালোবাসা।’তাই তো রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রায়ই দোয়া করতেন,‘হে আল্লাহ! আপনার ভালোবাসা চাই, আপনার ভালোবাসার জন্যে ভালোবাসা চাই; আর ওইসব আমল করার তৌফিক চাই, যে আমল করলে আপনার ভালোবাসা লাভ করা যায়।’ মুয়াত্তা ইমাম মালিক
সুতরাং আল্লাহকে ভয় করার চেয়েও ভালোবাসা জরুরি। কোনো ব্যক্তি আল্লাহকে ভালোবাসলে তিনি তার গোনাহসমূহ মাফ করে দেবেন। যার গোনাহ মাফ হয়ে যাবে তার জন্য জান্নাত অবধারিত।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে তার ভালোবাসা লাভে কুরআন সুন্নাহর বিধানগুলো যথাযথ আদায়ের পাশাপাশি উল্লেখিত আমলগুলো সুন্নত তরিকায় যথাযথ পালন, দুনিয়া ও পরকালে আল্লাহর ভালোবাসা ও প্রিয় নবীজি (সা.) মহব্বত লাভ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : হেড অব ফাইন্যান্স এন্ড একাউন্টস, এপিক হেলথ কেয়ার লিমিটেড