সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে হলেও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করতে হবে

29

সমুদ্রকে অপার সম্পদের উৎস আখ্যা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ মীমাংসার ফলে সমুদ্রের গুরুত্ব বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রচুর মৎস্য ও খনিজ সম্পদে ভরপুর আমাদের জলসীমার অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে আপনাদের (নৌবাহিনী) সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে হলেও এর সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করতে হবে’।
গতকাল রবিবার পতেঙ্গায় বাংলাদেশ নেভাল একাডেমিতে নৌবাহিনীর শীতকালীন রাষ্ট্রপতি কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধকালে নৌ-কমান্ডো গঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সূত্রপাত হয়। আমাদের মুক্তিবাহিনীর দুর্র্ধর্ষ নৌ-কমান্ডোগণ চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দরসহ চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর এলাকায় হামলা চালিয়ে পাকিস্তানি শত্রুবাহিনীর বেশ কয়েকটি যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস করে দিয়েছিলো, যা ইতিহাসে অপারেশন জ্যাকপট নামে পরিচিত। স্বাধীনতার পর প্রায় শূন্য থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টায় ২টি পেট্রোল ক্রাফট নিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। এরপর ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু নৌবাহিনীর সব প্রধান ঘাঁটিকে একযোগে কমিশন প্রদান করেন। শুধু তাই নয়, জাতির পিতা মাত্র সাড়ে তিন বছরেই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের প্রধান প্রধান সমুদ্র ও নদীবন্দরগুলো মেরামত করে ব্যবহার উপযোগী করতে পেরেছিলেন। তিনি দ্যা টেরিটোরিয়াল ওয়াটার অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট ১৯৭৪ প্রণয়ন করেছিলেন, যার ফলে আমাদের বিশাল সমুদ্রসীমা অর্জন সম্ভব হয়েছে’।
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে নৌবাহিনীকে একটি যুগোপযোগী ও অত্যাধুনিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। সে সময় আমরা বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন, যুদ্ধজাহাজ সংগ্রহ এবং বিদ্যমান জাহাজগুলোর অপারেশনাল সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করি। ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর আমরা জাতির পিতার প্রণীত প্রতিরক্ষা নীতির আলোকে ফোর্সেস গোল ২০৩০ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন শুরু করি। সেই থেকে টানা তিনবার সরকার গঠনের ফলে আমাদের সরকারের উদ্যোগে এখন পর্যন্ত নৌবাহিনীতে মোট ২৭টি যুদ্ধজাহাজ সংযোজিত হয়েছে। আমরা নৌবাহিনীর দক্ষ কমান্ডো ও উদ্ধারকারী দল তথা স্পেশাল ওয়ারফেয়ার ডাইভিং অ্যান্ড স্যালভেজ কমান্ড এবং নৌবাহিনীর বৈমানিক দল বা এভিয়েশন উইং সৃষ্টি করেছি’।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর দক্ষ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেড ৫টি পেট্রোল ক্রাফট ও ২টি লার্জ পেট্রোল ক্রাফট নির্মাণের মাধ্যমে দেশে যুদ্ধজাহাজ নির্মাণের ক্ষেত্রে নতুন মাইলফলক স্থাপন করেছে। সেখানে আরও ৫টি পেট্রোল ক্রাফট নির্মাণের কাজ চলছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ নৌবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত চট্টগ্রাম ড্রাইডক লিমিটেডে ৬টি আধুনিক সমরাস্ত্র সজ্জিত বড় আকারের ফ্রিগেট নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। নৌবাহিনী তিন বাহিনীর জন্য আইএফএফ সিস্টেম প্রস্তুত করছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনী পর্যায়ক্রমে সামরিক নৌযানের বাণিজ্যিক নির্মাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে’। খবর বাংলানিউজের
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সামরিক পরিমন্ডল ছাড়াও নারীর ক্ষমতায়ন, বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের আবাসন প্রকল্পসহ সুনীল অর্থনীতির বিকাশ ইত্যাদি বহুমুখী কার্যক্রমে নৌবাহিনীর ভূমিকা দেশের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রয়েছে’।
মিডশিপম্যান ও ডাইরেক্ট এন্ট্রি অফিসারদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দুই ব্যাচের ৭২ জন সম্ভাবনাময় কর্মকর্তা একাডেমির সীমানা পার হয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন। দেশ মাতৃকার নিরাপত্তা রক্ষার্থে আপনারাই হবেন এ নৌবাহিনীর ভবিষ্যৎ দিক নির্দেশক। আপনাদের মনে রাখতে হবে, যে কঠোর প্রশিক্ষণ আপনারা শেষ করলেন, তা আপনাদের উৎকর্ষ অর্জনের সূচনা মাত্র। সততা, সঠিক নেতৃত্ব ও আত্মত্যাগের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে সেনা ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আপনাদের সদা প্রস্তুত থাকতে হবে’।
জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও মাদক নির্মূলে সরকার জিরো টলারেন্স নীতিতে কাজ করছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছি। বাংলাদেশ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে এবং বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে আমরা পৃথিবীর ৫৭তম দেশ হিসেবে স্যাটেলাইট প্রযুক্তির অভিজাত দেশের কাতারে যুক্ত হয়েছি। আওয়ামী লীগ সরকারের সুদূরপ্রসারী উন্নয়ন ভাবনা ও এর সফল বাস্তবায়নের ফলেই এসব অর্জন সম্ভব হয়েছে’।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ এবং ইউনেস্কো আগামি বছর যৌথভাবে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন করবে। আমরা ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তোলার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে দেশ, গণতন্ত্র ও সরকারবিরোধী সব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে হবে’।
মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের এ উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ২০১৭/এ ব্যাচের ৬১ জন মিডশিপম্যান ও ২০১৯/বি ব্যাচের ১১ জন ডাইরেক্ট এন্ট্রি অফিসারসহ মোট ৭২ জন নবীন কর্মকর্তা কমিশন লাভ করেন। এদের মধ্যে ৭ জন নারী ও ২ জন মালদ্বীপের কর্মকর্তা রয়েছেন। সদ্য কমিশনপ্রাপ্তদের মধ্যে মিডশিপম্যান ২০১৭/এ ব্যাচের রাইয়ান রহমান সকল বিষয়ে সর্বোচ্চ মান অর্জন করে সেরা চৌকস মিডশিপম্যান হিসেবে ‘সোর্ড অব অনার’ লাভ করেন। এছাড়া মিডশিপম্যান মো. সাইদিস সাকলাইন মিরান প্রশিক্ষণে ২য় সর্বোচ্চ মান অর্জনকারী হিসেবে ‘নৌ প্রধান স্বর্ণপদক’ এবং ডাইরেক্ট এন্ট্রি অফিসার ২০১৯/বি ব্যাচ হতে এক্টিং সাব লেফটেন্যান্ট মো. কামরুজ্জামান শ্রেষ্ঠ ফলাফল অর্জনকারী হিসেবে ‘বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ রুহুল আমিন স্বর্ণপদক’ লাভ করেন।
রাষ্ট্রপতি কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধান, নৌ সদর দপ্তরের পিএসও, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর আঞ্চলিক অধিনায়ক, প্রবীণ রাজনীতিক ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, হুইপ সামশুল হক চৌধুরী, চসিক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, সংসদ সদস্য এমএ লতিফ, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নৌ কমান্ডোসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, দেশি-বিদেশি কূটনীতিক ও শিক্ষা সমাপনী ব্যাচের কমিশনপ্রাপ্ত ক্যাডেটদের অভিভাবকরা উপস্থিত ছিলেন।