সরকারি বিধিমালার আওতায় আনা জরুরি

19

 

নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার অন্যতম মাধ্যম মাদ্রাসা শিক্ষা। উপমহাদেশে শিক্ষা বিস্তারে মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যাপক অবদান রয়েছে। বাংলায় মুসলমানদের আগমনের সাথে সাথে মসজিদ, খানকাহ ও মক্তবভিত্তিক ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে মাদ্রাসা শিক্ষা গড়ে উঠে। যেহেতু এখানে পবিত্র কুরআন ও হাদিসের মৌলিক শিক্ষার পাশাপাশি ইসলামি আইন ও বিধিবিধান নিয়ে শিক্ষা দেয়া হয়, সেহেতু এ শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে সাধারণ মুসলমানের রয়েছে আবেগ এবং উৎসাহ। পাক-ভারত উপমহাদেশসহ বাংলার ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, মাদ্রাসা শিক্ষায় উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে অনেক খ্যাতিমান আলেম বরেণ্য ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলনসহ স্বাধীনতা আন্দোলনেও আলেম সমাজের বড় একটি অংশের সম্পৃক্ত লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু কালের পরিবর্তনে শিক্ষাক্ষেত্রে নানা সংস্কার ও পরিবর্তন আসলেও বহুধা বিভক্ত মাদ্রাসা শিক্ষার একটি অংশ সনাতনী পদ্ধতিতেই রয়ে যায়। কওমি ধারা এ অংশটি সরকারি শিক্ষা কারিকুলামের বাইরে দীর্ঘদিন ধরে পরিচালিত হয়ে আসছে। এদের রয়েছে নিজ বোর্ড, পদ্ধতি ও কারিকুলাম, যা সরকারি মাদ্রাসা বোর্ডের বা আরবি বিশ্ববিদ্যায়ের স্বীকৃতি নয়। বর্তমান সরকার তাদের দ্বিতীয় মেয়াদে কওমি মাদ্রাসাকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনার বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও দাওরা হাদিস, তাফসির বা ফিকহ্ ছাড়া নিচের কোন স্তরে সরকারি স্বীকৃতি নেই। এ অবস্থায় যে ‘লাউ সেই কদু’। যত্রতত্র নামে বেনামে যেকেউ ঘরভাড়া ও ছোট্ট কোন জায়গায় হিফজখানা, এতিমখানা, নুরানি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের মত করে পরিচালনা করে আসছেন। তাদের দেখাদেখি আলিয়া ধারার অনেকেও এ জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন, যা একটি আধুনিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য মোটেই শোভনীয় নয়। মাদ্রাসা বা হিফজখানাগুলোর ভেতরের খবর নিতে গেলে দেখা যায়, এ প্রতিষ্ঠানগুলো যতটুকুনা দ্বীনি ততটুকু দুনিয়াবি। অনেক সময় এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মূল শ্রোতের বাইরে বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার খবরও আসে। গত রবিবার থেকে বৃহস্পতিবার দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে এ জাতীয় মাদ্রাসাগুলোর যে অনৈতিক ও খুনাখুনির চিত্র প্রকাশিত হয়েছে, তাতে ধর্মপ্রাণ মুসলমান উদ্বিগ্ন না হয়ে পারে না। যেখানে ধর্ম, নৈতিকতা, আত্মশুদ্ধি ও মানবতার শিক্ষা হওয়ার কথা সেখানে যদি এভাবে ছোট ছোট শিক্ষার্থীকে বলাৎকার করা হয়, খুন করা হয়, শিক্ষার নামে বেত্রাঘাত করে খুন করা হয়, শিকলবন্দি করে নিষ্ঠুর নির্যাতন করা হয়! তবে এ শিক্ষার আর প্রয়োজনটা কী? মানুষ তার প্রিয় সন্তানকে মনুষ্যবোধে উন্নীত করার জন্যইতো এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করান! কিন্তু বিপরীতে যা হচ্ছে, তা কারো কাছে গ্রহণীয় নয়। এ ধরনের বর্বরতার মধ্যে মাদ্রাসা শিক্ষার নামে বিচ্ছিন্ন শিক্ষা চলতে পারে না। এ শিক্ষাকে মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। সাধারণ বা আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষার বিধি বা নিয়মেই এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অন্যথায় চলমান সংকট দূর করা মোটেই সম্ভব নয়।
বৃহস্পতিবার দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গত শনিবার থেকে মঙ্গলবার; এটুকু সময়ের মধ্যেই বোয়ালখালী এবং নগরীর পাঁচলাইশে মিলল মাদ্রাসা ছাত্রের লাশ। মঙ্গলবার সকালে মুরাদপুর পিলখানা ডানকান হিলের মাদ্রাসা আলী বিন আবী তালিব (রা.) থেকে ছাত্র আরমানের (১৪) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। আরমান পাঁচলাইশের মির্জাপুল এলাকার আব্বাস উদ্দিন ও আমেনা বেগমের ছেলে। এই ঘটনায় মামলা হয়েছে। তবে গ্রেপ্তার হয়নি কেউ। পুলিশ ও মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, ওই ছাত্র মাদ্রাসার ছাদ থেকে অসতর্ক অবস্থায় পড়ে গেছে কিংবা লাফ দিয়েছে। তবে মা-বাবার অভিযোগ, আরমানকে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ হত্যার বিচার চান তারা। গত শনিবার বোয়ালখালীর চরণদ্বীপ এলাকার আল্লামা শাহ ছুফি অছিয়র রহমান মাদ্রাসা ও হেফজখানা থেকে ইফতেখারের (৭) লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল। ওই ঘটনায় তিন শিক্ষককে গ্রেপ্তারও করা হয়। এই বিষয়ে নগর পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) মোখলেছুর রহমান বলেন, মাদ্রাসায় এভাবে শিক্ষার্থীর লাশ হওয়ার বিষয়টি আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখছি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর মৃত্যু যেভাবেই হোক কর্তৃপক্ষের এক্ষেত্রে দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ নেই। আর স্কুল কলেজে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তরফে যেভাবে মনিটরিং করা হয় মাদ্রাসায় সেভাবে হয় না। তাছাড়া অভিভাবকরা ধর্মীয় ভাবাবেগ নিয়ে মাদ্রাসায় সন্তানদেরকে ভর্তি করান। শিক্ষকরা এটাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্নভাবে শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করেন। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের মানসিক প্রশিক্ষণ দেয়ার বিষয়টিও অনুপস্থিত। তথ্যমতে, দেশে শিশু নির্যাতনের জন্য আলাদা আইন আছে। কিন্তু প্রয়োগিক শৈথিল্যের কারণে এই নির্যাতনের মাত্রা কমছে না বলে মনে করেন । আমরা আশা করি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যে ধরনেরই হোক-তাকে সরকারের নিয়মের বাইরে চলতে দেয়া যায় না। সরকারের উচিৎ দ্রæত পদক্ষেপ নিয়ে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া।