সময় বাড়ছে বারবার, শেষ হচ্ছে না অপেক্ষার

50

মনিরুল ইসলাম মুন্না

ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রার্থীদের ‘প্রাপ্তি স্বীকার রশিদে’ দফায় দফায় সময় বাড়ানো হলেও দেয়া হচ্ছে না স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স। এতে প্রতিনিয়ত মামলা ও জরিমানার শিকার হচ্ছেন ভুক্তভোগী গাড়িচালকরা। তাদের দাবি, দ্রুত সময়ে আমাদের স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান করা হোক।
চালকরা জানান, আমাদের স্লিপে (প্রাপ্তি স্বীকার রশিদ) বারবার সময় বাড়িয়ে না দিয়ে স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়া হোক। বারবার কার্যালয়ে আসতে আমাদের যে ভোগান্তি হচ্ছে তা বিআরটিএ পুষিয়ে দিতে পারবে না।
এদিকে আগামী ছয় মাসের মধ্যে চট্টগ্রামের ৮৫ হাজারসহ সারাদেশের ১২ লাখ স্থগিত স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স বিতরণ করার আশ্বাস দিয়েছেন বিআরটিএ সংশ্লিষ্টরা। চলতি মাস থেকে সেনাবাহিনী পরিচালিত এক প্রতিষ্ঠানকে স্থগিত লাইসেন্স প্রিন্ট করার দায়িত্ব দেয় বিআরটিএ সদর দপ্তর।
বর্তমানে প্রতিদিন হাজারো গ্রাহক বিআরটিএ কার্যালয়ে এসে প্রাপ্তি স্বীকার রশিদের সময় পুনরায় নবায়ন করে নিয়ে যাচ্ছেন।
জানা গেছে, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের পর থেকে বন্ধ হয়ে যায় স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স বিতরণ কার্যক্রম। তবে জরুরি বিদেশগামী, বিদেশে প্রশিক্ষণ, শান্তিরক্ষা মিশনগামীদের পাসপোর্ট ও ভিসা প্রদর্শন করা সাপেক্ষে কিছু কার্ড প্রিন্ট করে দেয় বিআরটিএ’র ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ টাইগার আইটি লিমিটেড’। তবে ২০২১ সালের ১৬ জুনের পর থেকে জরুরি কার্ড প্রিন্ট ও বিতরণ বন্ধ করে দেয় সংস্থাটি। একইসাথে বন্ধ করে দেয়া হয় টাইগার আইটি লিমিটেডের সার্ভারটিও। সার্ভার বন্ধের ফলে ভোগান্তি আরও বেড়ে গেছে। কারণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স যাচাইকালে পূর্বের বিতরণ করা ড্রাইভিং লাইসেন্সগুলোও আসল নাকি নকল তা যাচাই করা যাচ্ছে না।
সরেজমিনে চট্টগ্রাম বিআরটিএ কার্যালয় পরিদর্শনে দেখা গেছে, প্রতিদিন শত শত গ্রাহক ভিড় জমাচ্ছেন। তারা পরীক্ষায় পাস করেও ড্রাইভিং লাইসেন্স পাচ্ছেন না। এমন সংখ্যা চট্টগ্রাম জেলা ও মেট্রো মিলিয়ে প্রায় ৮৫ হাজার। বিআরটিএ’র পক্ষ থেকে সাময়িক প্রদান করা অস্থায়ী লাইসেন্স যেটাকে ‘প্রাপ্তি স্বীকার রশিদ’ বলে, তাতেও দফায় দফায় সময় বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। একজন চালককে সময় বাড়িয়ে নেয়ার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে বিআরটিএ কার্যালয়ে আসতে হচ্ছে।
লোহাগাড়া উপজেলার থেকে আসা নেজাম নামের একজন বলেন, লাইসেন্সের জন্য দু’বছর আগে আবেদন করেও পাওয়া যায়নি। আমার মতো হাজার হাজার মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। তাদের প্রয়োজন ছিল দেশে ও বিদেশে চাকরির। অনেকেরই আবার মধ্যপ্রাচ্যে নিশ্চিত হওয়া চাকরি হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে লাইসেন্সের স্মার্টকার্ড না পাওয়ায়।
বাইকচালক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, লাইসেন্সের জন্য ২০১৯ সালে আবেদন করার পর আমাদেরকে একটি স্লিপ (প্রাপ্তি স্বীকার রশিদ) দিয়েছে বিআরটিএ। সেখানে একটি নির্দিষ্ট তারিখ ছিল। ওইদিন কার্ড প্রদান করা হবে জানিয়ে দেয়া হয়। তার আগ পর্যন্ত স্লিপটি নিয়ে আমরা গাড়ি চালাতে পারবো, এমনই বলা আছে। কার্ড বিতরণের তারিখে আসলে পুনরায় আরও একটি তারিখ প্রদান করেন কর্মকর্তারা। এখন দেখছি সে স্লিপটিই হয়রানির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ স্লিপ দেখানোর পরও মামলা দিচ্ছেন ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্টরা। এমনকি স্লিপ দেখানোর পর পাঁচশো টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিচ্ছেন তারা।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের দায়িত্বরত সার্জেন্ট সুব্রত ধর বলেন, কিছু প্রাপ্তি স্বীকার রশিদ আমরা আসল পেলেও বেশিরভাগই আন্দরকিল্লা থেকে প্রিন্ট করানো। এটা এত নিখুঁত হয় যে, আমার মত অনেক সার্জেন্টের চোখে তা ধরা পড়ে না। আর অনেকে আসল ড্রাইভিং লাইসেন্স স্মার্ট কার্ডের মত নকল স্মার্ট কার্ডও তৈরি করছে। সার্ভার বন্ধ থাকার ফলে তা চেক করাও যায় না। কাজেই আমাদের সন্দেহ হলে আমরা মামলা দিই।
বিআরটিএ লাইসেন্স শাখা সূত্রে জানা গেছে, পূর্বের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘টাইগার আইটি লিমিটেড’র অধীনে প্রায় ৮৫ হাজার লাইসেন্স প্রার্থীর বায়োমেট্রিক কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে ইতোমধ্যে। কিন্তু সেসব লাইসেন্সপ্রার্থীদের স্মার্টকার্ড এখনও প্রিন্ট হয়নি। কারণ বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ বা বাংলাদেশ টাইগার আইটি লিমিটেড ওইসব প্রার্থীদের তথ্য এখনও নতুন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্সকে হস্তান্তর করেনি। পরবর্তী নির্দেশনামতে এসব তথ্য বিএমটিএফকে প্রদান করা হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
বিআরটিএ চট্টগ্রাম কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার) রায়হানা আক্তার উর্থী পূর্বদেশকে বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পরিচালিত বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ) এর সাথে বিআরটিএ’র একটি চুক্তি হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব ড্রাইভিং লাইসেন্সের স্মার্টকার্ডগুলো প্রিন্ট করা হবে এবং আগামী ৬ মাসের মধ্যে তারা এটা সম্পন্ন করে প্রার্থীদের হাতে তুলে দেবে। চট্টগ্রামসহ সারা দেশে প্রায় ১২ লক্ষ স্মার্টকার্ড প্রদান স্থগিত রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, স্মার্টকার্ডের প্রিন্ট বন্ধ থাকার বিষয়ে আমাদের কিছু করার নেই। প্রাপ্তি স্বীকার রশিদে স্বাক্ষর দিয়ে আমরা নবায়ন করে দিচ্ছি। যাতে রাস্তায় চালকেরা গাড়ি চালাতে পারেন। শুধু স্মার্টকার্ড নিয়ে আমরা খুব চাপে আছি। যেটা মানুষদের বুঝানো যায় না।
গাড়িচালকদের ট্রাফিক পুলিশের হয়রানির বিষয়টি অস্বীকার করে নগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার শ্যামল কুমার নাথ পূর্বদেশকে বলেন, লাইসেন্স নবায়নের নামে অসাধু চক্র সক্রিয় রয়েছে। তারা লাইসেন্স নবায়নের কাগজগুলো জাল জালিয়াতি করে গাড়ি চালাচ্ছে। আমাদের হাতে ধরা পড়লে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
বর্তমানে ‘ডুয়েল ইন্টারফেস পলিকার্বনেট স্মার্টকার্ড’- এ ছাপা ৪০ লাখ ড্রাইভিং লাইসেন্স সরবরাহের কাজ করছে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ‘মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স প্রাইভেট লিমিটেড’। গত বছরের ২৯ জুলাই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ১২০ কোটি টাকার এ প্রকল্পের চুক্তি হয় বিআরটিএ’র। গত ১৮ মে থেকে লাইসেন্সের জন্য যারা বায়োমেট্রিক কার্যক্রম সম্পাদন করছেন তাদেরকে এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে স্মার্টকার্ড প্রদান করা হবে।