সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সফল একক বইমেলা

70

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন আয়োজিত ও চট্টগ্রাম সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদ ও নাগরিক সমাজের উদ্যোগে ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ থেকে এমএ আজিজ স্টেডিয়ামস্থ জিমনেসিয়াম চত্বরে অমর একুশের বইমেলার সফলতা এটাই প্রমাণ করে যে, সম্মিলিত সকল উদ্যোগ কখনই ব্যর্থ হয় না। ইতিপূর্বে চট্টগ্রামে বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বিক্ষিপ্তভাবে একাশিদ বই মেলা আয়োজিত হত। যার ফলে চট্টগ্রামে কোন বই মেলাই কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। বলা যায়, ঐ সকল মেলা পাঠক, প্রকাশক ও বই প্রেমিকদের মনে দাগ কাটতে পারেনি। এবারের সম্মিলিত একক বইমেলা তার ব্যতিক্রম। চট্টগ্রামের মেয়রের ব্যক্তি উদ্যোগে ও আন্তরিকতায় সকল স্তরের নাগরিকের সম্পৃক্ত করায় বইমেলা ১৯ সফলতার দিক নির্দেশনা হিসেবে বিবেচিত হবে। চট্টগ্রামের ইতিহাসে এএক মাইল ফলক।
চট্টগ্রাম বই মেলায় প্রতিদিন প্রচুর লোক সমাগম হচ্ছে। তাঁরা শুধু যে দর্শক, তা কিন্তু নয়। সমীক্ষায় দেখা গেছে প্রতিদিন প্রচুর বই বিক্রি হচ্ছে। তাঁদের ধারনা এবারের বই মেলায় ৮ থেকে ১০ কোটি টাকার বই বিক্রি হতে পারে। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, প্রতিটি স্টলে লেখক, মুক্তিযোদ্ধা, সমাজসেবক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষাবিদ, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, পেশাজীবী, ছাত্র, যুবা, শিশু-কিশোরসহ সর্বস্তরের মানুষের সমাগম এটাই প্রমাণ করেছ, সম্মিলিত বই মেলার কোন বিকল্প নেই।
ইতিপূর্বে চট্টগ্রামের বইপ্রেমিদের ঢাকা বইমেলার দিকে তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে থাকতে হতো। এবার থেকে আর তার অপেক্ষায় থাকতে হবে না। এবারের মেলায় ঢাকা চট্টগ্রামের ১১০টি প্রকাশনা বই মেলায় অংশ নিয়েছে। প্রায় সকল প্রকাশক নতুন নতুন বই নিয়ে পাঠকের সামনে হাজির হচ্ছেন। আবার প্রতিদিন বইপ্রেমিরা নতুন বইয়ের পাতা উল্টে পাল্টে দেখছেন। আবার নিজের পছন্দনীয় বইটি কিনে নিচ্ছেন। এতে করে পাঠকের চাহিদা যেমন পূরণ হচ্ছে। তেমনি নাগরিকদের জ্ঞান ও রুচির পরিধি ও মান বাড়ছে এটা নিঃসন্দেহে বলা যাবে। এই যে বিকল্প বই বাছাইয়ের সুযোগ সৃষ্টি হওয়াতে একজন সাধারণ পাঠক উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন-কোনটি ভাল মানের বই।
ভাল বই চেনার পাশাপাশি চট্টগ্রামে একটি সার্বজনীন বইমেলা উৎসব পালনের পটভূমি ও অনুসঙ্গ সৃষ্টি হলো। মেয়রের ঘোষণা অনুযায়ী আগামীতে প্রতিবছর একই দিনে একই ভেন্যুতে বইমেলা অনুষ্ঠিত হবে। ধারনা করা যাচ্ছে যে, আগামী বছরগুলোতে শুধু জিমনেসিয়াম চত্বর নয় আশপাশ এলাকাগুলোতে মেলা বিস্তারের সম্ভাবনা প্রচুর। অর্থাৎ আগামী বছরেই মেলার পরিধি বাড়াতে হবে এ যাবত কোন প্রকার অঘটন ছাড়াই চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধানে মেলা সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হলো। এজন্য সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, সংশ্লিষ্ট কমিশনার, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আন্তরিক ধন্যবাদ। চট্টগ্রাম সৃজনশীল প্রকাশনা পরিষদসহ সকল পক্ষের সম্মিলিত উদোগে চট্টগ্রাম একটি বইমেলা উৎসব পালনের সুযোগ পেল। চির অম্লান হোক একুশের বইমেলা। বিগত কয়েক বছরের মতো এবারও সিটি কর্পোরেশন একুশে স্মারক সম্মাননা ও একুশ সাহিত্য পুরস্কার ঘোষণা করে। ভাষা সৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা, সমাজসেবক, চিকিৎসক, শিক্ষাবিদ সঙ্গীত শিল্পী, পেশাজীবী ও সাংবাদিকতায় মোট চৌদ্দটি ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য চট্টগ্রামের চৌদ্দজন গুণী ব্যক্তিকে পদক ক্রেস্ট দেয়া হয়। একুশে স্মারক সম্মাননা পদক ও একুশে সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্ত ব্যক্তি ও পরিবারের পক্ষ থেকে পরিবারের লোকজন পদক গ্রহণ করেন। বইমেলা মঞ্চে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে মেয়র এই সম্মাননা ক্রেস্ট ও পদক তুলে দেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন মেলা কমিটির আহব্বায়ক, কাউন্সিলর নাজমুল হক ডিউক। সংবর্ধিত ব্যক্তিদের মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরিন আখতার, প্রফেসর প্রকৌশলী এম আলী আশরাফ সাদিয়া গাজী রহমান, মানজুর মুহাম্মদ, মোস্তফা কামাল, মহিউদ্দিন শাহ আলম নিপু, শহীদ আব্দুর রব, আইউব বাচ্চু, দবির উদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ।
আমরা আশা করি গুণীজনদের সংবর্ধনা প্রদান ও তাদের অবদানের স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে দেশে সৃষ্টি হবে হাজারো গুণীজন। প্রবাদে আছে, যে জাতি গুণীজনদের সম্মান করতে জানে না, সে জাতি পিছিয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষার জন্য কাজ করার অঙ্গীকার করায় মেয়রকে ধন্যবাদ।
বাংলাদেশে একাধিক ভাষা বিদ্যমান। বাংলাভাষা আজ আন্তর্জাতিক ভাষার মর্যাদা পেয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃত। এ দিবস সারাবিশ্বে পালিত হচ্ছে। এটা বাঙালা ভাষা ও বাঙালি জাতির গৌরব। তার মানে এই নয় যে, প্রচলিত অন্যান্য ভাষাকে হেয় মনে করার অবকাশ নেই। আমাদের সকল জাতি ও গোষ্ঠির ভাষাকে সমানভাবে সম্মান করার মানসিকতা অর্জন করতে হবে। তাহলেই দেশ ও জাতি এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে ভাষা হচ্ছে নদীর জলের মতো প্রবাহ মান। একটি ভাষায় অন্য ভাষার শব্দ ও বাগধারা অবলীলায় মিশে যায়। তাকে অবজ্ঞা করার সুযোগ নাই। বাংলাভাষায় তেমনি অনেক শব্দ ঢুকে গিয়ে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। আমাদের মনে রাখতে হবে বৈশ্বিক ও ধর্মীয় প্রয়োজনে আমাদের অন্যভাষা শিক্ষা গ্রহণ করার কোন বিকল্প নেই। অন্য ভাষা যেমন শিখব, চর্চা করবো তেমনি আমাদের মায়ের ভাষার প্রতি যথাযথ সম্মান ও শ্রদ্ধা থাকতে হবে। শুদ্ধ বাংলা বলা ও লেখার প্রতি অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে। পৃথিবীতে অনেক জাতি আছে যারা মাতৃভাষাকে মর্যাদা ও গুরুত্ব দিয়ে জ্ঞান বিজ্ঞানে প্রভৃত উন্নতি করেছে। তারা অন্য ভাষা চর্চা করে না। এমনকি বৈশ্বিক অঙ্গনে নিজের ভাষা ছাড়া অন্য ব্যবহার করে না। অথচ বাংলাদেশে এমন ব্যক্তি আছন যারা বাংলা চর্চা করতে হীন মান্যতায় ভুগেন। তারা মনে করেন বাংলা ভাষায় কথা বললে আভিজাত্য চলে যায়। আবার বেশিরভাগ ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান তাদের সাইনবোর্ড ও অন্যান্য কাজে বাংলা ব্যবহার করে থাকেন না। সরকারের উচিত হবে এদের কঠোর হস্তে দমন করা।
মনে রাখতে হবে ভাষার আন্দোলন থেকে স্বাধীকার আন্দোলনের সূত্রপাত এবং স্বাধীনতা। কাক যেমন ময়ুরপুচ্ছ লাগিয়ে ময়ুর হতে পারে না তেমনি পরভাষা ও সংস্কৃতি ধারণ করে কেউ কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না। তাই নিজের ভাষা ও সংস্কৃতিকে প্রাণের মধ্যে স্থান দিতে হবে। উন্নত জাতি হিসেবে বিশ্বে স্থান করে নিতে হবে প্রথমেই নিজ ভাষা ও সংস্কৃতিকে বুকের মধ্যে স্থান দেয়ার কোন বিকল্প নাই।
এবারের সম্মিলিত একক বই মেলা সে শিক্ষা দিয়ে গেল। আসুন আমরা নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে আরো বেশি বেশি লালন করে ভাষার মাসকে সম্মান জানাই।

লেখক : কবি, নিসর্গীক ও ব্যাংক নির্বাহী (অব.)