সম্ভাবনার ই-কমার্স প্রতারণার ঘূর্ণিপাকে

5

প্রযুক্তির উৎকর্ষতার কল্যাণে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর হওয়ার সাথে সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দ্রুত জনপ্রিয় হতে থাকা সম্ভাবনাময় ই-কমার্স খাত প্রতারণার ঘূর্ণিপাকে পড়েছে। করোনাকালে প্রযুক্তিবান্ধব ই-কমার্স খাতের প্রসারের পাশাপাশি ভোক্তা বা ক্রেতাদের নির্ভরশীলতা বৃদ্ধির সময়ে একশ্রেণির মানুষ এটিকে মাল্টিপারপাস প্রতারণার মত অল্প সময়ে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ডিজিটাল পদ্ধতিতে পরিণত করেছে। কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের চটকদার প্রলোভনের ফাঁদে পা দিয়ে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ক্রেতা-সাধারণ প্রতারণার শিকার হওয়ায় সম্ভাবনাময় এ খাতে এখন আস্থাহীনতা বিরাজ করছে। বিকশিত হওয়ার সময়েই কেলেঙ্কারির ঘটনাগুলো ই-কমার্স খাতে অস্থিরতা তৈরি করেছে।
এদিকে, বিভিন্ন মাধ্যমে অনলাইনে পণ্য কেনাকাটা বিষয়ক প্রচারিত বিজ্ঞাপনে বাধ্যতামূলকভাবে সতর্কবার্তা প্রচারের নির্দেশনা দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। গতকাল রবিবার এক সরকারি তথ্য বিবরণীতে এ নির্দেশনা দেয়া হয়। দেশে ই-কমার্সের নামে গ্রাহকদের অর্থ আত্মসাৎ ও প্রতারণার লাগাম টানতে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়ার ধারাবাহিকতায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এই নির্দেশনা এলো।
সরকারি তথ্য বিবরণীতে বলা হয়েছে, ‘অনলাইন কেনাকাটায় প্রতারণা হতে সাবধান থাকুন- বাণিজ্য মন্ত্রণালয়’ শীর্ষক সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি ইলেক্ট্রনিক, প্রিন্ট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত অনলাইনে পণ্য কেনাকাটার বিজ্ঞাপনের শেষে অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর আগে গত সপ্তাহে বাধ্যতামূলকভাবে অনলাইন কেনাকাটার বিজ্ঞাপনে সতর্কবার্তা প্রচারের জন্য তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেল। চিঠিতে বলা হয়, অনলাইন কেনাকাটায় প্রতারণা হতে সাবধান থাকুন- বাণিজ্য মন্ত্রণালয়’ সতর্কবার্তাটি অবশ্যই ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াসহ সব গণমাধ্যমে অনলাইন কেনাকাটার বিজ্ঞাপনের শেষে প্রচার করতে হবে।
আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগে সরকারের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্যে থাকা ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা, নিরাপদডটকম, এপিসি ওয়ার্ল্ড-এর মত এক ডজনেরও বেশি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে ‘রিং আইডি’। নজরদারিতে রয়েছে এ ধরনের আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এরইমধ্যে কমিউনিটি জবসের মাধ্যমে কর্মসংস্থান তৈরির নামে আমানত হিসেবে তিন মাসে গ্রাহকদের কাছ থেকে দুইশ’ ১২ কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে সামাজিক নেটওয়ার্কিং প্লাটফর্ম রিং আইডির বিরুদ্ধে। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ কয়েকজনের মত রিং আইডির পরিচালক সাইফুল ইসলামকেও গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। প্রতিষ্ঠানটি মাত্র তিন মাসে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে দুইশ’ ১২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে চলতি বছরের গত মে মাসে অবৈধভাবে আমানত হিসেবে ২৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকা, জুনে একশ’ ৯ কোটি ১৩ লাখ ও জুলাইয়ে ৭৯ কোটি ৩৮ লাখ টাকা সংগ্রহ করার তথ্য সাইবার পুলিশ সেন্টারের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। প্রতিষ্ঠানের সব ব্যাংক হিসাব জব্দেরও অনুরোধ করা হয়েছে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, কেবল ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানই নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পেজ খুলেও পণ্য কেনাবেচার নামে প্রতারণার অভিযোগ মিলছে। তদন্তে নেমে দেখা যাচ্ছে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে ভুয়া কিংবা ছদ্মনামে ফেসবুকে পেজ খুলে ই-কমার্সের নামে প্রতারণা করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সাথে সমন্বিতভাবে অভিযুক্ত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমের তদন্ত ও আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। আর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর ই-ক্যাব নামে এসোসিয়েশন রয়েছে। তবে এধরনের প্রতিষ্ঠান কিংবা ফেসবুক পেজ খুলে ব্যবসা করতে হলে এখন থেকে সংশ্লিষ্টদের রেজিস্ট্রেশন নিতে হবে। সবাইকে বিজনেস ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন নম্বর নিয়ে ই-কমার্স বা অনলাইন কেনাকাটার ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে।
কনজিউম্যার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) – এর চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন পূর্বদেশকে বলেন, প্রযুক্তিনির্ভর নানা অপরাধের মত ব্যবসা-বাণিজ্য খাতেও এ সুযোগকে অপব্যবহার করে আর্থিক প্রতারণা বা কেলেঙ্কারি সংঘটিত হচ্ছে। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর নজরদারির অভাব ও বিদ্যমান নীতিমালার যথাযথভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান ই-কমার্স বা অনলাইন শপিংয়ের নামে ক্রেতা বা ভোক্তা-সাধারণের সাথে প্রতারণা করছে। সরকারের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার কঠোর তদারকি ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের পাশাপাশি ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের যেসব প্ল্যাটফর্ম রয়েছে, তাদেরও এমন প্রতারণামূলক ঘটনার দায় নিয়ে একযোগে কাজ করতে হবে। নইলে বিপুল সম্ভাবনার ই-কমার্স খাতে বিপর্যয় নেমে আসার পাশাপাশি ভোক্তা-সাধারণও প্রতিনিয়ত প্রতারিত হতে থাকবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের নামে প্রতারণা ঠেকাতে স¤প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা-২০২১ জারি করে। এ নির্দেশিকা অনুসারে, পণ্যের ক্রয়মূল্য বাবদ অগ্রিম অর্থ পরিশোধের ক্ষেত্রে ক্রেতা ও বিক্রেতা একই শহরে অবস্থান করলে ক্রয়াদেশ গ্রহণের পরবর্তী সর্বোচ্চ পাঁচ দিন এবং ভিন্ন শহরে বা গ্রামে হলে সর্বোচ্চ ১০ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়া ভোক্তা বা গ্রাহকের সুরক্ষার স্বার্থে পণ্য ডেলিভারি দেয়ার পর পেমেন্ট গেটওয়ে থেকে অর্থ ছাড়করণের জন্য গত ৩০ জুন বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কোনও পণ্য স্টকে না থাকলে সেটার ক্ষেত্রে কোনওরকম পেমেন্ট গ্রহণ করা যাবে না। ক্রেতার অগ্রিম মূল্য পরিশোধের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত পণ্যটি সরবরাহকারী সংস্থা কিংবা ডেলিভারি-ম্যানের কাছে পৌঁছে দিয়ে তা গ্রাহককে অবহিত করতে হবে। পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সরবরাহকারী সংস্থা বা ব্যক্তিকে তা গ্রাহকের হাতে পৌঁছে দিতে হবে। এতে আরও বলা হয়, ডিজিটাল কমার্স পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান থেকে সতর্কতার সঙ্গে পণ্য ক্রয়ের জন্য ক্রেতা-সাধারণকে অনুরোধ করা হলো। একই সঙ্গে ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যবসা পরিচালনায় ‘ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা- ২০২১’ এর ব্যত্যয় দেখা গেলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট বন্ধ করাসহ অন্যান্য আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা- ২০২১ এর আলোকে সম্ভাবনার ই-কমার্স খাতে নিরাপদ লেনদেন নিশ্চিত করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ‘এসক্রো’ নামে একটি সেবা কার্যক্রমও চালু করতে যাচ্ছে। এসক্রো হচ্ছে এমন একটি সেবা, যেখানে একজন ক্রেতা পণ্য ক্রয়ের সময় যে মূল্য পরিশোধ করেন- তা একটি তৃতীয়পক্ষের কাছে জমা থাকে। ক্রেতা তার কাক্সিক্ষত পণ্য বা সেবা বুঝে পেয়েছেন মর্মে নিশ্চয়তা দেয়ার পরই তৃতীয় পক্ষ বিক্রেতাকে ওই পণ্যমূল্য পরিশোধ করেন। এতে ক্রেতা বা ভোক্তা পণ্যমূল্য বাবদ অগ্রিম টাকা পরিশোধ করলেও ডেলিভারি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ওই টাকা বিক্রেতার একাউন্টে স্থানান্তর বা জমা হবে না। নির্ধারিত সময়ে পণ্য সরবরাহে ব্যর্থ হলে অগ্রিম কিংবা পণ্যমূল্য হিসেবে পরিশোধ করা টাকা গ্রাহককে সাতদিনের মধ্যে ফেরত দেয়ারও বিধান রাখা হয়েছে।