সম্প্রীতির বিকল্প নাই

21

 

সেই ছোটবেলায় বলতে গেলে প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় পরীক্ষার আগে দল বেঁধে দৌড় দিতাম দরগাহে দরগাহে। লক্ষ্য একটাই- পরীক্ষায় ভালো করা। বয়সে বয়সে অবশ্য এই ভাবনায় পরিবর্তন এসেছে। অনেক সময় দেখা যায় আমাদের হিন্দু সহপাঠী,বাল্যবন্ধুরাও একই সময়ে একই দরগাহে উপস্থিত। পীর, আউলিয়া, মসজিদ, দরগাহ, মাজার-এগুলো ইসলাম ধর্মেরই সংস্কৃতি বিধায় তারা সংকোচে থাকে একসাথে আসতে। মুসলিম ছেলেমেয়েদের মায়ের পিটুনি খেয়ে খুব ভোরে মক্তবে হাজির হয়ে হুজুরের কঠোর অনুশাসন আর বেশুমার বেত্রাঘাত সহ্য করে মুখস্থ করা কয়েকটি সূরা ও দোয়াদরুদের অনুশীলন চলে এখানে। তারপর লম্বা মোনাজাতে প্রতিটি সাবজেক্ট-এ লেটার মার্ক পাওয়ার বুকভরা আশায় দরগাহের কিছু ধুলোবালি বুকে মেখে গা ফুরফুরে পবিত্রতা নিয়ে তারপর বিদায়। হিন্দু ছাত্রছাত্রীদের নিয়ম আলাদা। তারা প্রথমে সেজদা করে, তারপর হাটু গেঁড়ে বসে হাত জোর করে প্রার্থনা করে। প্রার্থনার ধরনে ভিন্নতা থাকলেও নীরব-নিঃশব্দ প্রার্থনার ভাষা কিন্ত উভয়েরই এক ও অভিন্ন। আরবি, বাংলা, সংস্কৃত সবই এখানে মিলেমিশে একাকার। হৃদয়ের আকুতি সবারই এক। এর জন্যে আলাদা কোনো ভাষার দরকার হয়না। নীরব আকুতিই এখানে একমাত্র ভাষা।
গ্রামে-লোকালয়ে দেখেছি হিন্দু নারীপুরুষ হেঁটে যাওয়ার সময় দরগাহ, মসজিদ সামনে পেলে ঠিক দরজা বরাবর দাঁড়িয়ে যান, তারপর হাত জোর করে মাথা ঠেকিয়ে সম্মান জানান।
দানবাক্সে টাকাও দেন। ওখানে মোমবাতি জ¦ালিয়ে দেওয়াও তাঁদের প্রচলিত একটি সংস্কৃতি। এটাও একপ্রকার প্রার্থনা। এটা আমরা দেখে আসছি শৈশব থেকেই। আমাদের গ্রামের প্রায় অর্ধেকই হিন্দু। অন্তরঙ্গ ও বিশ^স্থ বন্ধুদের বড়ো অংশ জুড়ে তারা। আড্ডায়, কোলাহলে কোরান-হাদিস নিয়ে কোনো বেফাঁস কথা উচ্চারিত হতে দেখিনি তাদের মুখে। বরং এগুলো নিয়ে তাদেঁর আলাদা ভক্তিই টের পাওয়া যায়। এটা আশির দশকের ঘটনা। শুক্রবার। আমাদের বোমাংহাটে সাপ্তাহিক বাজার বসেছে। মানুষের ভিড়ে দেখা গেল জেলে পাড়ার এক গৃহবধূ শাড়ির আঁচলে পেঁচিয়ে আরবি লেখা এক টুকরো কাগজ নিয়ে মসজিদের রাস্তা ধরে হেঁেট যাচ্ছেন। আমার অনুসন্ধিৎসা ছিল। পিছু নিলাম মহিলার। দেখলাম মহিলাটি কাগজটা কয়েকবার কপালে ঠেকালেন, তারপর মসজিদে থেকে বের হওয়া এক মুসল্লীর হাতে দিয়ে বলছেন, ‘আল্লাহর কোরান পথে পড়ে আছে, মানুষের পায়ের তলায় পড়তে পারে তাই আল্লাহর ঘরে নিয়ে আসলাম’। লোকটি কাগজটা নিয়ে পুকুরের পানিতে রেখে দিলেন। এটাই নাকি সম্মানের।
১৯৮৪ সালের ২১ ডিসেম্বর রাত বারোটার দিকে আমাদের ঘরে আগুন লাগে। তখন পৌষের কনকনে শীত, আমাদের পরিবারের জন্য সেটা এক দুঃস্বপ্নের রাত্রি। আগুনের লেলিহান শিখা দেখে কিংকর্তব্যবিমুঢ় সবাই। মা উঠোনে আছাড় খাচ্ছেন আর বিলাপ করছেন। এই শীতে চারদিকে লোকে লোকারন্য। আমাদের কিছু বুঝে উঠার আগেই শতশত মানুষ বালতি দিয়ে পানি ঢালছে জ্বলন্ত অগ্নিশিখায়। যাঁদের বালতি ছিল না তাঁরা হাতে বালি মারছে। একে অন্যের কাঁধে পা দিয়ে অনেকেই উঠে গেলেন চালের উপর। মানুষ লাইন ধরে হাতাহাতি করে পানিভর্তি বালতি তুলে দিচ্ছেন তাঁদের। কেউ কেউ চাল-টিন খুলে নিচ্ছেন যাতে আগুন আর বিস্তার না করতে পারে। যে যেভাবে পারে আগুন নেভানোর চেষ্টায় অস্থির। এ ঘটনায় অনেকে আহতও হন। আমাদের ঘর বাঁচানোর প্রাণপণ লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিলেন আপনাদেরই প্রতিবেশী ব্রাহ্মনপাড়া-হিন্দুপাড়ার লোকজনও। সেদিন বুঝেছিলাম ‘মানুষ আসলে মানুষের জন্যই’, এর প্রতিদান দেওয়া কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।
সম্প্রতি কুমিল্লার কথিত কোরআন অবমাননার ঘটনা আমাকে অতীতের এসব ঘটনাপঞ্জির দিকে চোখ বুলাতে বাধ্য করে। জাতিগত বিদ্বেষ ছড়িয়ে, অপরের জীবন-সম্পদ ধ্বংস করে, নিরপরাধ মানুষের অশ্রু ঝরিয়ে নারকীয় উল্লাসের কোনো মানে হয়না। আপনার উগ্রতা, হিংস্রতা, ধর্মান্ধতা দেশে অশান্তির বিষবাষ্প যেমন ছড়ায় তেমনি নিজের ধর্মটাই অন্য জাতিগোষ্ঠির কাছে প্রশ্নের সম্মুখীন করে তোলে। পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা এবং সহাবস্থানে যারা সুখ খুঁজে পায় না-এই সুন্দর পৃথিবী তাদের জন্য নয়। সম্প্রীতিতেই সুখ, এর কোনো বিকল্প নাই।
লেখক: প্রাবন্ধিক