সম্পদ বিক্রির চেষ্টা করছে ইয়াবা কারবারীরা

35

কক্সবাজারের টেকনাফের ইয়াবা কারবারীরা অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদ গোপনে বিক্রির চেষ্টা করছে। তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারিদের সম্পদ তদন্তের পর বাজেয়াপ্ত করার ঘোষণায় কৌশলে সম্পদ বিক্রির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। আত্মসমর্পণের জন্য পুলিশের হেফাজতে থাকা ইয়াবা কারবারিরাও সম্পদ বিক্রির চেষ্টা করছে। তবে এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক বলেছেন, শুধু ইয়াবা কারবারি নয়, জেলায় গোপনে সম্পত্তি বিক্রির কারো কোনও সুযোগ নেই।
গত কয়েক মাস ধরে সারাদেশের মতো কক্সবাজারেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অভিযানে দিশেহারা হয়ে পড়ে মাদক কারবারিরা। এ কারণে পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেকে আত্মগোপনে চলে যায়। কেউ কেউ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। আবার কেউ ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়। শুধু টেকনাফেই ৩৯ জন মারা গেছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ নেতা ও টেকনাফ পৌর কাউন্সিলর একরামুল হক মারা যাওয়ায় দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি হয়। ওই ঘটনার পর সাময়িকভাবে কিছুদিন অভিযান বন্ধ থাকে। আর এই সুযোগে ইয়াবা কারবারিরা এলাকায় ফিরে আসার চেষ্টা চালায়। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
এলাকাবাসীর অভিযোগ,একরামের মৃত্যুর পেছনে তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারিদের ইন্ধন ছিল, যাতে তারা বন্দুকযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ করে পার পেয়ে যেতে পারে। এই সুযোগে টেকনাফে ইয়াবার শীর্ষ কারবারি থেকে শুরু করে অনেকেই তাদের অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ বিক্রির পাঁয়তারা শুরু করেছে।
টেকনাফের মৌলভীপাড়া, নাজিরপাড়া, শীলবনিয়াপাড়া, মিঠাপানির ছড়া, লম্বরিপাড়া, জালিয়াপাড়া, শাহপরীর দ্বীপসহ কয়েকটি স্থানে ইয়াবা কারবারিদের বাড়িঘরের দরজায় তালা দেখা গেছে। আবার কিছু বাড়িতে বাসা ভাড়ার সাইনবোর্ড ঝুলানো ছিল। ইয়াবা কারবারিদের স্বজন ও স্থানীয়রা জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেতে বসতভিটাসহ অন্যান্য জমি বিক্রি করার পাঁয়তারা করছে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন জমি বিক্রিও করেছে।
স্থানীয় একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক কারবারি ও টেকনাফের নাজিরপাড়া এলাকার নুর মোহাম্মদ প্রায় ৪০ শতক জমির মধ্যে দোতলা একটি বাড়ি বিক্রির জন্য কয়েকবার চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তাড়া খেয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আত্মগোপনে চলে যায়। সম্প্রতি এক দালালের মাধ্যমে পুলিশ হেফাজতে রয়েছে নুর মোহাম্মদ।
তার দূরসম্পর্কের আত্মীয় মোহাম্মদ ফারুক বলেন, ‘মাস ছয়েক ধরে অত্যাধুনিক দোতলা বাড়িসহ ৪০ শতক জমি বিক্রির চেষ্টা করে আসছিল নুর মোহাম্মদ। গত মাসে এক ব্যবসায়ী এক কোটি টাকা দাম বলার পরও তা বিক্রি করেনি। তিন কোটি টাকা দাম হাঁকা হয়েছিল। এছাড়া নুর মোহাম্মদ কিছুদিন আগে ২০ লাখ টাকার ফসলি জমি বিক্রি করে।’ তিনি আরও জানান, নুর মোহাম্মদের জামাই মাহমুদ আলীও ৪০ শতক বসতভিটা বিক্রির চেষ্টা করছে। তবে গ্রাহক পাচ্ছে না। শ্বশুর ও জামাই দুজনই এখন পুলিশের নিরাপত্তায় রয়েছে।
মাসখানেক আগে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ জিয়াউর রহমান মারা যাওয়ার আগে নাজিরপাড়া কবরস্থান সংলগ্ন দোতলা বাড়িটি জমিসহ বিক্রির চেষ্টা করেছিল। এই জমির বর্তমান বাজার মূল্য তিন কোটি টাকার বেশি। জমিটি কিনতে একাধিক ক্রেতা এসেছিলেন বলে জানান প্রতিবেশী শামসুল আলম। তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান মারা যাওয়ার আগে তার কাছে এক ব্যক্তি এসে বাড়িটির দাম ৫০ লাখ টাকা বলেছিলেন। কিন্তু বিক্রি করেনি।
একই কথা বলেছেন বন্দুকযুদ্ধে নিহত জিয়াউর রহমানের মা নুর বেগম। তিনি বলেন, ‘জিয়াউরকে বারবার বলেছিলাম এতো সম্পদ করার দরকার নেই, শত্রু বেড়ে যাবে। সেই কথাটিই সত্য হলো। এখন এই সম্পদ দিয়ে আমার কী হবে। এখন বাড়িসহ সব সম্পত্তি বিক্রি করে দেবো। কোনও কিছুই আর রাখতে চাই না। এনাম মেম্বারের কয়েকজন স্বজনও একই কথা বলেছেন। তারাও চেষ্টা করছেন সহায় সম্পত্তি বিক্রি করে দিতে।
জানতে চাইলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসেন বলেন, ‘ইয়াবা কারবারিদের সম্পদ বিক্রির বিষয়টি আমার জানা নেই। এই রকম যদি হয়ে থাকে তাহলে তদন্ত করে এসবের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘মাদক কারবারিরা সহায় সম্পত্তি বিক্রি করে দেওয়ার পাঁয়তারা করছে এমন তথ্য পেয়েছি। তারপরও আমরা বিষয়টি নজরদারির মধ্যে রেখেছি। মাদক কারবারিদের সম্পত্তি তদন্তের পর বাজেয়াপ্ত করতে চাচ্ছি আমরা। কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ (এনবিআর) কয়েকটি সংস্থা তদন্ত করতে চাচ্ছে। ইতোমধ্যে সিআইডি টেকনাফের ইয়াবা কারবারি নুরুল ইসলাম ভুট্টোর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে আদালতে আবেদন করেছে। আশা করি পুলিশকে দিয়েই সম্পদের বিষয়টি তদন্ত করা হবে।’
জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘কক্সবাজার জেলায় গোপনে জমি বিক্রি করার কোনও সুযোগ নেই। কেউ যদি বিক্রি করতে চায় তাহলে জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে অবশ্যই অনুমতি নিতে হবে। কোনও মাদক কারবারি যদি অনুমতি ছাড়া সহায় সম্পত্তি বিক্রি করে তাহলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
উল্লেখ্য, গত বছর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তালিকায় কক্সবাজার ও টেকনাফে ১ হাজার ১৫১ জন মাদক চোরাকারবারির নাম চূড়ান্ত করা হয়। এরমধ্যে ৭৩ জন শীর্ষ মাদক কারবারি বা পৃষ্ঠপোষকের নাম আছে। তালিকায় সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদিসহ তার পরিবারের ২৬ জন সদস্য রয়েছে। তাছাড়া টেকনাফ ও কক্সবাজার অঞ্চলের আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দলের নেতাদের নাম আছে। একই সঙ্গে তালিকাভুক্ত মাদক কারবারিদের সম্পদের বিষয়টিও উঠে এসেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা প্রাথমিক তদন্ত করে নিশ্চিত হয়েছে, প্রত্যেক মাদক কারবারি অঢেল সম্পদের মালিক।