সমুদ্রস্বর্গ গোয়ায় ক্যাসিনোর রাতে

180

কলকাতা থেকে ছুটে যাওয়া ইন্ডিগো বিমানের চাকা রানওয়ে স্পর্শের আগেই প্রকৃতি ও সাগরের মেলবন্ধন স্পষ্ট। জানালায় উঁকিতেই চোখ ছানাবড়া। এই বুঝি সাগরে বিমানটি নেমে পড়ছে। গোয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি আরব সাগরের পাশেই। বিমানবন্দরের ভেতরেই মুঠোফোনের নেট অন করে গোয়ার দর্শনীয় স্থানের সৌন্দর্য্যে পুলকিত হলাম। আগেই জানতাম এক শহরে বিশটির মতো সমুদ্রসৈকত আছে গোয়াতেই। মোবাইল স্ক্রিনে হঠাৎ ভেসে ওঠলো ক্যাসিনো। ভারতের গোয়া নাকি রমরমা ক্যাসিনোতে ভরপুর। সাথে থাকা দুই ভ্রমনসঙ্গীকে জানাতেই আমার মতো তাঁদেরও আগ্রহ বাড়লো। জানিয়ে রাখি-খেলবো বলে নয়, একবার শুধু দেখবো বলে।


ভারতের পশ্চিম প্রান্তের রাজ্য গোয়ায় পৌঁছেই সিদ্ধান্ত নিলাম সৈকত ও ক্যাসিনো কাছাকাছি এমন জায়গায় অবস্থান নিবো। টেক্সি চালকের সাথে বিষয়টি শেয়ার করেই রওনা দিলাম। সাগর-উপসাগর ও প্রকৃতির দৃশ্যপট ডিঙিয়ে ছুটে চললাম বিমানবন্দর থেকে ৪০ মিনিট দুরুত্বের কালাঙ্গুট সৈকত। তড়িঘড়ি করেই হোটেল চেয়ে নিলাম। বিনয়ী টেক্সিচালক জানালো কম টাকায় ভালোমানে হোটেল মিললেও খাবারের দাম চড়া। হোটেলে লাগেজ রেখে বিকাল নাগাদ খেতে গেলেই বুঝলাম খাবারের দাম কত চড়া। দুই প্লেট ভাত, দুই বাটি ডাল সাথে এক বাটি ফুলকপির সবজি। পাঁচপোড়নে ঠাসা এই খাবারের দাম আসলো ভারতীয় ৯২০ রুপী।
শরীর না ভিজানোর শর্তে হোটেলের কাছে কালাঙ্গুট সৈকতে নেমে পড়লাম। একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত ছুটলাম। প্রথম রাতটা ক্যাসিনোতে কাটিয়ে পরদিন সমুদ্রসৈকতে ভিজবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। সৈকতে ঘুরঘুর করতে করতেই রাত ৮টা। এবার হোটেল থেকে প্রস্তুতি নিয়ে ফিরলাম ক্যাসিনোর উদ্দেশ্যে। পায়ে হেঁটেই অর্ধকিলোমিটার দূরের বাঘা সৈকতের তীরে একটি ক্যাসিনোর সন্ধান পেলাম। জায়গাটি ক্যাসিনো পয়েন্ট নামেই পরিচিত। এক জায়গাতেই বহু ক্যাসিনো। বুঝলাম, গোয়া মূলত বার, নাইট লাইফ, ক্যাসিনো, বীচের জন্য পর্যটকদের কাছে বিখ্যাত।
বেছে নিলাম একটি। ঢুকতেই চোখে পড়লো আলোকসজ্জা। সুনসান নীরবতা। দুইপাশে সারিবদ্ধ দরজা। ক্যাসিনোতে যাওয়া পর্যটকরা চাইলে এসব কক্ষেই রাত্রীযাপন করতে পারেন। এদিক সেদিক তাকিয়ে আরো কিছুদূর এগুতেই ‘হ্যালো’ ডাক। কাছে যেতেই দুই নারী জানালেন ক্যাসিনোতে প্রবেশের আগে প্রবেশ টিকিট সংগ্রহ করতে হবে। হাজার রুপী দামের প্রবেশ টিকিটের সাথে ফ্রি টি-শার্ট, রাতের ডিনার, ড্রিং। ভিতরে প্রবেশ করতেই নাচগান আর চারপাশে সাজানো জুয়ার আসর। লোকে লোকারণ্য সব আসর। কেউ খেলছে তো কেউ দেখছে। আবার কেউ সিট ছাড়লে মুহূর্তেই বসবে বলে অপেক্ষায় আছে। সিগারেট ফুঁকছে, ছোলা-বাদামের মিশ্রণে ড্রিং করার সাথে জুয়ায় মত্ত জুয়াড়িরা। কয়েকটি আসর ঘুরে দেখা গেলো অভিজ্ঞ জুয়াড়ি যেমন আছে তেমনি নতুন জুয়াড়িও বসেছে। ঘুরছি তো ঘুরছি। হঠাৎ উৎফুল্ল আওয়াজ। ইয়াহু। মানে ভাগ্য সহায় হয়েছে। জমেছে জুয়া, মিলেছে টাকা।
তাৎক্ষণিক লভ্যাংশের টাকা তুলে আসল দিয়েও খেলছেন কেউ কেউ। টাকা দেয়া-নেয়ার হিসাব মিলাতে ব্যস্ত ক্যাসিনো ম্যানেজার। আর হিসাব রক্ষণ বিভাগের তো ব্যস্ততার শেষ নেই। এত রাতেও কোটি কোটি টাকার ছড়াছড়ি এই শহরেই মানায়। ক্যাসিনোয় যাওয়াদের মধ্যেই স্থানীয়দের সংখ্যা কম। পর্যটকরাই বেশি যান ক্যাসিনোতে। জেনেছি, পুরো ভারতবর্ষের বিখ্যাত ব্যক্তিরা নাকি জুয়া খেলতে গোয়াতেই ভিড় করেন। আর গোয়া সরকারও নাকি ক্যাসিনোর আয়ের টাকায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাইনী দেন।
রাত দেড়টার মধ্যেই ক্যাসিনোতে ডিনার সেরে নিতে হবে। ডিনার শেষে ধীরে ধীরে কমতে থাকে ক্যাসিনোর সাময়িক বাসিন্দারা। বুঝতে পারলাম অনেকেই সখের বশে দেখতে যায় ক্যাসিনো। আর যারা প্রকৃতপক্ষে জুয়ায় মত্ত তারাতো নাওয়া খাওয়া ছেড়েছে কিন্তু আসরের চেয়ার ছাড়েনি। সেই লাভ হোক কিংবা লোকসান হোক।
রাতে যখন কোন কোন ক্যাসিনোর ভিতরে রমরমা জুয়ার আসরে মত্ত মানুষ। তখন বাইরের পরিবেশটা কেমন হতে পারে? রাত ৩টার দিকে ক্যাসিনো ছাড়তেই বাইরে আলো ঝলমলে রাস্তাঘাট। হাফ প্যান্ট আর অর্ধপোশাক পরিহিত নর-নারীরা এতো রাতেও সড়কে মাস্তি করছে। নিরাপত্তায় মোটেই ঘাটতি নাই। রাস্তার দ্বারে থাকা রেস্টুরেন্টগুলোতে ধুমধাম গানের তালে নেচেগেয়ে রাত কাটাচ্ছে পর্যটকরা। গাড়ি নাই। পায়ে হেঁটেই ফিরছি বাঘা বিচের কাছ থেকে কালাঙ্গুটের হোটেলে। ফিরেই একটু প্রশান্তি নিয়ে ভাবতে লাগলাম এরই নাম ক্যাসিনো। বিনোদন বটে, দারুন বিনোদন।
এক অদ্ভুদ শহর গোয়া। ১৬’শ শতকের যুগে এই শহরেই পর্তুগিজ বণিক ভাস্কো দ্যা গামা ব্যবসা করতে এসে সেখানের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন। গোয়ার রাজধানী পণজী। ভাস্কো দ্যা গামা এর বৃহত্তম শহর। পুরো শহরেই সৈকত ও প্রকৃতির মেলবন্ধন থাকলেও পর্তুগিজ সংস্কৃতির প্রভাব দেখা যায়। প্রায় সাড়ে চার’শ বছর পর্তুগিজদের দখলে থাকলেও ১৯৬১ সালের দিকে গোয়াকে নিজেদের করে নেয় ভারত। গোয়ায় সমুদ্রসৈকত, উপাসনালয়, বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যগুলো এখনো দৃশ্যমান। প্রাণী ও উদ্ভিদের এক বিপুল সমাহার। আছে জীববৈচিত্র্যের জন্য বিখ্যাত বোন্ডলা অভয়ারণ্য, ভগবান মহাবীর অভয়ারণ্য, কোটিগাঁও অভয়ারণ্য। পুরো শহরটিই যেন চোখধাঁধানো। দুইদিনের খন্ডখালীন সময়ে দেখা হয়নি চক্ষুমেলিয়ে পুরো গোয়া।