সমালোচনার মাঝেও মুনাফা বেড়েছে ইসলামি ব্যাংকের

10

পূর্বদেশ ডেস্ক

২০২২ সালজুড়ে ব্যাংক খাতে ছিল খেলাপি ঋণের জোয়ার। বছরের শেষ সময়ে দেশের বেসরকারিভাবে পরিচালিত সবচেয়ে বড় ব্যাংক ইসলামি ব্যাংকের ঋত কেলেঙ্কারিও ছিল আলোচনায়। এ কারণে আতঙ্কিত হয়ে ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নিয়েছেন অনেক গ্রাহক। তারপরও ২০২২ সালে পরিচালন মুনাফার শীর্ষে রয়েছে ইসলামি ব্যাংক।
তবে খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন অজুহাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মন্দ গ্রাহকদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। ঋণ আদায় না করেও সংশ্লিষ্ট ঋণের সুদ আয় খাতে দেখাচ্ছে। যে কারণে কাগজে-কলমে কমছে খেলাপি ঋণ, বাড়ছে পরিচালন মুনাফা, যা ব্যাংক খাতের জন্য ভালো নয়। জানা গেছে, দেশের বেসরকারিভাবে পরিচালিত ব্যাংকগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। প্রতি তিন মাসে একবার ব্যাংকগুলোকে তাদের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং সংশ্লিষ্ট স্টক এক্সচেঞ্জের কাছে জমা দিতে হয়। এর আগে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ সভায় আর্থিক প্রতিবেদন অনুমোদন করতে হয়। এরপর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের জন্য সেই তথ্য স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী, স্টক এক্সচেঞ্জে জমা দেওয়ার আগে ব্যাংকগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে এসব তথ্য জানাতে পারবে না।
তবে খ্রিস্টীয় বছরের শেষ দিন ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে সংবাদমাধ্যমকে তাদের পুরো বছরের পরিচালন মুনাফার তথ্য সরবরাহ করা হয়। এই ধারাবাহিকতায় ৩১ ডিসেম্বর রাতে বিভিন্ন সূত্রে ইসলামি ব্যাংকসহ বেশ কিছু ব্যাংকের পরিচালন মুনাফার তথ্য পাওয়া গেছে।
শনিবার (৩১ ডিসেম্বর) ব্যাংক হলিডে। এদিন ব্যাংকগুলো তাদের বিভিন্ন শাখা থেকে পাঠানো হিসাব একত্র করে বছরের আর্থিক প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধিকাংশ ব্যাংকেরই পরিচালন মুনাফা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে।
তথ্যমতে, ২০২২ সাল শেষে যেসব ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে, তার মধ্যে সবার ওপরে রয়েছে ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। ২০২২ সালে (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) ব্যাংকটি পরিচালন মুনাফা করেছে ২ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা। তার আগের বছর ২০২১ সালে ব্যাংকটির মুনাফা ছিল ২ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। তার আগের বছর ২০২০ সালে ছিল ২ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা।
আর ২০২২ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক পরিচালন মুনাফা করেছে ২ হাজার ৫২০ কোটি টাকা; আগের বছর ২০২১ সালে ছিল ২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। ২০২২ সালে সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা হয়েছে ১ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা, ২০২১ সালে ছিল ১ হাজার ১৬ কোটি টাকা। বেসরকারি মার্কেন্টাইল ব্যাংক ২০২২ সালে পরিচালন মুনাফা করেছে ৮৪৫ কোটি টাকা, ২০২১ সালে ছিল ৭২২ কোটি টাকা। সোশ্যাল ইসলামি ব্যাংকের (এসআইবিএল) পরিচালন মুনাফা হয়েছে ৫৫০ কোটি টাকা; ২০২১ সালে ছিল ৫০১ কোটি টাকা।
প্রসঙ্গত, মেয়াদি ঋণের বিপরীতে ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর সময়কাল পর্যন্ত প্রদেয় কিস্তিগুলোর ন্যূনতম ৭৫ শতাংশের পরিবর্তে ৫০ শতাংশ চলতি ডিসেম্বরের শেষ কর্মদিবসের মধ্যে পরিশোধ করা হলে ওই ঋণগুলোর বিরূপমানে শ্রেণিকরণ করা যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন সিদ্ধান্তের কারণে ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা বেড়েছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, ঋণ পরিশোধে নীতি ছাড়ের কারণে অনেক ব্যাংকেরই আদায় কমেছে। কিছু ব্যাংক কৌশলে অনাদায়ী সুদও আয়ের খাতে নিয়ে আসায় পরিচালন মুনাফা বেশি দেখাচ্ছে।
তবে পরিচালন মুনাফা ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা নয়। পরিচালন মুনাফা থেকে ঋণের বিপরীতে নির্ধারিত হারে প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ এবং কর্পোরেট কর পরিশোধের পর নিট মুনাফার হিসাব হবে। নিট মুনাফাই ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা।
ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে সরবরাহ করার তথ্য অনুযায়ী, যমুনা ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা হয়েছে ৮৩০ কোটি টাকা; আগের বছর ২০২১ সালে ছিল ৭৫০ কোটি টাকা। আল-আরাফাহ ইসলামি ব্যাংকের মুনাফা হয়েছে ৮১০ কোটি টাকা; ২০২১ সালে ছিল ৭৫০ কোটি টাকা। এনআরবিসি ব্যাংক ২০২২ সালে মুনাফা করেছে ৪৫৫ কোটি টাকা, আগের বছর ছিল ৪৪৪ কোটি টাকা। ইউনিয়ন ব্যাংকের মুনাফা হয়েছে ৪৫০ কোটি টাকা, আগের বছর ছিল ৩৬০ কোটি টাকা।
এ ছাড়া ২০২২ সালে ২০০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স (এসবিএসি) ব্যাংক, এর আগের বছরে এ ব্যাংকের মুনাফা ছিল ২১০ কোটি টাকা। ২০২২ সালে মেঘনা ব্যাংক ১০৫ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে; ২০২১ সালেও ব্যাংকটির ১০৫ কোটি টাকা মুনাফা ছিল।
রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক ২০২২ সালে পরিচালন মুনাফা করতে পারেনি, উল্টো তাদের লোকসান হয়েছে ৩৭১ কোটি টাকা; আগের বছরও ক্ষতি ছিল ৮০ কোটি টাকা। এ ছাড়া সিটিজেন ব্যাংক ছয় মাসে পরিচালন মুনাফা করেছে ২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। ব্যাংকটি ২০২২ সালে কার্যক্রম শুরু করেছে।
তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপিদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি ঋণের সুদ আয় খাতে দেখাচ্ছে। এতে কাগজে-কলমে ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন ভালো দেখানো হচ্ছে’।
তিনি আরও বলেন, ‘ব্যাংকের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে রাজনৈতিক কমিটমেন্ট ও সদিচ্ছা দরকার’। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়, যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ।