সমাধান কোন পথে?

19

পূর্বদেশ ডেস্ক

দেশে গত কয়েক বছর রাজনৈতিক অঙ্গনে বিএনপি সক্রিয় থাকলেও খুব একটা সংঘর্ষে জড়াননি দলটির নেতাকর্মীরা। কিন্তু সম্প্রতি দলটির কৌশলে পরিবর্তন হয়েছে এবং শীর্ষ পর্যায় থেকেও কর্মী-সমর্থকদের রাস্তায় নেমে আসার কথা বলা হচ্ছে। অন্যদিকে সরকারি দলের নেতারাও রাজপথ যে কোনো মূল্যে দখলে রাখার ঘোষণা দিচ্ছেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখনো প্রায় ১৫ মাস বাকি। এই নির্বাচনকে সামনে রেখে বড় দুই দলের এমন পাল্টাপাল্টি অবস্থান রাজনীতিকে সহিংসতাপূর্ণ করে তুলতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে। তারা বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে দুই দলের জেদাজেদি ও ক্ষমতা-কেন্দ্রিক মহড়ার ফল হলো সহিংসতা – যা সামনে আরো বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলের কর্মসূচিতে বাধা না দেয়ার কথা বলেছিলেন। আর বিরোধী দল বলছে বাধা আসলেও তারাও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করবেন। এমন পরিস্থিতিতে সামনে বিএনপির দিক থেকে সরকারবিরোধী আরও কর্মসূচি আসছে, অন্যদিকে সরকারি দলের নেতাদের কাছ থেকে আরও কঠোর পুলিশি পদক্ষেপের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে ।
এসব কারণেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মাঠ দখলের রাজনীতি আসলে সার্বিক পরিস্থিতিকেই সহিংস করে তুলতে পারে এমন আশঙ্কা রয়েছে।
তত্ত¡াবধায়ক সরকার ছাড়া বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না বিএনপি। নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়ে আন্দোলন করছে দলটি। আর এই সরকারের অধীনেই নির্বাচন আয়োজনে অনঢ় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। বিদ্যমান এই রাজনৈতিক সংকট সমাধানে সংলাপ-সমঝোতায় জোর দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা।
কয়েক সপ্তাহ ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একতরফা হামলা চালানোর অভিযোগ করার পর এখন বিরোধীদল বিএনপিকেও সংঘর্ষে জড়াতে দেখা গেছে। গত সোমবার বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে ঢাকার হাজারীবাগে। বিএনপির কর্মীদের অনেককে এখন লাঠির মাথায় জাতীয় পতাকা বেঁধে তাদের দলের মিছিল-সমাবেশে অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনের আগের বছরই রাজনীতি সংঘাতের দিকে এগুচ্ছে কিনা-এই আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকদের অনেকে।
রাজপথে একতরফা মার খাওয়ার পর বিএনপির কোন কোন নেতা এখন প্রতিরোধের কথা বলছেন। কয়েকদিন ধরে দেখা যাচ্ছে, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিএনপির কর্মীরা লাঠির মাথায় পতাকা বেঁধে মিছিল সমাবেশ বা দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। এমনই একটি মিছিল থেকে বিএনপির কর্মীরা গত সোমবার আওয়ামী লীগ এবং পুলিশের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়েছিলেন ঢাকার হাজারীবাগ এলাকায়।
এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিবিসিকে বলেন, তাদের দলের কর্মীদের কেউ কেউ আত্মরক্ষার্থে এভাবে কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছে। তবে এটি তাদের দলীয় সিদ্ধান্ত নয় বলে তিনি দাবি করেন। তিনি আরও বলেন, মার খেতে তারা এখন পতাকা নিয়ে মিছিল করছে। পতাকা নিয়ে মিটিংয়ে যাচ্ছে। অন্য কোনো সমস্যাতো তারা তৈরি করে নাই। বিএনপি মহাসচিবের অভিযোগ, পতাকা নিয়ে মিছিলেও ক্ষমতাসীনরা আক্রমণ করছে।
মির্জা ফখরুল বলেন, সা¤প্রতিক সহিংসতার পুরো দায় সরকারের। আমরা কোনো সহিংসতা করছি না। সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক, নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছি। আওয়ামী লীগ ঘোষণা দিয়েছে যে তারা রাজপথ দখল করবে ও রাজপথে আর কাউকে আসতে দেবে না। আমরা কখনোই সন্ত্রাসী বা সহিংস কোনো কর্মসূচিতে যাবো না। তবে এটা নির্ভর করবে আওয়ামী লীগ কীভাবে নিতে চায়।
তবে কোনো দলের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে কর্মীরা যখন লাঠির মাথায় পতাকা বেঁধে অংশ নেন, তখন সংঘাতের সুযোগ থাকে কিনা বা অন্য রকম কোনো বার্তা দেয় কিনা-এসব প্রশ্ন আমলে নিতে রাজি নয় বিএনপি নেতৃত্ব। তাদের অনেকের বক্তব্য হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন না করার অবস্থানে থেকে এখন তারা এই সরকারের পতনের আন্দোলনে মাঠে নেমেছেন। ফলে এই আন্দোলনে এবার তাদের জয়ী হতে হবে, তা নাহলে তাদের জন্য আসবে চরম বিপর্যয়। এমন চিন্তা নিয়ে তারা এগুচ্ছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপি সিনিয়র একাধিক নেতা বিবিসিকে বলেন, সারাদেশে তাদের দলের নেতাকর্মীরা এবার কিছুটা আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়ে মাঠে নেমেছেন। ফলে নির্বাচনের আগের বছরই দলটির নেতৃত্ব রাজপথে প্রতিরোধ করার একটা শক্তি অর্জন করতে চাইছেন। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মারমুখী আচরণ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক রওনক জাহান বিবিসিকে বলেন, দুই দলের অবস্থানের কারণে নির্বাচনের অনেক আগেই রাজনীতিতে নানা আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। নির্বাচনের দেড় বছর বাকি থাকতেই বা অনেক আগে থেকেই চারিদিকে যে সংঘর্ষ হচ্ছে, এটা অপ্রত্যাশিত। এটা দুই দলের জন্যই ঝুঁকি তৈরি করছে। এটা কোনো ভাল দিকে এগুবে না, মনে করেন অধ্যাপক রওনক জাহান।
রাজনীতিতে নানা আশঙ্কা যে সৃষ্টি হচ্ছে, সেজন্য বিএনপি দায় চাপাচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ওপর। বিএনপি অভিযোগ, গত কয়েকসপ্তাহে বিভিন্ন জায়গায় তাদের কর্মসূচিতে পুলিশ এবং ক্ষমতাসীন দল হামলা করেছে।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, বিএনপির কোনো কর্মসূচিতে তারা বাধা দিচ্ছেন না। একইসাথে তিনি বলেন, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে লাঠিসোটা বহন করা হলে সরকার আইন প্রয়োগে কোনো ছাড় দেবে না। তারা (বিএনপি) কোনো একটা সমাবেশ করলেই সেই সমাবেশকে কেন্দ্র করে দেশের মধ্যে একটা উচ্ছৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করছে। এটা কোনোভাবে কাম্য না, বলেন ড. রাজ্জাক।
তিনি হাজারীবাগের সংঘর্ষের ঘটনাকে উদাহরণ হিসাবে টানেন। ঢাকায় হাজারীবাগের সমাবেশে তারা (বিএনপি) লাঠি নিয়ে গেছে। আমি সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই, কোনোক্রমেই এটা অ্যালাউ করা হবে না।
আওয়ামী লীগ নেতা ড. রাজ্জাক জানিয়েছেন, কোনো জনসভা বা সমাবেশ করতে হলে, সেই দলকে প্রথমে নিশ্চয়তা দিতে হবে যে সেখানে কেউ লাঠিসোটা বা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যেতে পারবে না। সরকারও সেরকম নির্দেশ ইতিমধ্যে আইন শৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীকে দিয়েছে।
বর্তমানে দেশের রাজনীতিতে এমন সংঘাতময় পরিস্থিতি দেখা দেয় ভোলায় বিএনপির কর্মসূচিতে সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে। জুলাইয়ের শেষ দিকে ভোলার ঘটনায় গুলিতে বিএনপির দুজন নেতাকর্মীর মৃত্যু হয়। এরপর বিভিন্ন জায়গায় বিএনপির সমাবেশ ঘিরে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ হয়েছে। তবে ১ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জে বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে একজন নিহত হলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ওইদিনই আরও কয়েকটি জেলায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
সম্প্রতি ঢাকার বনানী এবং মিরপুর এলাকায় বিএনপির কর্মসূচি পন্ড হয় এবং দলটির কয়েকজন শীর্ষনেতা আহত হন। সবশেষ গত বুধবার মুন্সীগঞ্জে বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ এক যুবদলকর্মীর মৃত্যু হয়। সূত্র : বিবিসি।