‘সমাজের অন্তরালে মুখ ও মুখোশ’

115

মুহাম্মদ এনামুল হক মিঠু

 

‘মুখ ও মুখোশ’ শব্দ দুটিকে আলাদা করে ভাবার সুযোগ নেই। ‘মুখ’ শরীরের বিশেষ একটি অঙ্গ এবং অন্যদিকে ‘মুখোশ’ যা মুখকে ঢেকে রাখার ক্ষেত্রে সহায়তা করে। তবে ভাবার্থের দিক থেকে মুখ ও মুখোশের মধ্যে যে সম্পর্ক বিরাজ করে তা বিপরীত এবং বাস্তবতার বিপ্রতীপ কোণে সংজ্ঞায়িত। ‘মুখ’ একটি প্রকৃতিসঞ্জাত সত্য, ‘মুখোশ’ হলো আরোপিত এক কৃত্রিমতা। আর এই কৃত্রিমতা যখন প্রকৃত সত্যকে আড়াল করে দেয় তখন মুখোশকে নেতিবাচক অর্থে সংজ্ঞায়িত করে আমাদের প্রচলিত সমাজ। তবে কি করোনাকালে আমারা যে মুখোশ পরছি, এই সেই মুখোশ যাকে নেতিবাচক অর্থে সংজ্ঞায়িত করা যায়? না। করোনা থেকে বাঁচতে আমরা যে মুখোশ পরছি তা আমাদের আত্মরক্ষাকারী। কিন্তু আমি আজ যে মুখোশের কথা বলছি এবং বলব তা আমাদের জীবনসংহারী এবং সমাজ ধ্বংসকারী। ১৯৫৪ সালে আব্দুল জব্বার খানও তার পরিচালনায় বাংলাদেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ সিনেমায় এই মুখোশের চিত্রই তুলে ধরেছিলেন। বর্তমানে সেই ৬০ দশকের মুখোশের সংখ্যা প্রবল বৃদ্ধি পেয়েছে। সমাজের অলিতে-গলিতে শুধু মুখোশের উপচেপড়া ভিড়। মাথায় টুপি, গালভর্তি দাড়ি এবং পরিধানে সাদা লম্বা জোব্বা। শরীর থেকে সুগন্ধি ছড়াচ্ছে। গুনাহের কাজের কথা শুনলেই যে নাউজুবিল্লাহ বলতে ভোলে না, সেই রকম মানুষটাও কখনো রাতের আঁধারে কিংবা একটু নিরিবিলিতে নাবালক ছোট্ট শিশুটির ওপর হায়েনার মতো পড়ে যায় যৌন লালসা মেটাতে। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের সমাজে প্রায়ই এমন ঘটনা ঘটে, ঘটছে অহরহ। একটা পরিসংখ্যান দিলেই বিষয়টা বুঝতে পারবেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন মতে, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বলাৎকারের শিকার এমন ছেলে শিশুর সংখ্যা ৭৮ জন।
দেশ ও জনগণের স্বার্থে সর্বদা সচেষ্ট থাকব- এমন নীতি বুকে ধারণ করে যে মানুষগুলো আজ বড় বড় চেয়ারে বসা, তারাও সুযোগে টেবিলের নিচ দিয়ে কোটি কোটি টাকার লেনদেন করে। তারাও তাদের আশপাশে কোনো এক পরিচিত মুখ হলেই উঠে-পড়ে লাগে অফিসের খালি আসনটিতে সেই পরিচিত মানুষটিকে কীভাবে বসানো যায়। অথচ সেখানে যোগ্যতার প্রশ্নটি বারবার মৃত্যুবরণ করে। আমাদের এই সমাজে যাদের আমরা সভ্য মানুষ বলে চিনি-জানি, তারাই বেশি অসভ্য, দুর্নীতিপরায়ণ এবং নেপোটিজমে আসক্ত। কিন্তু তাদের চেনা বড় কঠিন কারণ তারা তাদের অসভ্য চেহারার উপরে পড়ে আছে সভ্যের মুখোশ। এ অসভ্য মানুষদের কাজের জন্যই বারবার আমাদের দেশটি বহির্বিশ্বে পরিচিত লাভ করে একটি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে। বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) কর্তৃক পরিচালিত ‘দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই) ২০২১’ অনুযায়ী ১৮০টি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়।
বর্তমান সময়ের একটি যজ্ঞ মঞ্চের নাম ধর্ষণ। এই যজ্ঞ মঞ্চের নাটের গুরু আমাদের সমাজেরই লোক, তারা কেউ আমাদের আত্মীয়, কেউ শিক্ষক, কেউ বাড়ির মালিক, কেউ ছাত্র, কেউবা পরম আত্মার বন্ধু, পরিজন। অথচ আমরা তাদের চিনিই না, জানিই না তাদের এই সভ্য মুখোশের আড়ালে তাদের প্রকৃত সত্তাটা কত ভয়াবহ, কতটা ভয়ঙ্কর ! কিন্তু আমাদের আশপাশেই তাদের সদা বসবাস। সত্যি বলতে, এই হায়েনাদের হাত থেকে আমাদের সমাজের কেউই রেহাই পায় না। না পায় প্রতিবন্ধী পথশিশুটি, না পায় ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ মহিলাটি, না বাড়ির কাজের মেয়েটি, না ঔরসজাত মেয়ে সন্তানটি, না স্কুল শিক্ষিকা, অফিস-কলিগ, ছাত্রী বা একইসঙ্গে পড়তে যাওয়া মেয়েবন্ধুটি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সর্বশেষ তথ্য মতে, ২০২১ সালে বাংলাদেশে ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট এক হাজার ৩২১ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণপরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৭ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৯ জন। তারই পাশাপাশি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৭৪ জন।
অতএব, এমন অসংখ্য চিত্রই প্রত্যহ আমাদের সমাজে ঘটছে। যে চিত্রগুলোর অগ্রনায়ক হয়ে থাকে আমাদেরই সঙ্গে নিত্য পথচলার কেউ না কেউ। অথচ আমরা তাদের চিনিই না কিংবা চিনতে অনেকটা দেরি করে ফেলি। আজ আমরা যাকে নেতা মানছি, সে-ই লোকচক্ষুর আড়ালে ক্ষমতার দাপটে অনিয়মের সম্রাট।আদর্শ-সমাজ-দেশকে বিক্রি করে নিজের নামে করছে ব্যাংক-ব্যালেন্স, গড়ছে ইমারত। যাকে আমরা বন্ধু ভাবছি, সে-ই হাসির আড়ালে স্তরে স্তরে সাজায় মারণফাঁদ। যাদের আমরা আপনজন মনে করি, তারাই সুযোগে শ্রেষ্ঠ খলনায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। আবার কখনো কখনো এই মুখোশওয়ালাদের ভিড়ে কেউ না কেউ বিপদকালে নিজের সবটা দিয়ে চরম আপন হয়ে ওঠে এবং প্রকৃত মুখ মানে প্রকৃত সত্তার ইতিহাস রচনা করে বসে। এজন্য আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, আমাদের সমাজটাই এক ধরনের ‘মুখ ও মুখোশ’ দ্বন্দ্বের উপাখ্যান। কোনটা মুখ আর কোনটা মুখোশ তা চেনা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। যেমন বর্ণিল আলোকসজ্জায় কে কালো, কে ফর্সা তা না বোঝার নির্মম বাস্তবতা। অথচ বর্ণিল সৌন্দর্যের পেছনে কত ভয়ঙ্করী সত্তা লুকিয়ে থাকে তা কেউ জানে না। আসলে সেই ভয়ঙ্করী সত্তাটি সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় লোকারণ্যে শুধু অদৃশ্যমান। এই যে আমাদের সুশীল সমাজ, টা -ই- বা কতটা সুশীল? মাঝে মাঝে আমার প্রশ্ন জাগে। আজ যারা যত্রতত্র সযতেœ পরে মুজিব কোট, অথবা কেউ কেউ নিজের সমস্ত অপরাধ গুলো ঢেকে রাখার জন্য এ-ই লীগ, সেই লীগের তকমা লাগাচ্ছে, তাদেরই হয়তো কারও না কারও আলমারিতে লুকিয়ে আছে জিয়াউর রহমানের আমলের সেই সাফারি। এরা যে, কত ভয়ংকর হবে তা ভবিষ্যতে ফের টের পাবে।
আসলে দুনিয়াটা চলে গেলে সব স্বার্থবাদীদের দখলে এবং আমরা সবাই সুযোগসন্ধানী। আমরা অপেক্ষায় থাকি কখন কোন রূপে আবির্ভূত হলে নিজের প্রত্যাশা জয়লাভ করবে। প্রকৃতপক্ষে, সুযোগ সন্ধানের তরে মুখোশ পরা খারাপ কিছু নয়। যদি সেটা ব্যক্তির জীবনে সুখ ও সমৃদ্ধি বয়ে আনে। কিন্তু বাস্তবতার দিক থেকে, আমাদের সমাজে যে মুখোশপরা সুযোগসন্ধানীরা বসবাস করে তারা এতটাই দানবীয় ও রাক্ষুসে হয় যে তাদের জন্য আমাদের দেশ ও সমাজটা হয়ে ওঠে সকলের অবাসযোগ্য। এজন্য মুখোশ নয়, মুখের সমাজ চাই যে সমাজে সত্য ভালোবাসা, অগাধ বিশ্বাস আর আত্মসম্মানে টইটম্বুর থাকবে। যে সমাজে মানুষ মানুষের জন্য কাজ করে আনন্দ খুঁজে পাবে। কোনো জুলুমবাজী থাকবে না, কোনো অত্যচারী থাকবে না, থাকবে না কোনো প্রতিহিংসা। স¤প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ থাকবে মানুষের প্রতিটি মগজ।
সুতরাং, আসুন, সবাই মুখোশের বিরূদ্ধে সোচ্চার হোন। আমরা মুখোশকে ধ্বংস করে মুখের (প্রকৃত সত্তা) দেশ ও সমাজ গঠন করি। তবেই আমাদের মাঝে বিরাজ করবে শান্তি ও স্বস্তি এটাই হোক সর্বস্তরের প্রত্যাশা। লেখক: কলামিস্ট