সব গুজবতো গুজব নয়

46

গুজব আতঙ্কের সৃষ্টি করে। গুজবে কান না দিয়ে কৌশলে যারা আতঙ্ক ছড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন। গুজবকারীদের সনাক্ত করে, আইনের কাছে সোপর্দ করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব আগেও হয়েছে। সেই তুলনায় এই মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশী। ইতোমধ্যে রাজধানীর বাইরে তথা সারাদেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে এবং দিন দিন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এডিস মশার আক্রমণ এবং ডেঙ্গুর সংক্রমণ অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এই বিষয়ে মানুষ খুবই আতঙ্কগ্রস্ত। এহেন বাস্তবতায় ডেঙ্গুকে কারো কারো ভাষায় গুজব বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার উপদ্রব বৃদ্ধির পেছনে আবহাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বড় ভূমিকা রয়েছে।
জ্বর হলেই আতঙ্কিত না হওয়ার কথা বারবার বলা হচ্ছে। জ্বর মানে ডেঙ্গু নয়। ডেঙ্গু রোগের প্রাথমিক লক্ষণ এবং উপসর্গ দেখা গেলেই চিকিৎসকের পরামর্শ আবশ্যক। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বেশী পরিমাণে পানি, খাওয়ার স্যালাইন, ডাবের পানি এবং তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ এবং নিয়ম মেনে চললে ৭/৮ দিনেই ডেঙ্গু রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়। আমাদের জানা দরকার, সাধারণত বদ্ধ পরিষ্কার পানি এডিস মশার প্রজনন স্থান। বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটে। বিশেষ করে বন্যা এবং বন্যা পরবর্তী এডিস মশার প্রজনন ক্ষমতা বেড়ে যায়। তাছাড়া থেমে থেমে বৃষ্টির কারণেও পানির জমে এডিস মশার প্রজনন বিস্তারের অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা শুধু কীটনাশক ছিটিয়ে ধ্বংস করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে ব্যাপক জনসচেতনতা ও সতর্কতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এডিস মশা সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা না গেলেও ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা সম্ভব। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার প্রজনন স্থান চিহ্নিত করে কার্যকর কীটনাশক ব্যবহার করা প্রধান কর্তব্য। ডেঙ্গু মোকাবেলায় সর্বপ্রথম প্রয়োজন, ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক সুরক্ষা। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমি, আপনি, আমরা ব্যক্তিগত উদ্গ আমাদের চারপাশের ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করা অপরিহার্য। এই ব্যপারে নিজে সচেতন হই এবং অন্যকে সচেতন হতে উদ্ভুদ্ধ করি। ঘরে এবং আশে-পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্লাষ্টিকের পাত্র, মাটির পাত্র, টিনের কোটা, ডাবের খোসা, অব্যবহৃত টায়ার এবং পরিত্যক্ত ব্যাটারী সরিয়ে ফেলতে হবে। বাসায় ব্যবহৃত ফুলের টব, ফ্রিজের পেছনের পাত্রে জমানো পানি এবং এসির পানি ২/৩ দিন পরপর পরিবর্তন করা উত্তম। জন সচেতনতার জন্য লিফলেট, পোষ্টার, নাটক এবং প্রয়োজনে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচিত্র প্রদর্শন করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। চলতি বছরে রাজধানীসহ সারাদেশে এডিস মশার প্রজনন বাড়তে পারে, আশঙ্কা করে ০৪ মাস আগেই সিটি কর্পোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করেছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে। দূর্ভাগ্য হলেও সত্য, এই বার্তা তাঁদেরকে আন্দোলিত করেননি। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে যথা সময়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। অথচ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা এবং মশা নিধন বিষয়টি সিটি কর্পোরেশনের রুটিন কাজ। প্রাথমিক পর্যায়ে কীটনাশকের ব্যাপারটি হয়েছে রহস্যময়। অসাধু ব্যবসায়ীর পাল্লায় পড়ে অকার্যকর কীটনাশকের ব্যবহার সিটি কর্পোরেশনকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। এক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশনের সদিচ্ছার অভাব ছিল না, তবে কীট নাশকের বিড়ম্বনায় কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারার কারণে কর্মকর্তা/কর্মচারীদের ঘুম হারাম হয়েছে নিঃসন্দেহে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে দেশের ৬৪ জেলায় সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গুরোগী ভর্তি এবং ডেঙ্গু পরীক্ষায় মানুষের মধ্যে উৎকন্ঠা কাজ করছে। সেকারণে এক ধরনের চিকিৎসাজট সৃষ্টি হয়েছে। এইভাবে আতঙ্কিত হয়ে অতিরিক্ত সংখ্যায় মানুষ হাসপাতালে ভিড় জমালে হাসপাাতালের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে। তাছাড়া হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে রোগীর চাপ সামাল দেওয়া রীতিমত কষ্টদায়ক এবং সময় সাপেক্ষ। পাশাপাশি বেসরাকারি হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু টেষ্ট এবং উপকরণ ঘিরে শুরু হয়েছে বহুমূখী বাণিজ্য। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ এবং ডেঙ্গু টেষ্টের নির্ধারিত ফি বেঁধে দিলেও কৃত্রিম সংকট তৈরী করে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধ তথা এডিস মশা নিধণে আমাদের আটঘাট বেঁধে নামতে হবে। এই অবস্থায় ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকরী ব্যবস্থা না নিয়ে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে এবং ভিআইপিদের উপস্থিতিতে বিভিন্ন স্তরে ঘটা করে র‌্যালির আয়োজন এবং ফটোসেশন আমাদেরকে করেছে হতাশ। বন্যা, খরা, ঘুর্ণিঝড়ের মত ডেঙ্গু প্রাকৃতিক দূর্যোগ না হলেও বাংলাদেশ ব্যাপী বিস্তার রোধে জনস্বাস্থের কথা চিন্তা করে সার্বিকভাবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরী। ডেঙ্গুর ভয়াল এই রূপ দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে জাতীয়ভাবে মণিটরিং সেল গঠনের গুরুত্ব অত্যধিক। বিভাগীয়ভাবে টাক্সফোর্স গঠনের মাধ্যমে এলাকা ভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবক টিম কর্র্তৃক কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ডেঙ্গু রোধ করা সম্ভব। প্রয়োজনে প্রাকৃতিক দূর্যোগে নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তা নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। যতদ্রæত সম্ভব কার্যকরী কীটনাশক আনার ব্যাপারটি গুরুত্ববহ। ঈদে ঘরে ফেরা মানুষের মাধ্যমে ডেঙ্গু জ্বর প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে আমাদের সজাগ এবং প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর জন্য মশারীর ব্যবহার বাধ্যতামূলক। ডেঙ্গু রোগীকে মশার আক্রমণ থেকে নিরাপদে রাখতে হবে। তাছাড়া ডেঙ্গু রোগী সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত স্থান পরিবর্তন করা ক্ষতির কারণ হতে পারে। মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীই ডেঙ্গু ভাইরাসের উৎস।
ডাক্তারদের প্রশিক্ষণ শুধু রাজধানী বা শহর কেন্দ্রীক না হয়ে উপজেলা ভিত্তিক করা জরুরী। আমাদের মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গুর এই প্রকোপ অক্টোবর পর্যন্ত থাকতে পারে মর্মে উপজেলা পর্যন্ত আমাদের প্রস্তুতি থাকতে হবে। ডেঙ্গু রোগের যেহেতু কোন ভ্যাকসিন নেই, সে কারণে উপজেলা/ইউনিয়ন হেল্থ কমপ্লেক্সে অবশ্যই ডেঙ্গু প্রতিরোধক ঔষধ এবং উপকরণ থাকতে হবে। আমাদের প্রথম কাজ, মশা প্রজনন বৃদ্ধির অনুকুল পরিবেশ এবং অবস্থান ধ্বংস করা। কাজেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, স্থাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং সিটি কর্পোরেশন/পৌরসভা সমূহ সমন্বিতভাবে কাজ করলে ডেঙ্গু প্রতিরোধে অতি দ্রুত সুফল পাওয়া সম্ভব।
লেখক : কলামিস্ট