সবুজের শোভায় ভরে উঠুক বঙ্গজননী

83


আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকাল। ঋতু পরিক্রমায় এখন মুষলধারে বৃষ্টি হওয়ারই কথা। কিন্তু তার বদলে তীব্র দাবদাহে পুড়ছে পুরো দেশ। ‘ঘাম ঝরে দরদর গ্রীষ্মের দুপুরে’ গ্রীষ্মের সেই চিরচেনা রূপটিই যেন দেখতে পাচ্ছি আষাঢ় গগনে। যেখানটায় হওয়ার কথা ছিল রবি ঠাকুরের ভাষায় ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরে। ওগো, আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।’’ ঋতু পালা বদলের ধারাবাহিকতা না থাকার একটাই কারণ সারা পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন। আবহাওয়ার বৈরী আচরণের ফলে অনেক দেশই এখন নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের অশনি সংকেত মাথায় নিয়ে কালাতিপাত করছে। তোমরা জানো, সময়ের কাজ সময়েই করতে হয়। তা না করলে সেই কাজটি আর সঠিকভাবে করা হয়ে উঠে না। ঠিক তেমনি, বৃষ্টির সময় বৃষ্টি আর শীতের সময় শীত পড়তে হয়। তা না হলে দেশে প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসাই স্বাভাবিক। প্রকৃতির অস্বাভাবিক আচরণের অনেকগুলোর একটি ক্রমাগত বনভূমি উজাড় তথা গাছপালা কমে যাওয়া। আজ থেকে শতবর্ষ আগে আমাদের দেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশই বনভূমি ছিল। বড় দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় নির্বিচারে গাছপালা কাটা, আর এক শ্রেণীর মানুষের অর্থ লিপ্সা আর কাÐজ্ঞানহীন আচরণের প্রেক্ষিতে এই অমূল্য ও অপরিহার্য বনভূমি বর্তমানে ৭ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। জেনে রাখা দরকার, একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য দেশের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি প্রয়োজন। আর এভাবে বনভূমি উজাড় হতে থাকলে, গাছ না লাগিয়ে অবাধে গাছ কাটা অব্যাহত থাকলে সেদিন আর বেশি দূরে নয় যে দিন আমাদের বনভূমি এসে দাঁড়াবে ২/৩ শতাংশে। এই ভয়ংকর অবস্থা থেকে বাঁচতে হলে আমাদের এখনই ষোল কোটি মানুষের বত্রিশ কোটি গাছ লাগাতে হবে। ছোট্ট বন্ধুরা তোমরা জানো, মানব জীবনে বৃক্ষের মতো উপকারী বন্ধু আর দ্বিতীয়টি নেই। ফুল যেমন নিজের জন্য ফোটে না, বৃক্ষও তেমনি। বৃক্ষ আমাদের খাদ্য দেয়, বস্ত্র দেয়, ছায়া দেয়, আশ্রয় দেয় সর্বোপরি আমাদের বেঁচে থাকার অপরিহার্য উপাদান অক্সিজেন সরবরাহ করে। প্রাণী মাত্রই অক্সিজেন ছাড়া বেঁচে থাকতে পারে না। মানুষ তো নয়ই। আমরা আমাদের শ্বাস ক্রিয়ায় অক্সিজেন গ্রহণ করি আর ত্যাগ করি কার্বন-ডাই-অক্সাইড। এই কার্বন-ডাই-অক্সাইড মানুষের শরীরের জন্য একটি মহা ক্ষতিকর উপাদান। যদি বৃক্ষ না থাকতো তাহলে এক সময় সমস্ত বায়ুমন্ডল কার্বন-ডাই-অক্সাইডে ভরে যেতো। ফলে অভাব হতো অক্সিজেনের। আর অক্সিজেনের অভাব মানে প্রাণের বিলোপ। বৃক্ষ আমাদের ছেড়ে দেয়া কার্বন-ডাই-অক্সাইড শুষে নেয়। আর বাতাসে নিরন্তর যোগান দেয় অক্সিজেন। ফলে বিষাক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড যেমন দূরীভূত হয়, তেমন অক্সিজেনে কোন রকম ঘাটতি হয় না।
পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীজগত বৃক্ষের উপর নির্ভরশীল। বৃক্ষ তাদের খাদ্যের যোগান দিয়ে পৃথিবীর আলো বাতাসে বিচরণ করার সুযোগ করে দিচ্ছে। পৃথিবীর কোন প্রাণীই শর্করা জাতীয় খাদ্য ছাড়া বাঁচতে পারে না। শর্করা ভেঙে যে শক্তি উৎপন্ন হয়, তার সাহায্যে আমরা চলাফেরা করি। এক বিশেষ পদ্ধতিতে সূর্যের আলোকে কাজে লাগিয়ে বৃক্ষ এই খাদ্য উৎপাদন করে। এই খাদ্য উৎপাদনে প্রয়োজন হয় ক্লোরোফিল নামের এক ধরনের সবুজ জিনিস। আর এই জিনিস থাকে গাছের সবুজ পাতায়। পৃথিবীতে যদি বৃক্ষ না থাকতো তাহলে সেই কবে প্রাণী জগত বিলুপ্ত হয়ে যেতো। শুধু তাই নয়, বৃক্ষ পৃথিবীকে নানাভাবে বসবাসের উপযোগী করে রেখেছে। যেখানে বৃক্ষ নেই, সেখানেই সৃষ্টি হয় মরুভূমির। আর মরুভূমিতে বসবাস যে কতো দুর্ভোগ আর কষ্টের তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আর তাই আসুন, গাছ লাগাই। নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য, সর্বোপরি পরিবেশের জন্য। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী বিনিমার্ণের জন্য। তা ছাড়া গাছ লাগানো একটি সওয়াবের কাজ। সব ধর্মগ্রন্থে বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বৃক্ষের ফল যতদিন পর্যন্ত মানুষ বা পশু পাখি খাবে, তার জন্য বৃক্ষ রোপনকারীর সওয়াব জমা হতে থাকবে আল্লাহর দরবারে। বৃক্ষের সবুজ শোভা শুধু সৌন্দর্যই বর্ধন করে না আমাদের স্বাস্থ্য ও চরিত্রে প্রভাব ফেলে। ফলে আমরা মানুষের প্রতি দয়াশীল হই। ভালবাসতে শিখি। আজ তাই জাতীয় কবির অপরূপ রূপের বঙ্গজননীকে নতুন করে দেখার জন্য প্রত্যেকের উচিত একটা করে গাছ লাগান। আর তাতেই আমাদের প্রিয় দেশ সবুজের শোভায় ভরে উঠবে।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক