সবার সহযোগিতায় সফল হোক ঐতিহ্যের বলীখেলা

16

জব্বারের বলীখেলা চট্টগ্রামের ঐতিহ্য ইতিহাসের অংশ। ১৯০৯ সালে চট্টগ্রামের বদরপাতি এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী প্রয়াত আবদুল জব্বার সওদাগর এই প্রতিযোগিতার সূচনা করেন। আবদুল জব্বারের এই বলী খেলা ক্রমে ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও দেশজোড়া খ্যাতি লাভ করে। এখনো জব্বারের বলীখেলাকে জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যমÐিত প্রতিযোগিতা হিসেবে বিবেচিত করা হয়।
জানা যায়, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে দেশের যুব সমাজকে সংগঠিত করতে ও শরীর চর্চার প্রতি যুব সমাজের মনেনিবেশ ঘটাতে এই বলীখেলা আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন চট্টগ্রামের সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার। বছরের নির্দিষ্ট একটি দিনে অর্থাৎ প্রতি বৈশাখের ১২তারিখে এই বলীখেলা অনুষ্ঠিত হলেও এর ব্যাপ্তি অনেক। বলীখেলায় অংশ নিতে দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা হতে কুস্তিগীর তথা বলিরা আসেন। সারা বছর ধরেই তারা অনুশীলন করে শরীর চর্চা করে নিজেদের প্রতিযোগিতার জন্য তৈরি করেন। পাকিস্তান আমলে দেশের বাইরে তথা মায়ানমারের আরাকান রাজ্য হতেও নামজাদা কুস্তিগীর তথা বলিরা এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে আসতেন। এই বলীখেলাকে ঘিরে সপ্তাহ ঘিরে চলে ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্পের মেলা। এক সপ্তাহ মেলার কথা হলেও সারা দেশ হতে বিভিন্ন গৃহস্থালি পণ্য ও ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্পজাত পণ্য নিয়ে আসা, অস্থায়ী দোকান বসিয়ে পণ্যের পসরা সাজানো, বলীখেলা শেষে দোকান পাট গুটিয়ে নেয়া ইত্যাদি সব মিলিয়ে জব্বারের বলীখেলা ও মেলার বাপ্তি দশ থেকে বার দিন পর্যন্তও দীর্ঘায়িত হয়। আগেকার দিনে গৃহস্থালি পণ্য হাড়ি, পাতিল, দা, ছুড়ি, খন্তা, কোদাল, বেতের পাটি, মাদুর, ঝাড়ু, হাত পাখাসহ খেলনার পুতুল, মাটি ও কাঠের গহনা ইত্যাদি কেনাকাটার জন্য চট্টগ্রাম ও আশেপাশের লোকজন জব্বারের বলীখেলার উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল ছিল। সৌখিন জিনিসপত্র তুলনামূলক কমদামে সংগ্রহের জন্য এখনো শহুরে কিংবা গ্রামের অধিকাংশ মানুষ এই মেলার জন্য বলতে গেলে সারা বছর ধরেই অপেক্ষা করে থাকে। আর এই মেলা শুরুর কাল থেকে সারাদেশের ক্ষুদ্র কাঠ, বাঁশ, বেত, তাঁত, লৌহ ও মৃৎশিল্পীরা তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাÐ পরিচালনা করে আসছে। বছর জুড়ে কাঁচামাল সংগ্রহ করে উৎপাদনশীল কাজে তারা প্রচুর অর্থ ও শ্রম বিনিয়োগ করে থাকেন। বৈশাখ মাস এলেই তারা সারাদেশে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন বৈশাখী মেলায় তাদের উৎপাদিত ও নির্মিত পণ্য নিয়ে আসে বিক্রির জন্য। তবে সবচেয়ে বেশীই নির্ভর করে চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠের এই আবদুল জব্বারের বলীখেলার উপর, কারণ তাদের পণ্যের সিংহভাগই বিকিকিনি হয় এই মেলাতে। বৈশ্বিক মহামারী করোনার কারণে বিগত দুই বছর লালদীঘিতে জব্বারের বলীখেলা ও মেলা বসেনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি তত্ত¡াবধানে ও সফল প্রচেষ্টায় গৃহিত পদক্ষেপ ও সময়মত ভ্যাকসিন প্রদানের ফলে করোনার প্রভাব কাটিয়ে অনেকটা স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এলে আশায় বুক বাঁধে দেশের ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টজনেরা। তারা অনেক আগে থেকেই এটিকে ঘিরে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। কিন্তু এখনো লালদীঘি মাঠের ঐতিহাসিক স্মৃতি সংরক্ষণ ও সৌন্দর্যবৃদ্ধির চলমান কাজ শতভাগ সম্পন্ন না হওয়ায় স্থানাভাবের দোহাই দিয়ে এ বছর জব্বারের বলীখেলা অনুষ্ঠান ও বৈশাখী মেলা না করার ঘোষণা দিয়েছিলেন আবদুল জব্বার স্মৃতি কুস্তি প্রতিযোগিতা ও মেলা কমিটি। ১৩ এপ্রিল বুধবার চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের এস. রহমান হলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মেলা কমিটি এ ঘোষণা দিলে চট্টগ্রামের জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। শেষে, চট্টগ্রামের ঐতিহ্য, ইতিহাসকে তুলে ধর ও দেশের হস্তশিল্পের ঝিমিয়ে পড়া ভাব কাটিয়ে তোলা এবং চট্টগ্রামের মানুষের জব্বারের বলীখেলার সাথে মিশে থাকা আবেগ, অনুভুতিকে প্রাধান্য দিয়ে চট্টগ্রামের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষকে সমম্বিত করে বলীখেলা ও মেলা আয়োজনের উদ্যোগ নেয় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। এত বড় মেলা আয়োজনে ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে হয়, এতে অনেক অর্থ যোগান দিতে হয়। তাই বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে স্পন্সরশীপ যোগাড় করে মেলায় ব্যয়ভার গ্রহন করত মেলা কমিটি। কিন্তু, স্বল্প সময়ের সিদ্ধান্তে মেলা বসানোতে স্পন্সরশীপ যোগাড় করা অসম্ভব হওয়ায় এর দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসি আমি। ১৬ এপ্রিল শনিবার আমি আমার বাসভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন করি। আমি সংবাদ সম্মেলনে পরিস্কারভাবে বলেছি, জব্বারের বলীখেলাও হবে, মেলাও হবে। তবে অন্যান্যবার ৫দিনব্যাপী মেলা বসলেও এবার বসানো হবে ৩দিন। এটা আমাদের চট্টগ্রামের শত বছরের ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি এবং আমাদের ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য অংশ। আমাদের স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্যময় সত্তা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলাকে ধরে রাখতে হবে। এবারের বলীখেলা আয়োজনের সমস্ত ভার চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন বহন করবে বলেও আমি সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করি। যেহেতু রমজান মাস এবং উন্নয়ন ও সংস্কার কাজের জন্য লালদীঘির মাঠের ভেতরের অংশ ব্যবহার করা যাচ্ছেনা ফলে সম্ভাব্য যানজটের তীব্রতা কমিয়ে রাখতে এবারের বলীখেলার ক্ষেত্র হবে জেলা পরিষদ মার্কেটের সামনে রাতে ফ্ল্যাট লাইটের আলোয়। মেলার সার্বিক পরিচালনা ও তত্ত¡াধান করবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষায় সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করবে স্থানীয় আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। এবারই প্রথম চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সর্বাত্মক তত্বাবধানে ঐতিহাসিক জব্বারের বলীখেলা গতকাল ১২ বৈশাখ রবিবার শুরু হয়েছে, আজ কাক্সিক্ষত বলীখেলা অনুষ্ঠিত হবে। চট্টগ্রামের কৃষ্টি সংস্কৃতি ঐতিহ্য বজায় রাখতে বলীখেলার এটি ১১৩তম আয়োজন। বলীখেলা ও বৈশাখী মেলার এ আয়োজনে আমি সর্ব মহলের সহযোগিতা ও আন্তরিকতা কামনা করি।
লেখক : মেয়র, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন