‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’ শান্তি আর সম্প্রীতিই একমাত্র কাম্য

20

 

‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। এই কথাটি আজ থেকে বহু শতাব্দী আগে চÐীদাস বলে গিয়েছেন। যা বর্তমানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মূলমন্ত্র হিসেবে বিবেচ্য। প্রকৃতির সেরা জীব মানুষ। মানুষের মধ্যে রয়েছে বুদ্ধি, বিচারবোধ, বিবেক, মানবিকতা। তবুও কখনও কখনও মানুষ তার মনুষ্যত্ববোধ একবারেই ভুলে যায়। আর তাতে মুহূর্তেই সব উলোটপালট হয়ে যায়। সম্প্রতি দুর্গোৎসব চলাকালে কুমিল্লার একটি পূজামÐপে মুর্তির কাছে মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয়গ্রন্থ পবিত্র কুরআন আবিষ্কার নিয়ে তুলকালামকান্ড ঘটে গেছে। যা কারো কাম্য ছিল না। সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যায়, স্থানীয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-এ পবিত্র কুরআন পূজামন্ডপ থেকে উদ্ধার করেছেন। কিন্তু পবিত্র কুরআন পূজামন্ডপে কে নিল, কেনইবা এমন গর্হিত কাজ করতে গেল- এমন প্রশ্ন আজ সবার! প্রশ্নটা হলো, এ পবিত্র কুরআন যেহেতু অন্য ধর্মের প্রধান গ্রন্থ, সেহেতু পূজার্থীরা কেনইবা কুরআন তাদের প্রতীমার কাছে রেখে তাদের পূজা নষ্ট করবে? আমরা জানি সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পূজা অর্চনার ক্ষেত্রে বেশ সতর্কতা অবলম্বন করে। তারা এক্ষেত্রে অন্য কোন ধর্মের লোক বা তাদের ছায়াকেও সহ্য করতে পারে না। অপরদিকে প্রকৃত কোন মুনলমান নিজেদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থকে মন্ডপে নিয়ে দেবির কাছে সোপর্দ করতে পারে? মুসলামাদের জন্য এটি বিশ্বাস ভঙ্গের বিষয়, মহাপাপের। তাহলে কাজটি করল কারা বা কে? এ প্রশ্নে উত্তর যত দ্রæত বের করা যাবে, অপরাধীকে যত দ্রুত সনাক্ত ও আইনের আওতায় আনা যাবে-তত দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল হবে। সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাস ও সন্দেহ থেকে মুক্তি পাবে জাতি। এ কাজটি অবশ্যই সরকার এবং তাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে করতে হবে।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, প্রকৃতির সৃষ্টি তত্তে¡ মানুষ মানুষে কোনো পার্থক্য বা ভেদাভেদ নেই। কিন্তু অতীতের ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পেরেছি , মানুষ নিজেই তার জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের বিভেদ সৃষ্টি করছে। মানুষ ঐক্যের আদর্শ ভুলে লোভ, হিংসা, পরমত অসহিষ্ণুতা, মৌলবাদী সংকীর্ণ স্বার্থ চিন্তার কারণে সংঘর্ষ আর রক্তক্ষয়ী হানাহানিতে মেতে উঠে যার ফলে অকালে ঝরে পড়ে অনেক প্রাণ। হাজার হাজার প্রাণ, ঐক্য ও সংহতির উপর পড়ছে চরম আঘাত। ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায় ভিত্তিক ভেদাভেদ ও সংঘাত ই হল সাম্প্রদায়িকতা। জাতীয় সংহতি বিপন্নের অন্যতম কারণ সাম্প্রদায়িকতা থেকে মানুষকে সুপথে নিয়ে আসার জন্য প্রয়োজন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। বিশ্বে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িত সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এদেশে এখানে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই একসমাজে এবং পাশাপাশি পড়শি হয়ে বসবাস করে। অনেক জায়গায় মসজিদ আর মন্দির মাত্র একটি দেয়ালের ব্যবধানে হলেও ধর্মাচার পালনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বরং উভয় সম্প্রদায় পরস্পরের ধর্মীয় উৎসবকে ভাগাভাগি করছে। অথচ এদেশের মোট জনসংখ্যার সাড়ে এগারো ভাগ মাত্র অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। বাকি সবাই মুসলামান। অথচ এদেশের সংবিধানের চার মূলনীতির একটি ধর্মরিপেক্ষ। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হলেও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি থেকে বাংলাদেশ চুল পরিমানও নড়েনি। পাশের বন্ধুপ্রতীম অনেক দেশ তাদের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললেও তাদের দেশের সংখ্যালঘুদের উপর কি ধরনের নিমর্মতা চলে আসছে-এর প্রকৃষ্ট উদাহারণ রোহিঙ্গা সম্প্রদায়। এছাড়া রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির করার দৃষ্টান্তও পাশের দেশে আছে। অপরদিকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মন্দির, পেগোডা, মঠ ও গীর্জা হয়। সকল ধর্মের প্রধান উৎসবে রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা ছাড়াও বেসরকারি সংস্থা, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতি সংগঠন ও মুসলিম দানবীর এবং রাজনীতিকরা নিজ উদ্যোগে সহযোগিতাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে।
উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চেতনা একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা। এর সূচনা করেছেন আট শতকের বৌদ্ধ পাল রাজারা। এগারো শতক থেকে মুসলমান সুফি সাধকদের অসা¤প্রদায়িক মানবতাবাদ পরবর্তী প্রায় ৭শ বছরব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে বাংলায়। হিন্দু সমাজ থেকেও মরমি সাধক শ্রীচৈতন্যদেব বেরিয়ে আসেন নব্যবৈষ্ণব আন্দোলন নিয়ে। এভাবে সমগ্র মধ্যযুগব্যাপী মানবতাবাদী ধর্ম স¤প্রদায় অসা¤প্রদায়িক চেতনাকে শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করে। এসব কারণেই এ দেশের সমাজে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ সবার ধর্মীয় উৎসবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্পষ্ট হয়।
ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ অব্যাহত রাখতে পারলে এ দেশের ধর্মান্ধ জঙ্গিবাদ কখনো শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারবে না। এ জন্য সরকারকে আরো সতর্ক হতে হবে। আবহমান বাঙালির অসা¤প্রদায়িক জীবনবোধকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে। বিজ্ঞানমনস্কভাবে ধর্মচর্চা এবং বাঙালির হাজার বছরের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে পাঠ্যক্রমে যুক্ত করতে হবে। বিজয় দশমীর মাধ্যমে শেষ হলো দুর্গোৎসব। এর সাথে সাম্প্রদায়িকতার সকল উত্তেজনাও প্রশমিত হোক-এমনটি প্রত্যাশা আমাদের।