সন্ধ্যার বয়েসি

35

মো. আরিফুল হাসান

বাজার থেকে সব শেষে ফেরা মানুষটির নাম আব্দুল কুদ্দুস। একটু হাবাগোবা, একটু বোকা বোকা। সবাই তাকে খ্যাপিয়ে মজা পায়। কুদ্দুসও রাগ করে। রেগে গেলে সে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করতে থাকে। এতে লোকেরা একধরণের বিকৃত আনন্দ পায়। দেখা যায়, যে প্রথমে কুদ্দুসকে খোঁচা দিয়েছিলো, কুদ্দুস তার পরিবারের চৌদ্দগুষ্টিকে ধুয়ে উদ্ধার করে দেয়। তবুও মানুষের বিনোদনের তিয়াস মিটে না। তখন হয়তো দোকানের ছেলেটা এক গ্লাস জল ছুড়ে মারে কুদ্দুসের দিকে। কুদ্দুস রাস্তা থেকে ইট তোলে ছেলেটাকে মারতে। তখন সবাই মিলে কুদ্দুসকে থামায়। আহা আব্দুল কুদ্দুস, এমন করে না। পোলাপাইন না বুইঝা করছে, তুমি তো বুঝো। তখন হয়তো লোকেরা কুদ্দুসকে যে প্রথম খেপিয়ে ছিলো তাকে এবং যে কুদ্দুসের গায়ে জল ঢেলে ছিলো তাকে খুব করে বকে দেয়। হয়ত তারা পরস্পরে চোখে চোখে কোনো কথা বলে, কিন্তু কুদ্দুস তো চোখের ভাষা পড়তে পারে না।
পইসার বাপ বললেই হলো কুদ্দুসকে। তখন তাকে থামায় এমন সাধ্য কারো নেই। কুদ্দুস মুখে ফেনা তুলে ফেলে গালাগাল করতে করতে। ছেলে ছোকড়ারা এতে বেশি মজা পায়। তারা তখন সুর ধরে নামাতার মতো বলতে থাকে, পইসার বাপ, পইসার বাপ, পইসার বাপ। কুদ্দুস বেশি রেগে গেলে কেঁদে ফেলে। সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে মাটিতে বসে। ছেলে-ছোকরারা কিছুটা নরম হয় এতে। কেউ হয়তো ভয়ে ভয়ে কাছে এসে জানতে চায়, আইচ্চা দাদা, পইসার বাপ কইলে তুমি চেতো কেরে? কুদ্দুস তার কান্না থামায় না, বেড়ে যেতে থাকে। এক সময় বিলাপে রূপ নেয় সেটি। ছেলে ছোকড়ারা মজা করতে এসে মন খারাপ করে চলে যায়।
কুদ্দুসের প্রথম ছেলের নাম সেলিম। সেলিম যখন হয়, কুদ্দুসের আনন্দ তখন দেখে কে। সারাদিন ছেলেকে কোলে নিয়ে ছেলের সাথে কথা বলে। অবশ্য কথাও সে স্পষ্ট করে বলতে পারে না। কেমন যেনো মুখে লাগিয়ে লাগিয়ে উচ্চারন করে, মুখ থেকে থুথু বের হয়। কুদ্দুস সকালের রোদে ছেলেকে নিয়ে বসে। বাড়ির পাশে রাস্তা, রাস্তার পাশে তার খড়ের গাঁদা। কুদ্দুস সেখানে একবাটি মুড়ি নিয়ে বসে। খেতে খেতে ছেলের সাথে কথা বলে। পথ দিয়ে যাওয়া লোকজন তার কথা শোনে, নীরবে একটু হাসে, থামে একপলক। তারপর আবার যে যার কাজে চলে যায়। কেউ হয়তো একটু বেশি সময়ই থামে। মজা করতে ইচ্ছে হয় কুদ্দুসের সাথে। জিজ্ঞেস করে, ছেলের নাম রাখছো কী? পইসা, সাফ সাফ জবাব দেয় কুদ্দুস। পইসা? এইডা আবার কোন যুইত্তা নাম? হ, এইডাঅই- হাসি মুখে জবাব দেয় কুদ্দুস। এই পোলা বড় অইলে আল্লা আমারে পইসার মুখ দেহাইবো, -কুদ্দুসের মুখের হাসি বেড়ে যায়। তখন সেই লোকটি হয়তো দোকানে চা খেতে খেতে কারো সাথে হাস্যরসে এ কথাটি বলে এবং তখন অনেকেই জানতে চায় কুদ্দুস মিয়া, আসলে তোমার পোলার নাম কী? কুদ্দুস হয়তো একই কথা বলে এবং এভাবে গ্রামময় ছড়িয়ে যায় যে কুদ্দুস মিয়া মূলত পইসার বাপ।
ছোটবেলা থেকেই আব্দুল কুদ্দুসের বুদ্দিসুদ্দি একটু কম। পড়ালেখা করার সুযোগ না থাকলেও অন্যরা যেমন সংগ্রাম করে দুয়েক ক্লাস পড়েছে তার ভাগ্যে তেমনটিও জুটেনি। ক্ষেতে কাজ কাম করেছে এবং কৃষকপনাতেও সে যথেষ্ঠ দক্ষ নয়। বাপের রেখে যাওয়া একমাত্র জমিতে তাই তার ফসল উঠে অন্যদের তুলনায় কম। এ ফসল দিয়ে সংসার চলে না, তাই কুদ্দুস দিন আনে, দিন খায়। অন্যদের ক্ষেতেও সে যায় কাজ করতে, মজুরি ঠিক মতন পায় না। অবশ্য কাজের যোগ্যতা দেখে তবে তো কৃষক টাকা দিবে। তবুও কেউ কেউ কুদ্দুসকে কাজে রাখে। ক্ষেতের আলে বসে তামাকটা হুঁকুটা তো জ্বালাতে পারে কুদ্দুস। তাছাড়া চালাক চাষিরা তাকে দিয়ে একটু বেশিও খাটিয়ে নেয় মাঝে মাঝে। ক্ষেত থেকে অন্যান্য মজুররা চলে গেলেও কুদ্দুসকে রেখে দেয় জমির মালিক, আরে যাইবি অইদ্য, আর কুদ্দুর থাক, আমার লগে যাইচ। কুদ্দুস, এক ছিলম তামুক লাগা চাইন। কুদ্দুস বেনায় ফু দিয়ে টিক্কা জ্বালে। নিজে বড় বড় দুইটা টান দিয়ে হুঁকা এগিয়ে দেয় মালিকের দিকে। তখন কাজ করতে করতে, তামুক খেতে খেতে কুদ্দুস ভুলে যায় সময়জ্ঞান। দেখা যায় অন্যান্য শ্রমিকরা চলে যাবার পরেও দের দুই ঘন্টা বেশি কাজ করিয়ে নিয়েছে তাকে দিয়ে।
কুদ্দুসকে সবচেয়ে বেশি ঠকিয়েছে তার চাচাতো ভাইয়েরা। পিতার মৃত্যুর পর একমাত্র সন্তান কুদ্দুসকেও চাচাতো জেঠাতো আট ভাইয়ের সমান সমান একটুকরো করে জমি নিতে হয়। অথচ কুদ্দুস তার পিতার ভাগ সবটাই পাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু তার চাচা এস্কান্দর আলি যখন বললেন, বাবা কুদ্দুস, অইন্য ভাইদের হমান নেওন ভালা না? কুদ্দুস মাথা দুলিয়ে উত্তর দিয়েছিলো, হ, হমান নেয়নঅই ভালা। চাচা এস্কান্দর খুশি হয়ে কুদ্দুসের বিয়ের আয়োজন করে। কিন্তু কুদ্দুসের জন্য মেয়ে পায় কোথায়? চারিদিকে খোঁজ লাগালো, কিন্তু কুদ্দুসের কথা শোনে, তার আচরণ দেখে কেউ আর কন্যা দিতে রাজি হয় না। শেষমেষ একটি অতিনিঃস্ব পরিবার তাদের শ্বেতি পড়া কুচকুচে কালো মেয়েটিকে কুদ্দুসের কাছে বিয়ে দিতে সম্মত হয়। অবশ্য এ বিয়েটির সময়েও কুদ্দুস তার স্বভাবজাত বোকামির কোনো অন্ত রাখে না। কন্যা পক্ষ যেদিন দেখতে আসবে সেদিন হঠাৎ কুদ্দুস হাওয়া। সবাই ভাবছে, কই গেলো, কই গেলো কুদ্দুস! পাত্রী পক্ষের লোকজন বসে আছে ছেলে দেখবে বলে, হঠাৎ করেই কুদ্দুসের আবির্ভাব হয়। গায়ে পরিহিত শাদা শার্টটিতে ইচ্ছে মতোন কলম দিয়ে এঁকে রেখেছে সে। পরে মুরব্বীরা প্রশ্ন করলে বলেছে, আমি ভাবছি কলমের দাগটাগ থাকলে হেইতারা ভাববো আমি শিক্ষিত মানুষ। কি আর করার, মুরব্বীরা চোখে হেসে বিয়ে সম্পাদন করেন। আসলে কন্যাপক্ষেরও আর কোনো উপায়ন্তর ছিলো না।
কুদ্দুসের চার ছেলে। বড় ছেলে পয়সার মুখ দেখেছে। একটি চাকরি নিয়ে সে বৌ-বাচ্চাসহ শহরে থাকে। লোকেরা গল্প করে, কুদ্দুসের বড় পোলার কত ট্যাহা! কিন্তু এ টাকার মুখ কুদ্দুস দেখে না। তার আর দুটি ছেলেও রোজগার পাতি ভালোই করে। দুটো ছেলের বৌ ঝগড়া লেগে যুদা হয়ে গেছে সেই সাত বছর। ছোট ছেলেটাকে নিয়ে কুদ্দুস ধুঁকে ধুঁকে বাঁচতে থাকে। তার ছোট ছেলেটিও হয়েছে তার মতো বোকা। বলা যায় তার চেয়ে আরেকটু বেশি। ফলে বয়েস বাড়লেও পিতার কাঁধের ভার বৃদ্ধি ছাড়া সে আর কিছু করতে পারে না। কুদ্দুস বয়েসের ভারে নুব্জদেহে সংসারের ভার বয়ে চলে। স্ত্রী অসুস্থ, ভালো চিকিৎসা যে করাবে সেই সামর্থ তার নেই। বাড়িতে থাকা দুটো ছেলের কাছে বললে বলে, আমরা গেরামে থাইক্কা আর কয় টেহা কামাই করি? বড় ভাইরে কও। বড় ছেলেকে বলার অবকাশ পায় না কুদ্দুস। ছেলের বৌ তার যাওয়াটাকে পছন্দ করে না। স্বামীকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে, তোমার এই আধা পাগল বাপ যুদি বাসায় আসে তাইলে আমি চিরদিনের জন্য বাপের বাড়িতে চইলা যামু। বড় ছেলে সেলিমও চায় না বাপের জন্য সংসারে অসুবিধা হোক। তাই সে নাড়ীর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছে। বছর-দুতিন বছরে হয়তো একবার আসে বাড়িঘর দেখতে। একাই আসে, সঙ্গে বৌ ছেলে মেয়ে কেউ আসে না।
বাজারে দুটি লাউ আর কয়েক মোঠা ডাটাশাক নিয়ে গিয়েছিলো কুদ্দুস। ডাটা শাকগুলো ভালো দামেই বেচতে পেরেছে। পাঁচ টাকা আঁটি সাত মোঠা শাক সে পঁয়ত্রিশ টাকায় বিক্রি করে। অবশ্য বিক্রি করতে গিয়েও সে কম হেনস্তার শিকার হয়নি। বাজারেও কেউ হয়তো তাকে খেপিয়ে তুলেছে। আর হইচই করে গালাগালি আরম্ভ করেছে কুদ্দুস। কিন্তু লোকটি হয়তো আরও বড় সেয়ানা। সে হয়তো আরও দুতিন জনকে বলেছে কুদ্দুসকে পইসার বাপ বলতে। তার সহসঙ্গী দুতিন জন হয়তো তখন পইসার বাপ, পইসার বাপ বলে তাকে আরো বেশি উত্যক্ত করেছে। শেষ মেষ হয় হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছে। কুদ্দুস। যাই হোক, তার লাউ দুটো বিক্রি হচ্ছে না। একটি লাউ বয়স বেড়ে পেকে গেছে, নখ দাবে না। আরেকটি লাউ অদ্ভুত রকম আঁকাবাঁকা। সরল পেয়ে সবাই চিমটি কেটে কেটে সেটির অবস্থাও দেখার মতো রাখেনি। কুদ্দুস বসে থাকে। বাজারে হাটুরেদের ভীর কমতে থাকে। কমতে থাকে সূর্যের আলো। কুদ্দুসের লাউ বিক্রি হয় না। অথচ লাউ দুটো তাকে বেঁচতে হবে। বৌয়ের জন্য তেতাল্লিশ টাকার ওষুধ কিনবে সে। বাড়ি থেকে আসার সময় সাথে কোনো টাকা আনতে পারেনি। লাউ দুটো বিক্রি না হলে বুড়ির জন্য আজ আর ওষুধ কেনা হবে না। শেষপর্যন্ত দত্ত বাড়ির ভিখারিটি এসে হয়তো দশ টাকায় দুটো লাউ কিনে নেয়। তখন হয়তো বাজারের সব লোকজন চলে গেছে। দোকানপাটও বন্ধ হয়ে গেছে অধিকাংশ। কুদ্দুস দ্রুত ছোটে ফার্মেসি দোকানে। হাতে ওষুধের পুটলিটা নিয়ে পকেটে হাত দিয়ে দেখে লাউ বেচার দশ টাকা ছাড়া ডাঁটা বেচার পয়ত্রিশ টাকা তার পকেটে নেই। কোন ফাঁকে কখন যেনো পড়ে গেছে। কুদ্দুস যেখানে বসে তরকারি বিক্রি করেছিলো এবং যে পথ দিয়ে ফার্মেসিতে এসেছে সেই অঞ্চল বারবার ভালো করে খুঁজে। না, তার টাকা পাওয়া যায় না। হতাশ হয়ে কুদ্দুস ফার্মেসিতে আসে। টাকা সে পরে দিতে চায়। ফার্মেসির লোক তার হাত থেকে ওষুধের পুটলিটা রেখে দেয়।
কুদ্দুস অসহায় হয়ে ফার্মেসি থেকে বেরিয়ে আসে। তখন সে পাগলের মতো সারা বাজার তন্ন তন্ন করে খোঁজে তার টাকা। তরকারির দোকানগুলো সব বন্ধ হয়ে গেছে, এ গলিটা অন্ধকার। কুদ্দুস মাটিতে বসে হাতড়ে হাতড়ে খোঁজে তার টাকা। খুঁজে বেড়ায় পাগলের মতো। কোনো মুদি দোকানদার হয়তো বিষয়টি দেখে, হারে পইসার বাপ, এই আন্দাইরে তুমি ট্যাহা পাইবা কই? দিনের বেলা খুইজ্জো। কুদ্দুস নিরস্ত্র হয় না। কিন্তু এক সময় সে ক্লান্ত হয়। তখন বাজারের সব দোকানপাট একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। নিরুপায় কুদ্দুস বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। পথে একটি টং দোকান খোলা দেখে ভাবে, পাঁচ টেহার বিড়ি কিন্না লই। আবারও পকেটে হাত দেয় কুদ্দুস। না নেই, পয়ত্রিশ টাকা খুঁজতে খুঁজতে কখন যেনো তার পকেটের দশটি টাকাও পড়ে গেছে। মনে মেঘ নিয়ে কুদ্দুস টংঘর থেকে ফিরে আসে। পেছনে কেউ টিপ্পনি কাটে, হালা পইসার বাপ, ট্যাহা নাই, আইছে বিড়ি কিনত। কুদ্দুস শোনেও যেনো শোনে না। স্বভাববশত আজ আর রেগে উঠে না সে।